অশান্ত বসন্ত পর্ব-৪

0
1130

#অশান্ত বসন্ত
(চতুর্থ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
(#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)

**********************
রান্নাঘরের কাজগুলো সেরে ঘরে ঢুকে খাটের কিনারায় বসলো করুনা। খুব গরম পরেছে আজ। আঁচল দিয়ে নিজের কপাল আর ঘাড়ের ঘামটা মুছলো।

শিখাটা খোলা জানলার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে। লালা পরে পরে জামার বুকের কাছটা ভিজে গেছে। কিছু লালা মাটিতেও পরে আছে। করুনা বকতে গিয়েও বকেনা। সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

শিখা ঘাড় ঘুরিয়ে মাকে দেখে জড়িয়ে ধরে মাকে। বহ্নির থেকে আট বছরের বড়ো শিখা। তবু ওর জগৎ জুড়ে শুধু মা আর বোনু। বাইরের জগতের সাথে পরিচয় নেই মেয়েটার।

চারদিকে তাকিয়ে বহ্নিকে ঘরে দেখতে না পেয়ে অস্থির লাগে করুনার। শিখাকে জিজ্ঞেস করলে ইশারায় শিখা জানিয়ে দেয় বহ্নি বাইরে গেছে।

মেয়েটা কিছুদিন ধরে ঘুমোচ্ছেনা রাতে।
করুনা নিজের হাতের সোনা বাঁধানো নোয়াটার দিকে তাকালো।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

নোয়াটা অর্নবই কিনে দিয়েছিলো গড়িয়াহাটের সেনকোতে নিয়ে গিয়ে। বাড়ি ফিরবার পর অর্নবের মা কপালে চুমু খেয়ে পরিয়ে দিয়েছিলো নোয়াটা।

অর্নবের মা ক্যান্সারের পেশেন্ট ছিলো। ওদের বিয়ের একমাস কুড়িদিনের দিনের মাথায় মারা যান উনি। অতো যন্ত্রনার মধ্যেও করুনাকে সংসারের খুঁটিনাটি বোঝাতেন।

করুনার মাঝে মাঝে মনে হয় উনি বেঁচে থাকলে অর্নব হয়তো নতুন সংসার পাততে পারতো না। ছোটোবেলায় একবার মাকে হারিয়েছিলো আবার বিয়ের পর আর এক মাকে হারালো।

করুনা নিজের চোখ মুছে নিলো। এই নোয়াটাই এখন তার একমাত্র সম্বল। এটাই বেচে দিতে হবে। তাছাড়া মানুষটাই আর যখন তার নিজের নেই,তখন আদিখ্যেতা করে সধবার স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেরিয়ে কি হবে!

কিন্তু ভাবলেও নিজের হাতে খুলে ফেলতে পারলোনা।শত হলেও হিন্দু ঘরের বৌ,কোথায় যেন একটা সংস্কারে বাঁধছে, যদি কোনো অমঙ্গল ঘটে!আর সাথে থাকুক না থাকুক তার জীবনের প্রথম আর শেষ পুরুষ তো অর্নবই।

করুনা ভাবলো বিকেলে গিয়ে নোয়াটা বেচে দেবে। তবে বেচার আগে একটা শাখা-পলার দোকানে গিয়ে একটা প্লেন নোয়া কিনে নেবে। এই মুহূর্তে টাকাটা খুব প্রয়োজন।

বহ্নি যে কলেজ ভর্তির ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তায় আছে, মা হয়ে সেটা কি সে বুঝতে পারেনি নাকি! বহ্নির শুকনো মুখটাই যে সব বলে দেয়।কিন্তু মেয়েটা মুখে কিছু না দিয়ে এই রোদের ভিতর কোথায় যে গেলো!

সকালে উঠেই রান্নাঘরে ঢোকা করুনার বহুদিনের অভ্যাস। অর্নব খেতে ভালোবাসতো তাই বাজারটাও বরাবর গুছিয়েই করতো। কয়েকপদ না হলে মুখে রচতোনা। আগের দিন রাতেই সব্জি গুলো কেটে রেখে দিতো করুনা।

আজকাল রান্নাঘরের কাজ তেমন একটা থাকেনা।তবুও সকালেই নিয়ম করে রান্নাঘরে ঢোকে। কল পাড় থেকে বালতি করে জল এনে পুরো রান্নাঘর ধোওয়ায়।রাতের সব বাসন গুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেসিনেই মেজে নেয়।

আগে এতো কাজ করতে হোতোনা করুনাকে, ঠিকেঝি ছিলো।
অর্নব পছন্দ করতোনা করুনা বাসন মাজে। বলতো, ‘তোমার নরম হাত শক্ত হয়ে যাবে’। ঠিকেঝি না আসলে নিজেই বাসন ধুতে বসতো। কতো কতো স্মৃতি অর্নবকে ঘিরে।

তবে শিখার জন্মের পর থেকেই কেমন যেন বদলে যেতে থাকে অর্নব। শিখাকে তো একেবারেই পছন্দ করতোনা।লালা পরতো বলে ঘেন্না পেতো।বলতো,’এক সাথে খেতে না দিতে’।

শিখা যদিও নিজেই ভয় পেতো বাবাকে। বাবা ধারে কাছে থাকলে মায়ের আঁচলটা আঁকড়ে ধরে থাকতো।বাচ্চারাও বোঝে অবহেলার ভাষা।

তবে করুনা দ্বিতীয় বার প্রেগন্যান্ট হওয়া নিয়ে অর্নবের দারুন উৎসাহ ছিলো। বলতো,’দেখে নিও এবার আমাদের ছেলে হবে, আর অবশ্যই সুস্থ ছেলে হবে। লালা ঝরানো ছেলে নয়’।

অর্নবের কথার ধরনে কান্না পেতো করুনার। কোনো বাবা তার নিজের মেয়েকে এতো ঘেন্না পেতে পারে!

অবশেষে অর্নবের স্বপ্নকে মিথ্যা প্রমান করে বহ্নি আসলো। অর্নব যদিও বহ্নিকে বেশ পছন্দ করতো।বলতো,’আমার জীবন্ত ডল পুতুল’।আদর করে ডলি নামে ডাকতো। আর সেই ডলিকে ছেড়ে যেতেও বাঁধলোনা অর্নবের। একবার খোঁজ পর্যন্ত করেনা মেয়েদের।

করুনার কোথাও যাওয়ার নেই নাহলে অর্নবদের বাড়িতে পরে থাকতোনা। যদিও অর্নব ওদেরকে বাড়ি ছাড়তে বলেনি, বরং নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে ভাড়া বাড়িতে গিয়ে থাকে।

আজকাল করুনার ডাল,ভাত আর একটা সব্জি বানালেই কাজ শেষ । কোন কোনদিন ডিমের কারি বানায়। তবে শিখা গলা ভাত ছাড়া কিছুই খেতে পারেনা।করুনা ডিম বানালে কুসুমটা মিশিয়ে দেয় শিখার ভাতে। শিখার জন্য প্রেসারে আলুসিদ্ধ দিয়ে আলাদা ভাত বসিয়ে বেশ কয়েকটা সিটি দিয়ে নেয়।

এই মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় করুনার। এ মেয়ের ভবিষ্যৎ যে কি তা ভগবানই জানেন। এখন বহ্নিটাই তার একমাত্র ভরসা। মন বলে,’বহ্নি ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াবে আর শিখার অপারেশনটা করিয়ে দেবে’।

অর্নব বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আর গ্যাস ওভেনে রান্না করেনা করুনা। লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেই রেশনের কেরোসিন তেল তোলে,আর তা দিয়ে পুরনো জনতা স্টোভটা জ্বালিয়ে কাজ সেরে নেয়। ওই যত রকম ভাবে খরচ কমানো যায় আর কি!

শিখার চোখ দুটো চঞ্চল হয়ে উঠেছে, ব্যাপারটা খেয়াল করতেই দরজার দিকে তাকায় করুনা। ওই তো বহ্নি ঘরে ঢুকছে। ফর্সা মুখটা তেতে লাল হয়ে গেছে। গায়ের জামাটাও ঘামে ভিজে লেপটে গেছে গায়ে। ঘরে ঢুকে মাকে বললো,’স্নান করে আসছি’, করুনা বললো,’আগে জিরিয়ে নে।রোদ থেকে এলি, এখনি স্নান করলে শরীর খারাপ হবে’।

মায়ের কথায় বহ্নি মেঝেতে টান টান হয়ে শুয়ে পরলো।করুনা অস্থির হয়ে গেলো,’মেঝেতে কেন শুলি?’,এবার বহ্নি বললো,’কাল কলেজে ভর্তি হওয়ার লাস্ট ডেট। টাকা জোগাড় করতে গিয়েছিলাম টিউশন বাড়িগুলোয়।
ওরা কেউ এডভান্স দিতে রাজি হলোনা,
আমার আর কলেজে পড়া হবেনা মা’।

করুনা মেঝেতে বসে বহ্নির মাথাটা সস্নেহে কোলে তুলে নিলো। তারপর কপালে চুমু খেয়ে বললো,’তা কি হয় সোনা,পড়াটা যে কন্টিনিউ করতেই হবে তোকে,টাকার চিন্তা করতে হবেনা।আমি ঠিক ব্যবস্থা করে দেবো’,কাঁদতে কাঁদতে বহ্নি মায়ের কোলে মুখ গুজলো।

এদিকে সারা ফেসবুক তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও ওই মেয়েটিকে বের করতে পারলোনা পল্লব।
অবশ্য এইভাবে নাম না জেনে কাউকে খোঁজা যায় না সেটা পল্লব নিজেও জানে।কিন্তু মন যে মানতে চায়না।

পল্লব ঠিক করেছে আবার কাঁথি যাবে। যদি কোনো খবর জোগাড় করতে পারে মেয়েটার। কাল সকালেই হাওড়া থেকে বাস ধরবে কাঁথির। চাকরি চলে গেলে আবার জোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েটাকে খুঁজে না পেলে জীবনটাই বৃথা।
‘হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য,
জানি তুমি অনন্য,
আশার হাত বাড়াই’, তোলপাড় করছে গানের লাইনগুলো পল্লবের মনকে ।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here