#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ১
‘আআআহ! আআআহ! ঝলসে গেলো। আব্বু, চাচ্চু আমার সব ঝলসে গেলো। মরে যাচ্ছি আমি। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে চেঁচাতে থাকে আরিশা।’
আরিশার চিৎকার শুনে আশফাক আহমেদ ও রাফসান ছুটে আসলেন।
রাফসান আতঙ্কিত গলায় বলে, ‘কি হয়েছে চাচ্চু?’
আরিশা মুখের একপাশটা দেখিয়ে বলে,
‘চাচ্চু, আমার এখানে ঝলসে যাচ্ছে। জ্বলছে, খুব জ্বলছে চাচ্চু।’
আশফাক আহমেদ ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন, ‘অ্যাসিড পড়েছে মুখে।’
রাফসান দ্রুত আরিশাকে উঠানে নিয়ে গিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে মুখ ধুইয়ে দেয়। আরিশা রাফসানের শার্ট খামছে ধরে আছে। ওর খুব জ্বালাপোড়া করছে। রাফসান ওকে আশ্বস্ত করে বলে,
‘কিচ্ছু হয়নি চাচ্চু। অল্প একটু অ্যাসিড পড়েছে। ওগুলোর সাথে পানি মেশানো ছিলো বলে তীব্রতাও কম ছিলো।’
আরিশা ঝলসানো স্থানে হাত রেখে বললো, ‘আমাকে কি বাজে দেখাচ্ছে চাচ্চু?
রাফসান ওকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বললো, ‘নিজেই দেখে নে।’
আরিশা হাত বুলিয়ে সারামুখ খতিয়ে খতিয়ে দেখতে লাগলো। মুখের ডানপাশে মার্বেল পরিমাণ জায়গা সাদা হয়ে কুঁচকে গেছে। ও সেটা দেখিয়ে আহত চোখে রাফসানের দিকে তাকায়।
রাফসান মুচকি হেসে বলে,
‘দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।’
আরিশা সামান্য স্বস্তি পায়। কিন্তু মন থেকে দুশ্চিন্তা পুরোপুরি দূর হয় না।
আশফাক আহমেদ বললেন, “যে স্থানে ব্যথা অনুভব করছো, সেখানে হাত রেখে তিনবার বিসমিল্লাহ বলো।”
আরিশা বললো। আশফাক আহমেদ বললেন, “এবার সাতবার দোয়াটা পড়ো।
أَعُوْذُ بِاللّٰهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِر ُ[১]
‘আ‘ঊযু বিল্লা-হি ওয়া ক্বুদরাতিহী মিন শাররি মা আজিদু ওয়া উহা-যিরু।’
অর্থ: এই যে ব্যথা আমি অনুভব করছি এবং আমি যার আশঙ্কা করছি, তা থেকে আমি আল্লাহ্র এবং তাঁর কুদরতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”
আরিশা বাবার মুখে মুখে পড়লো। পড়া শেষ হওয়ার পর মনে হলো ওর জ্বালাপোড়া অনেকটা কমে গেছে। মনে মনে বললো, সবটাই আসলে বিশ্বাস।
ঘন জঙ্গলের মাঝখানে সুন্দর ছিমছাম তিনতলা বাড়িতে আরিশার বসবাস। বয়স সতেরো ছুঁই ছুঁই। আরিশা যে বাড়িতে থাকে তার আশেপাশে আর কোনো বাড়িঘর নেই। বহু পুরোনো সাদা চুনকাম করা বাড়িটার কিছু কিছু অংশে ফাটল ধরেছে। বাড়িটার চারপাশে ঘন গাছপালা ও পোষা প্রাণীতে ভরপুর। পোষা প্রাণী, বন্য পাখ-পাখালী ও বানরদের সাথে দিব্যি সময় কেটে যায় দুরন্ত কিশোরী আরিশার।
আরিশার বাবা আশফাক আহমেদরা চার ভাই। জঙ্গলের শুরুর দিকে কিনার ঘেঁষে রাস্তার পাশে আশফাক আহমেদের একটা হার্ডওয়্যারের দোকান রয়েছে। ওখানে তিনি প্রায়সময় থাকেন। মাঝেমধ্যে রাফসানও দোকানে বসে। আশফাক আহমেদের পরবর্তী ভাই আরহাম আহমেদ তার পরিবার নিয়ে রাজধানীতে থাকে। সে এ বাড়িতে কখনো আসে না। আরিশা ছোটবেলায় একবার তাকে দেখেছিলো। সেসব ওর এখন আর মনেই নেই।
আরমান ও রাফসান এখনো বিয়ে করেনি। আরমানের ছোটখাটো একটা গাড়ির গ্যারেজ আছে। আইপিএস, ব্যাটারী ও নানান ধরনের নষ্ট হওয়া জিনিস সে মেরামত করে। দিনরাত সে গ্যারেজেই পরে থাকে। তার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। অথচ সে এখনো বিয়ে করেনি। তার ধারণা সে বিয়ে করলে আরিশার কাছাকাছি আর থাকতে পারবে না। তার মেঝভাইয়ের মতো হয়তো সে-ও দূরে চলে যাবে। হয়তো তার বউ আরিশাকে ভালোবাসবে না। এই ভয়ে সে এখনো বিয়ে করেনি। ভবিষ্যতেও করার ইচ্ছে নেই।
রাফসান আরিশার চেয়ে বছর দশেকের বড়। সে এবার সাতাশে পা দিয়েছে। তবে সে আরিশার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। রাফসান প্রায়ই বাড়িতে থাকে। বাড়ির পেছনে বড় পুকুরে সে মাছ চাষ করে। তাছাড়া বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে নিরিবিলি জায়গায় জঙ্গলে ঘেরা বড় একটা নদী আছে। মাঝেমাঝে আরিশাকে নিয়ে সে নদীতে মাছ ধরতে যায়। মাঝেমধ্যে ঘুরতেও যায়।
আরিশার বয়স যখন দু’মাস তখন ওর মা মারা যায়। ধারণা করা হয়, কেউ ষড়যন্ত্র করে ওর মাকে মেরে ফেলেছে।
তখন থেকে আরিশাকে আশফাক, আরমান ও রাফসান মিলে বড় করে তোলে। তবে আরিশার বেশিরভাগ সময় কাটে রাফসানের সাথে। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ওরা পাখি শিকার করে, অন্যান্য পোষা প্রাণীদের সেবা যত্ন করে, মাছ চাষ করে হালাল রোজগারে ওদের দিন খুব ভালোভাবেই কেটে যায়। তবে আরিশা সবার চোখের আড়ালে সারাক্ষণ দূরন্তপনা করে বেড়ায়। কিন্তু সবার সামনে সে খুবই ভদ্র, মার্জিত একজন হয়ে থাকে।
জঙ্গলের মাঝখানে বাড়িটিতে আশফাক, আরমান ও রাফসানের সাথে আরিশার বসবাস। বিশাল পুরোনো বাড়িটিতে চারজনের সুখের সংসার।
আরমান যতক্ষন বাড়িতে থাকে ততক্ষন নানারকম ব্যাটারী নিয়ে কিসব কাজ করতে থাকে। আজকেও সে সিঁড়ির কাছে ছোট একটা বালতি ভরে অ্যাসিড রেখেছিলো। ওতে পানিও মেশানো ছিলো। সে ভুলক্রমে বালতিতে ঢাকনা না দিয়ে খোলামেলাভাবে বালতিটা রেখে নিচে চলে যায়। বাড়ির দরজার কাছে বসে ব্যাটারীতে তারের সংযোগ দিতে দিতে আরিশাকে ডাকে।
‘পুতুনি, এদিকে এসো তো।’
আরমান আরিশাকে ‘পুতুনি’ বলে ডাকে।
আরিশা ছুটে যায় আরমানের কাছে। আরমান ওকে আদুরে গলায় বলে,
‘সিঁড়ির কাছে একটা ছোট বালতি আছে। ওটা নিয়ে এসো যাও। সাবধানে আনবে কিন্তু।
আরিশা স্বভাবসুলভ লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যায়। আর বালতি নিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে। তখনই ওর মুখে অ্যাসিডের ছিটা এসে লাগে।
.
.
.
‘নির্ভীক, বাবা ওঠ। অনেক বেলা হলো যে।’ মিসেস শায়লা নির্ভীকের রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন।
নির্ভীকের কোনো সাড়া নেই। সে তখনো ঘুমে বিভোর।
মিসেস শায়লা এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন। নির্ভীকের চোখে-মুখে রোদের আলো এসে পড়ে। সে বিরক্ত হয়ে মাথাসহ চাদরের তলায় ঢুকে পড়ে। মিসেস শায়লা চাদরটা একটানে সরিয়ে বললেন,
‘এগারোটা বাজতে চললো। তোর না কোথায় একটা যাওয়ার কথা ছিলো? ফটোগ্রাফি করার জন্য?’
এবার ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে নির্ভীক। চোখ কচলে বলে,
‘আগে ডাকবে না আমাকে? ক’টা বাজে?’ বলে মিসেস শায়লার ডানহাতটা চোখের সামনে উঁচিয়ে ধরে চোখ বড় বড় করে বললো,
‘শিট! মম, আগে ডাকবে না আমাকে?’
নির্ভীক দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়লো। মিসেস শায়লা বিছানা গোছাতে গোছাতে বললেন,
‘সকাল থেকে ডাকছি তোকে। কোনো হুশ আছে? যেই ফটোগ্রাফির কথা বললাম অমনি ধড়ফড়িয়ে উঠে গেলি।’
নির্ভীক ততক্ষণে শাওয়ারের নিচে জলধারায় ভিজছে। সে শাওয়ার নিতে নিতে চেঁচিয়ে বললো,
‘ওটাই তো আমার ড্রিম, মম!’
বেলাদীঘি বিভাগের স্বনামধন্য এমপি হোসাইনুল আলমের একমাত্র ছেলে নির্ভীক। সে বর্তমানে বেলাদীঘির সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। হোসাইনুল আলমের ইচ্ছে নির্ভীক পড়াশোনার পাশাপাশি তার সাথে রাজনীতিতে যোগ দিক। কিন্তু নির্ভীকের ইচ্ছে ভিন্ন। ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি তার মারাত্মক ঝোঁক। সে সারাক্ষণ প্রকৃতির ছবি তুলে বেড়ায়। এসব হোসাইনুল আলমের একেবারেই পছন্দ না।
বেলাদিঘীর সবচেয়ে বিশাল বাড়িটা হোসাইনুল আলমের। স্ত্রী-পুত্র ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে হোসাইনুল আলমের ভরা সংসার। তাদের সেবায় কয়েক ডজন চাকর-বাকর সারাক্ষণ বাড়িময় ঘুরঘুর করে। এ’বাড়িতে কেউ কারো সাথে তেমন কথা বলেন না। হোসাইনুল আলমের সাথে তো না-ই। শুধু নির্ভীক আলাদা আলাদাভাবে সবার সাথে কথা বলে। হোসাইনুল আলম বাদে বাড়ির সবার সাথে ভাব ওর।
নির্ভীক দ্রুত রেডি হয়ে ক্যামেরা হাতে নিচে নেমে এলো। মিসেস শায়লা বললেন,
‘ব্রেকফাস্ট রেডি, বসে পড়ো!’
‘নো মম! আ’ম অলরেডি লেইট। আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে।’ বলে দরজার দিকে ছুটলো। তখনই ধাক্কা লাগে হোসাইনুল আলমের সাথে।
তিনি গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘ভার্সিটিতে।’
‘হাতে ক্যামেরা কেন?’
‘ইয়ে মানে…’ আমতা আমতা করে নির্ভীক।
‘ক্যামেরা রেখে ভার্সিটি যাও।’
‘ড্যাড!’ নির্ভীক আহত চোখে তাকায় বাবার দিকে।
‘যেটা বললাম সেটা করো।’
অগত্যা বাধ্য হয়ে ডাইনিং টেবিলে ক্যামেরাটা রেখেই বেরিয়ে গেলো নির্ভীক। ও বেরুতেই মিসেস শায়লা বললেন,
‘তুমি আবার ফিরে এলে যে?’
‘ইম্পর্ট্যান্ট ফাইলটাই তো ফেলে গেছি।’
‘ও আচ্ছা। আমি নিয়ে আসছি।’ বলে সিঁড়ির দিকে এগুলেন মিসেস শায়লা।
হোসাইনুল আলম তাকে আটকে বললেন,
‘তুমি খুঁজে পাবে না। আমিই যাচ্ছি।’ বলে উপরে গেলেন এবং ফাইল হাতে ফিরেও এলেন।
বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘ছেলেটাকে আর মাথায় তুলো না। এসব ফটোগ্রাফি-ট্রাফি করে ও নিজের ইমেজ তৈরী করতে পারবে না। ও ভুলে যাচ্ছে, ও কার ছেলে। ওর উচিত রাজনীতিতে মন দেয়া। অথচ সে সারাক্ষণ উল্টাপাল্টা ছবি তুলে বেড়ায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব বন্ধ করে রাজনীতিতে যোগ দিতে বলো।’
মিসেস শায়লা কিছু বললেন না। তিনি এর কঠোর জবাব দিতে গিয়েও কথাগুলো ভেতরে চেপে রাখলেন। এই মুহুর্তে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করাটা ওনার ঠিক বলে মনে হলো না।
আশফাক আহমেদ ও আরমান দোকানে চলে গেছে। রাফসান তার পুরোনো সেল্ফের সমস্ত বইগুলো বের করে ওগুলো পরিষ্কার করছে। সকালে রাফসান ও আরিশা খামার থেকে গরু-ছাগলগুলোকে বের করে দূরের মাঠে নিয়ে বেঁধে এসেছে। সন্ধ্যা হলে নিয়ে আসবে। ওখান থেকে এসে পাখি ও হাঁস-মুরগিগুলোকে খাবার দিয়ে নিজেরা খাবার খেয়েছে। এরপর আরিশা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তার শখের ফুলের বাগানে পানি দিয়েছে। পানি দেয়া শেষে সে পাশের ক্ষেত থেকে শাক-সবজি, আলু, পটলসহ নানারকম তরিতরকারি তুলে রান্নাঘরে যায়।
তরিতরকারিগুলো বড় গামলায় ভিজতে দিয়ে চাল আনতে যায়। চাল আনতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে চালের ড্রাম শূন্য। গতকাল রাতেই রান্না করতে গিয়ে চালের টান পড়েছিলো। এক-পা দু’পা তাল মিলিয়ে সে রাফসানের ঘরে যায়।
রাফসান বইয়ের ধুলো ঝাঁড়তে ঝাঁড়তে বলে,
‘কিছু বলবি?’
‘চাচ্চু, চাল শেষ হয়ে গেছে।’
রাফসান কিছুক্ষণ ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। আরিশার চিন্তিত মুখটা দেখতে ওর খুব ভালো লাগছে। মায়া হচ্ছে আরিশার জন্য। সে আরিশাকে আশ্বস্ত করে বললো, ‘তুই বাকি কাজগুলো শেষ কর। আমি চাল নিয়ে আসি, কেমন?
‘আচ্ছা’ বলে বাধ্য মেয়ের মতো রান্নাঘরে পা বাড়ায় আরিশা। রাফসান ওর যাওয়ার পানে অপলক তাকিয়ে থাকে। এই তো সেদিন ওকে কোলে নিয়ে খেলা করছিলো রাফসান। ওকে কোলে নিয়ে জঙ্গলের গহীনে ঘুরে বেড়াতো। গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে গাছ থেকে পেয়ারা, কমলা, আমড়া কতকিছু পেড়ে খাওয়াতো। আরিশাকে সাইকেলে নিয়ে সারা বিকেল নদীর পাড়ে কাটাতো। সব স্পষ্ট মনে আছে রাফসানের। সময় কত দ্রুত বয়ে যায়। মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল।
রেফারেন্স:
[১] মুসলিম ৪/১৭২৮, নং ২২০২
#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️