#অশান্ত বসন্ত
(দ্বিতীয় পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
(#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
**********************
‘মেয়েটা যে কেন ওইভাবে ছুটছে!বাঘ না ভালুক আমি!শুধু ক’টা কথাই তো জানার ছিলো’,কথা গুলো নিজের মনেই আওড়াল পল্লব।ভাবলো আর পিছনে গিয়ে কাজ নেই।আবার যখন এখানে আসবে তখন না হয় মেয়েটির সাথে কথা বলে জেনে নেবে।’ওই কোথায় থাকে?,কি পড়ে?,হবি কি?,কোনো লাভার আছে নাকি?,বিয়ের ব্যাপারে স্পেশাল কোনো চাহিদা আছে নাকি?,এসবই জানার ছিলো।
তবে কথা বলতে না পারায় মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো পল্লবের।কাল সকালেই তো আবার ফিরে যেতে হবে যাদবপুর। আবার যে কবে ছুটি নিয়ে আসতে পারবে নিজেও জানেনা।
আজকাল বেশ চাপ পরেছে অফিসে। ছুটি একদম পাওয়াই যায়না।তিন বছর হলো চাকরি পেয়েছে পল্লব।তবে বেড়াতে এসেও ল্যাপটপ তার সঙ্গী।কাজ তাকে করতেই হচ্ছে।তার ওপর এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে এসে প্রায় দুসপ্তাহ কাটিয়ে ফেললো।
নেহাত কাজের জায়গায় তার রেপুটেশন বেশ ভালো,আর ল্যাপটপেও কিছু কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। তাইতো হোয়াটসঅ্যাপে শুধুমাত্র ‘কাম সুন’,মেসেজ করেই ছেড়ে দিয়েছে বস রথীন্দ্র সিং।
বেশ কিছুদিন আগেই বন্ধুদের সাথে মন্দারমনি এসেছিলো পল্লব।বন্ধুরা দুদিনের ভিতরে বাড়ি ফিরে গেলেও পল্লব ফেরেনি।
ও কাঁথিতে এসেছে ফুলমানিদের সাথে দেখা করতে।মন্দারমনির থেকে কাঁথির দুরত্ব মাত্র একুশ কিলোমিটার।
মন্দারমনি পল্লবের দারুন পছন্দের জায়গা।কতো বার যে এসেছে তার ঠিক নেই।সমুদ্রের গর্জন,সমুদ্র সৈকতে লাল কাঁকড়াদের দাপাদাপি, ওদের পিছনে ধাওয়া করা এগুলো পল্লবের দারুন পছন্দের।তবে মন্দারমনি আসলে প্রতিবারই ফুলমানিদের সাথে দেখা করে ফিরতে হয়।নাহলে মায়ের গাল ফুলে যায়।
এই প্রথমবার ফুলমানিদের বাড়িতে এসে টানা কয়েকদিন ধরে থেকে গেলো পল্লব। আসলে পরন্ত বিকেলে ব্যালকনিতে বসে,চায়ের চুমুকের সাথে হঠাৎই খেয়াল করে,কমলা পাড় সাদা শাড়ি পরে,কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দুবেনী ঝুলিয়ে ভীষণ সুন্দর একটা মেয়ে ফুলমানিদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে।
পল্লবের প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গিয়েছিলো মেয়েটিকে।তারপরের দিন থেকে রোজই অপেক্ষা করে থেকেছে মেয়েটার জন্য।আর মেয়েটিকে দেখা মাত্রই আড়াল থেকে ফলোও করেছে।মেয়েটি ফুলমানিদের বাড়ি ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আলো-আঁধারিতে মিশে যায়।পল্লব লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেও ওর পিছন পিছন যায়।একটা ভালো লাগা ছেয়ে যায় মেয়েটিকে দেখলেই।
গতকাল রাতে ভেবেছিলো,ফিরে যাওয়ার আগে মেয়েটার সাথে একবার অন্তত কথা বলবে। কিন্তু মেয়েটা যে কেন ভয় পেলো ওকে!
‘কিরে পল্লব খেতে ডাকছি তো, সেই কখন ছাদে গেছিস।এতোক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে কি করছিস?’,ফুলমানির ডাক কানে যেতেই পল্লব চেঁচিয়ে সারা দিলো,’আসছি ফুলমানি’।
চুপচাপ খাওয়াদাওয়া সেরে দোতলায় এসে ব্যাগ গোছাতে বসলো পল্লব।মনটা ভীষণ রকম খারাপ লাগছে।নামটা ও তো জানা হলোনা মেয়েটার।বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপ চাপ কষ্ট হচ্ছে পল্লবের।চোখের কোনটা জ্বালা জ্বালা করছে।
‘আচ্ছা একে কি ভালোবাসা বলে?এভাবে কি কাউকে ভালোবাসা যায়?’,নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো পল্লব।
ঠিক করে নিলো, সকালে যাওয়ার আগে একবার বের হয়ে ওই কাঁচা রাস্তাটা ঘুরে আসবে,যদি মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে যায়!
কেমন অদ্ভুত ভাবে একা একাই একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে পল্লব।গমগমে গলায় গেয়ে উঠলো,’তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা,তুমি আমারো নিভৃত সাধনা’।
পল্লবের মা গানটা বেশ ভালোই গায়।মায়ের গান শুনে শুনে পল্লবের ও বেশ কিছু গানের কথা ও সুর প্রায় মুখস্থ।পল্লবরা এক ভাই এক বোন।পল্লবের বোনের নাম পিউ।ভারি মিষ্টি গানের গলা পিউয়ের।পল্লব খুব ভালোবাসে বোনকে।
তবে আজকাল পিউ কেমন যেন একটা বদলে যাচ্ছে।কথাবার্তায় মোটেও আর মিষ্টতা নেই।এমনকি ছোটো বড়ো জ্ঞানটাও গেছে,যখন যা মুখে আসছে বলে দিচ্ছে।মায়ের শাসনেও কোনো লাভ হচ্ছেনা।মাকেও আজকাল ঝাঁঝিয়ে উত্তর দেয়।
“আঠেরো বছর বয়স কি দুঃসহ /স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি”,কবিতাটা মনে পরে গেলো পল্লবের।একা একাই হেসে ফেললো।সময় করে পিউটাকে নিয়ে বসতে হবে,ওর সমস্যা কি সেটা জানতে হবে,মনে মনে ঠিক করে নিলো পল্লব।
পল্লব ভাবে,এই মেয়েটিও পিউয়ের বয়েসীই হবে,কিন্তু কতো ম্যাচিওর।চোখ দুটোতে দীঘির গভীরতা,একবার দেখলে আর ভোলবার উপায় নেই।মনের মধ্যে ঘর করে নিয়েছে মেয়েটা।
নানান এলোমেলো ভাবনায় চোখে ঘুম আসছে না পল্লবের।তবে ঘুরে ফিরে সেই নাম না জানা মিষ্টি মেয়েটিই তার সমস্ত চিন্তা ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে মনটাকে আরো ভাবালু করে তুলছে।
সেলাই করতে করতে মা বলে উঠলো, ‘কিরে বহ্নি আজ পড়ছিস না যে।এতো ভয় পেলে হয়।ছুটে ছুটে বাড়ি ফিরলি,কেউ একজন ধাওয়া করেছে বলে।সাথে সাথেই রাস্তায় বের হোলাম।কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না,আরে এতো ভয় পেলে কি চলে মা?রুখে দাঁড়াতে হতো যে’,মুখে এসব কথা বললেও মনে মনে নিজেই বেশ ভয় পেয়েছে করুনা।
ভগবানকে শত সহস্র কোটি প্রনাম যে মেয়েটার কিছু হয়নি।আজ বহ্নির কান্না দেখে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিলো করুনার।কিছু যদি খারাপ হতো মেয়েটার সাথে!মানুষের বেশে মুখোশ পরা হায়নারা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে।তার ওপর বহ্নির যা রূপ।বুকটা কেঁপে উঠলো অজানা শঙ্কায়।
‘বহ্নি আজ আর পড়বার দরকার নেই,যা ঘুমিয়ে পর গিয়ে।আর কয়েকদিন আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই’,মায়ের কথায় বহ্নি বলে উঠলো,’তুমি ভয় পেয়োনা মা,এবার থেকে আমি আর শর্টকাট ধরে স্কুল যাবোনা,মেইন রোড ধরেই যাবো।তাছাড়া স্কুলে না গেলে পড়া কি করে তৈরি করবো?আমার তো আর সব বই নেই,লাইব্রেরি গিয়ে বই ঘেটে নোটস বানাতে হয় যে’।
করুনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেশিন চালিয়ে সেলাই করতে লাগলো।সত্যিই কি সুন্দর সাজানো গোছানো সংসার ছিলো তার।কোনো কিছুরই অভাব ছিলোনা।লোকটা যে ওকে ছেড়ে,মেয়েদের ছেড়ে এইভাবে নতুন সংসার পেতে বসবে,সে কথা কি কখনো ভেবেছিলো আগে!সত্যি এই পৃথিবীতে সব আছে,নেই শুধু সত্যিকারের ভালোবাসা।নাহলে ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছিলো অর্নবকে।
বাবা দাদারা বলে দিয়েছিলো,ওই ছেলেকে বিয়ে করলে আর বাড়ি মুখো না হতে।এখন অবাক লাগে করুনার।কি করে যে সবাইকে ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে অর্নবের হাত ধরলো নিজেও জানেনা।দুই ভাইয়ের এক বোন ছিলো করুনা।ওদের মা ছোটোবেলাতেই মারা যায়।বাবা ভাইদের চোখের মনি পরে দাদাদের বিয়ের পর বৌদিরাও আগলে রাখতো ওকে।
অর্নবের সাথে দেখা হয়েছিলো তিয়াশাদের বাড়িতে গিয়ে।তিয়াশার মাস্তত দাদা ছিলো অর্নব।প্রথম প্রথম দু একটা কথা হতো,তারপর কিভাবে যেন দুটো মন মিলেমিশে এক হয়ে গেলো।
অর্নব সবসময় বলতো,’তুমি আমায় বিয়ে না করলে চিরকুমার হয়ে থাকবো’।অথচ ওকে বিয়ে করেও সাধ মেটেনি লোকটার।আবার বিয়ে করে সংসারী হয়েছে।
বুকটা মুচড়ে ওঠে করুনার।চোখ দিয়ে আজ আবার অঝোরে জল পরে যাচ্ছে।মন থেকে আকুল হয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে বললো,’ তুমি শুধু আমার মেয়েদের রক্ষা করো,আমি আর কিচ্ছু চাইনা তোমার কাছে,কিচ্ছুটি না’।
(চলবে)