#অশান্ত বসন্ত
(পঞ্চম পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
(#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
****************
চেহারাই হোক আর কাজকর্মই হোক,সবেতেই অর্নব চৌধুরী এ’প্লাস।
আর অর্নবের কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ আর অনুরাগের কারনে অর্নব বসের ডানহাত।
‘অর্নব ছাড়া বস আর অফিস দুটোই অচল’,মজা করে এমনটাই বলে কলিগরা।প্রচুর ছুটি জমে থাকলেও অর্নব ছুটি নেয়না।সময়ের আগেই অফিসে আসে আর সময়ের পরেই বাড়ি যায়।
অর্নব কখনো নিজের শারীরিক অসুস্থতা বা পারিবারিক সমস্যার প্যাটরা খুলে বসেনা, অফিসের বস বা কলিগদের সামনে।
অর্নব মনে করে শরীর থাকলে টুকটাক অসুস্থতাও থাকবে।ওষুধের দোকান গুলো কেন আছে?
তেমন বুঝলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ওষুধ কিনে খেলেই হলো।এসব ছুটকোছাটকা শরীর খারাপ গুলো নিয়ে, ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে লোককে জানাবার কি দরকার সেটাই অর্নব বুঝে পায়না।
আর পরিবারটাও ওর একান্তই নিজের,তাই সেক্ষেত্রে সমস্যা আসলে তো আর বাইরের লোক সমাধানের রাস্তা দেখাতে আসবে না,নিজেকেই বুঝে মিটিয়ে নিতে হবে।তাই শুধু শুধু এসব জানিয়ে লোককে বিব্রত করবার কোনো অর্থই খুঁজে পায়না অর্নব।
সবার সাথেই সুন্দর সম্পর্ক অর্নবের।ওর বন্ধুসুলভ ব্যবহার আর মুখে লেগে থাকা হাসিটার কারনে অফিসের মতো জায়গাতেও কাঠি করবার মতো কেউ নেই।
অর্নবকে দেখলে কেউ বলবেনা ওর জীবনে কোনো সমস্যা আছে!
অবশ্য সমস্যাবিহীন মানুষ বোধহয় হয়না!প্রত্যেকের জীবনেই আলাদা রকম সমস্যা থাকে। সে অর্থে সুখী কেউই নয়।সবাই সুখী সাজার চেষ্টা করে।
অবশ্য অর্নবের অসুখী হওয়ার কথা ছিলোনা।করুনার মতো জীবন সঙ্গী তার, যে চাওয়ার আগেই সমস্ত প্রয়োজনের জিনিস হাতের কাছে হাজির করে।অর্নবের অসুখী হওয়ার একটাই কারন,’শিখা’।
মেয়েটা যতো বড়ো হচ্ছিলো,হাঁটতে চলতে পারছিলো,ততই যেন অসহ্য লাগছিলো অর্নবের।খালি পায়ে মেঝেতে হাঁটাও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো।লালা পরে চটচটে মেঝে,ভুল করে পা ফেলে দিলে ঘিন ঘিন করে উঠতো গা।
যদিও করুনা নির্বিকার।ওই মেয়েকেই আদর করছে,স্নান করাচ্ছে,খাওয়াচ্ছে,গান গেয়ে ঘুম পারাচ্ছে।এসবের ফাঁকে রান্নাবান্না,বারবার করে ঘর মোছা কোনো কিছুতেই ওর ক্লান্তি নেই।করুনার নিরলস চেষ্টায় রুমাল ব্যবহার শিখেছে মেয়েটা।তবুও মাঝে মাঝে এখানে ওখানে লালা ঝরে পরতো।
অর্নবের সুন্দর নিখুঁত জীবনে শিখা যেন একটা অভিশাপ। শিখাকে নিজেদের জীবনে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার মাঝে ভিতরে ভিতরে হাঁফিয়ে উঠছিলো অর্নব।সে কারনেই অফিসেই বেশিটা সময় কাটিয়ে ফিরতো।
রাতে আলাদা ঘরেই শুতো অর্নব।করুনা শিখাকে ঘুম পারিয়ে,সব কাজ সেরে একবার অর্নবের ঘরে আসতো।করুনা আসা অবধি অর্নব জেগেই থাকতো।করুনাকে উন্মুক্ত করে ওর ভিজে গাটা নিজের শরীরের সাথে লেপ্টে নিতো।
অনেক সময় করুনা ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো। শিখা পাশের ঘরে একা শুয়ে,জেগে উঠলে ভয় পেয়ে যাবে,এমনটাই আশঙ্কা থাকতো ওর।কিন্তু অর্নব ক্লান্ত না হলে করুনার ছাড় মিলতোনা।
এমনি ভাবেই আবারো প্রেগন্যান্ট হয়ে পরলো করুনা।ওই সময়টা অর্নব আবার আগের মতোই কেয়ারিং হাজব্যন্ড হয়ে গিয়েছিল ।খুব চেয়েছিলো একটা ছেলে হোক ওদের।কিন্তু মেয়ে হলো।
যদিও মেয়ে হুবাহু বাবার মতো ধবধবে ফর্সা,মুখের আদলটাও একেবারে বাবার মতোই।অর্নব মেয়ের চেহারা দেখে ছেলে না হওয়ার আফসোস ভুললো।
মেয়েটা ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছিলো,স্কুলে ভর্তির পরে অর্নব বাড়ি ফিরে নিজেই পড়াতে বসতো মেয়েকে।
মেয়েটাও ছিলো মেধাবী। অর্নব মেয়ের মধ্যে নিজেকে দেখতে পারতো।
অর্নব মা বাবার একমাত্র সন্তান ছিলো।সে কারনেই মাসির বাড়ি ছিলো ভীষণ পছন্দের।মাসির মেয়ে তিয়াশার থেকে রাখি পরা,ভাইফোঁটা নেওয়া,ওর যাবতীয় আবদার পূরণ করা সবেতেই ছিলো অর্নবের দারুন আগ্রহ।
ওখানেই করুনাকে দেখেছিলো অর্নব।
সুন্দরী বলা চলেনা,কিন্তু চেহারাটা ভারি মিষ্টি।
গানের গলাটাও দারুন।
মাসির বাড়ির ছাদে ঘরোয়া রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের দিন, মেয়েটা তানপুরা বাজিয়ে একের পর এক গান গেয়ে চলেছিলো চোখ বুজে।
অর্নবের প্রেমে পরা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা।
তারপর থেকে মাসির বাড়ি যাওয়াটা আরো বেড়ে গিয়েছিলো অর্নবের। তিয়াশাও চাইতো করুনা ওর বৌদি হোক।তাই তিয়াশার মধ্যস্থতায় ওদের প্রেমটা এগিয়েছিলো দ্রুত।
করুনা মেয়েটা যেন সবার চাইতে আলাদা।ওকে দেখলেই মনটা শান্তিতে জুড়িয়ে যেতো অর্নবের।
অর্নব যতোটা উচ্ছল,করুনা ততোটাই শান্ত।
আসলে বিপরীত মেরু সব সময়ই নিজেদেরকে আকর্ষণ করে।
তবে অর্নব সুযোগ করে মাসির বাড়িতে আসলেও, করুনা সব সময় দেখা করতে আসতে পারতোনা।ওর দাদা বৌদিরা আগলে রাখতো করুনাকে।
অতএব বাধ্য হয়েই অর্নব করুনাদের বাড়ির উল্টো দিকের চায়ের দোকানে বসে চা-সিগারেট খেতো আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো করুনাদের বাড়ির দিকে।করুনার দুই বৌদি ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিলো।দাদাদের দিয়ে থ্রেট দিয়েছিল।কিন্তু অর্নবের তাতে কিছুই যেতো আসতোনা।
করুনাকে না পেলে চিরকুমার হয়ে থাকবে,সেটাও আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছিলো করুনাকে।
তারপর গ্র্যাজুয়েশন এর পর প্রচন্ড চেষ্টায় চাকরিটা জুটিয়ে নেওয়ার পর নিজেই গিয়ে দাঁড়িয়েছিল করুনার বাবার সামনে।
কিন্তু করুনার বৌদিদের কল্যানে বাবা বা দাদারা কিছুতেই বিয়ে দিতে রাজি হননি অর্নবের সাথে।
অর্নবকে অবাক করে দিয়ে সেদিনই অর্নবের সাথে ঘর ছেড়েছিলো করুনা।
অর্নব করুনাকে কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে সিঁদুর পরিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো।
অর্নবের বাবা প্রথমে বাড়িতে ঢুকতে দিতে চাননি ওদের।অর্নবের মা বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর বাবাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছিলো ওদের বিয়েটা।
করুনাকে পেয়ে অর্নব যেন সব পেয়ে গেছির দেশে পৌঁছে গিয়েছিলো।ওর আর জীবন থেকে নতুন করে কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার ছিলোনা।
অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোন করে খবর নিতো করুনার।বাড়ি ফেরার সময় ওর পছন্দের গুলাব জামুন আনতেও ভুলতোনা।এসব দেখে অর্নবের মা ভীষণ খুশি ছিলেন।
কিন্তু বিপর্যয় আসতে দেরি হয়না।হঠাৎই ধরা পরে অর্নবের মায়ের লিভার ক্যান্সার।তাও শেষ স্টেজে গিয়ে।অনেক চেষ্টা করেও মাকে বাঁচাতে পারেনি অর্নব।
মায়ের মৃত্যুর পর অর্নবের বাবা একেবারেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন।খেতে পর্যন্ত চাইতেন না।করুনা জোর করেই ওর বাবাকে খাওয়াতো।
এরপর একদিন রাতে অর্নবের বাবার হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়।ঘুমের মধ্যেই সব শেষ। অর্নব অভিভাবকহীন হয়ে আরো আঁকড়ে ধরে করুনাকে।
এর দুবছরের মধ্যে শিখা আসে ওদের জীবনে,অর্নবের কথায় অভিশাপ হয়ে।(চলবে)