অশান্ত বসন্ত পর্ব-৩

0
1147

#অশান্ত বসন্ত
(তৃতীয় পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
(#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)

**********************
বেলা হয়ে গেছে।তবুও বালিশটাকে আঁকড়ে পরে আছে বহ্নি। রান্নাঘর থেকে টুংটাং একটানা বাসনের আওয়াজ আসছে।
মাকে সাহায্য করবে ভেবেও উঠতে ইচ্ছে করছে না বহ্নির। দিদিয়াটা পাশে বসে লালা মুছে যাচ্ছে নিজের মতো।

শরীরটাও কেমন ম্যাজম্যাজ করছে বহ্নির।
আসলে ঘুমটাই সেভাবে আসছেনা আজকাল।
বিছানায় শুলেই রাজ্যের চিন্তা চলচ্চিত্রের মতো ভেসে ওঠে মনে।
আসলে মনের সঙ্গে শরীরের একটা বিশাল সম্পর্ক আছে। মন ফুরফুরে থাকলে শরীরটাও ঝরঝরে লাগে। সব কিছুতেই তখন দারুন এনার্জি।

‘আহা! জীবনটা যদি সিনেমার মতো হতো তাহলে বেশ ভালো হতো। আমিও সুন্দর ভাবে একের পর এক ধাপ উপরের দিকে উঠতে থাকতাম।
মা বলে,’প্রতিদিনই নাকি আলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটে এই সংসারে, আমাদের অবশ্বাসী মন সেটা মানতে চায়না, তবুও ঘটে’, এবার আমাদের জীবনেও তেমনই কিছু আলৌকিক ঘটনা ঘটুক এমনই চাইছে মন।

মা বলে,’ঈশ্বর তোমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে তোমায় সবচেয়ে ভালোটা করতে হবে’, এসব ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসে বহ্নি।
‘কি যে করবে!’দীর্ঘক্ষন ধরে ভেবেও এই সমস্যার কোনো সমাধান বের করতে পারছেনা। বর্তমানে ওর একটাই চিন্তা, ‘কি করে কলেজে ভর্তি হবে!

টাকার অভাবে মাত্র দুটো কলেজেরই ফর্ম তুলতে পেরেছিলো। খুব চাপ ছিলো নাম উঠবে কিনা! তবে ভগবানের কৃপায় রেজাল্ট ভালো হওয়াতে দুটো জায়গাতেই নাম উঠেছে ওর।কিন্তু ভর্তির টাকাটা যে কোথা থেকে আসবে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা। ভগবান যে কেন কিছু করছে না এই ব্যাপারটায়!

মাকে বললে মা চিন্তায় পরবে তাই মাকেও টাকা নিয়ে কিছুই জানায়নি বহ্নি।
ফর্মের টাকাটাও যে অনেক কষ্টে জোগাড় করে দিয়েছিলো মা।

অস্তিত্ব প্রমানের লড়াই করতে করতে মাঝেমাঝে বড্ড ক্লান্ত লাগে। তবু পরাজয়ের আখ্যান গাইতে হয়নি কখনো। কোনো না কোনো ভাবে প্রয়োজনটা ঠিকই মিটে গেছে। মিটে গেছে বললে ভুল বলা হবে আসলে প্রয়োজন গুলোই কমিয়ে ফেলেছে জীবনের থেকে। তবে কলেজে ভর্তির প্রয়োজনটা তো আর বাদ দেওয়া যায়না।

অস্থির লাগছে বহ্নির। কান্না পাচ্ছে প্রচন্ড।
তার কথা বলতে না পারা দিদিয়াটাও বোধহয় বুঝতে পেরেছে ওর মনে বয়ে যাওয়া ঝড়ের কথা। লালা মুছতে থাকা ভেজা হাতটা দিয়েই চেপে ধরেছে বহ্নির হাত। যেন ভরসা দিতে চাইছে।

দিদয়ার ভেজা হাতের ছোয়ায় হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পরে বহ্নি। মনের মধ্যে আলোড়ন চলছে,’কি করে আমি কলেজে ভর্তি হবো! কি করে চাকরি পাবো! কি করে তোর অপারেশন করাবো! কি করে নিজেদের বাড়ি বানাবো!’

দিদিয়ার হাতটা এবার বহ্নির পিঠের ওপর উঠে আসে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দিদিয়া, জল মুছে দিচ্ছে চোখের।হঠাৎই দিদিয়ার হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বহ্নি। আলনা থেকে ওড়নাটা নিয়ে,মাকে কিছু না জানিয়েই, দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে বেরিয়ে পরলো।

এই ভাবে তো ঘরে বসে থাকলে চলবেনা। একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। বেশ কয়েকজনকে টিউশন পড়ায়।যদি ওরা অন্তত দুমাসের টাকাটা ওকে অগ্রিম দিয়ে দেয় তাহলে হয়তো ভর্তিটা আটকাবে না।

কিন্তু তারপর? তারপর কি হবে? এই দুমাস তো তাহলে টাকা দিতে পারবে না মাকে।
সংসারের একটা খরচ যে বহ্নির টিউশনের টাকা থেকেই উঠে আসে। আজকাল মা তেমন অর্ডারও পায়না ব্লাউজের। আসলে কাজ জানা লোকের পরিমাণ বেশি আর কাজের পরিমান কম থাকলে যা হয় আর কি!তবুও দোকানে দোকানে ঘোরা আটকায়না মায়ের।
প্রতিদিন ঘরের কাজ সেরে নতুন উদ্দ্যোগ নিয়ে কাজ খুঁজতে বের হয় মা।

ওদিকে কাঁথি থেকে ফিরবার পর থেকে সারাদিন অফিসেই কেটে যাচ্ছে পল্লবের। কাজের চাপটা এতোটাই বেড়ে গেছে যে অনেক সময় বেশ রাত হয়ে যায় ফিরতে। ওর তুলনায় বাকিদের কাজের লোড অনেক কম। ঋতম বলে,’প্রথম দিকে বেশি কাজ দেখিয়ে ফেলেছিস বলেই বেশিরভাগ কাজই এখন তোর ঘাড়ে’।

বস বলেন,’আমাদের ব্যাঙ্গালোরের অফিসে তোমার মতোই একজন কাজ জানা লোক চাই,কবে যাবে বলো?আমরা তোমাকে ফ্ল্যাট,গাড়ি দুটোই প্রোভাইড করবো’,পল্লব বাহানা করে কাটিয়ে দেয়, ব্যাঙ্গালোরে যেতে চায়না কিছুতেই।

প্রতিদিনই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে একটু জিরিয়ে নিয়ে স্নান সারে পল্লব। তারপর ক্লান্ত শরীরটাকে নরম বিছানার ওপর ফেলতেই দু-চোখ জুড়ে ঘুম চলে আসে পল্লবের। তবুও ঘুমটাকে দুরে সরিয়ে সেই নাম না জানা মেয়েটার কথা ভাবে। মনে মনে ওর হাতে হাত রেখে গল্প করে। সারাদিনের ভালো খারাপ লাগা গুলোকে শেয়ার করে। সেখান থেকেই ভুল গুলোকে পাশে সরিয়ে রেখে নতুন দিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে।

এসবের ভিতরেই মা এসে দাঁড়ায় খাওয়ারের থালা হাতে। পল্লব শুয়ে শুয়েই বায়না করে খাইয়ে দেওয়ার জন্য। মা মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে বলেন,’তুই কি আর বড়ো হবিনা?’,মুখে এমন বললেও এক আশ্চর্য প্রশান্তি আর গর্বের ঝলক খেলা করে মায়ের মুখমন্ডল জুড়ে।

মা সারাদিন নিজের কাটানো সময়ের গল্প শোনাতে শোনাতে পল্লবের মুখে ভাতের দলা তুলে দিতে থাকেন।খাওয়ানোর পরে থালা রেখে নিজে হাত ধুয়ে আসেন। আর পল্লবকেও বেসিনে মুখ ধুয়ে আসতে বলে, ব্যস্ত হাতে বিছানার চাদর পাল্টে, মশারির দড়ি লাগাতে থাকেন। পল্লব পিছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,’আমার মায়ের মতো ভালো মা আর কোথাও পাওয়া যাবেনা’,মা হেসে বলেন,’মায়েরা এমনই হয়’।

মা লাইট নিভিয়ে চলে যাওয়ার পরেই পল্লব কোলবালিশটাকে আবার জড়িয়ে ধরে বুকে। চোখ দুটো বুজে মুখ ঘষতে থাকে কোলবালিশে। কোলবালিশটাকেই চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। মনে মনে বলে,’তুমি কোথায়?’

কিন্তু এভাবে একতরফা আর কতোদিন! ভিতরে ভিতরে অস্থির হতে থাকে পল্লব। যে মেয়েটাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখছে,তার নামটা পর্যন্ত জেনে আসতে পারেনি সে। মেয়েটা আবার তাকে ছেলেধরা বা ধর্ষক ভেবে প্রানপনে ছুটছিলো নিজেকে বাঁচাতে…
কথা গুলো মনে হতেই দম বন্ধ লাগে পল্লবের।কোলবালিশটাকে দুরে সরিয়ে মশারির বাইরে আসে।জানলার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়।

পল্লব ভাবে ফুলমানিকেই দেখাতে হতো মেয়েটাকে। দেখলে নিশ্চয়ই ফুলমানি মেয়েটার সাথে কথা বলে ওর নাম ঠিকানা সব জোগাড় করতে পারতো। তেমন হলে সম্বন্ধ করেই না হয় বিয়েটা হতো দুজনের। যদিও পল্লবের ইচ্ছে ছিলো ভবিষ্যৎ সঙ্গিনীর সাথে চুটিয়ে প্রেম করবে।

গঙ্গার ধারে হাত ধরে দুজনে ঘুরবে, গঙ্গার পারে বসে পা দোলাতে দোলাতে ঘাস ছিঁড়বে, বাদাম- ঝালমুড়ি চিবোবে।
পরন্ত বিকেলে ডুবন্ত সূর্যকে সাক্ষ্মী রেখে চুমু খাবে প্রেমিকার ঠোঁটে। উষ্ণ আলিঙ্গনে প্রেমিকার খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে নিজেদের নতুন জীবনের সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখবে, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ভিতের উপর গড়ে তুলবে পরম নির্ভরতার ঘর।

স্কুল-কলেজ জীবনে প্রচুর বান্ধবী ছিলো পল্লবের। কেউ কেউ তো পল্লবকে প্রপোজ ও করেছিলো। পল্লবের ওদের ভালো লাগতো কিন্তু ভালো লাগার তীব্রতাটা ততোটা ছিলোনা, যতোটা থাকলে কারো কথা আলাদা করে ভাবার ইচ্ছে হয়। ঋতম বলেছিলো, কাউকে ভালোবাসলে নাকি তার কথা শয়নে,স্বপনে,জাগরনে মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।

এতো ব্যস্ততার ভিতরেও সারাদিন মেয়েটা মনের বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একা হলে নিজে থেকেই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে।তারমানে পল্লব ও তবে প্রেমে পরলো।
মনে মনে বলে ওঠে,’ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি তোমায় অনামিকা’।

‘প্রেম কথাটাই ছোটো, অক্ষর তার দুটো/যেন একটি কোনো পাখির ঠোঁটে/ছোট্ট সে খড়কুটো’, পিউয়ের মিষ্টি গলায় গানটা অসাধারণ লাগছে পল্লবের।
পিউ ছাদে ঘুরতে ঘুরতে গানটা গাইছে। পল্লব গিয়ে বোনের পিছনে চুপটি করে এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ মাথায় আসলো,পিউ প্রেমে পরেনি তো!(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here