তোকে ঘিরে♥পর্ব-৩২

0
2003

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_৩২
#ফাবিয়াহ্_মমো?

জানালা গলে বৃষ্টির অদম্য ছাটঁ প্রবেশ করছে রুমে। মৌসুমী বৃষ্টির সাথে মৌমৌ বাতাসের আলিঙ্গনে শীতলতার দারুণ এক পরিবেশ উদ্ভব হয়েছে চারপাশে। পূর্ব স্থবির দৃষ্টিতে পলকহীন চোখে পূর্ণতার দিকে কতটুকু সময় ব্যয় করেছে তা অনুমান করা কঠিন। পূর্ণতার চোখে দূর্বলতার ক্লেশ নেই! এ যেন অন্যরূপী কঠিনচিত্তের পূর্ণতা! এমন মানবীকে দেখে পূর্বের বুক ফুলে যেন গর্বের উচ্ছাস উন্মোচিত হচ্ছে। পূর্ব নিজের আত্মগর্ব ভেতরে চেপে বাহু দুদিকে প্রসার করে ইশারা করে ‘কাছে আসতে’। এ কাছে আসাটা যেন নিছক আসা নয় একেবারে বুকের মধ্যখানে লুকিয়ে রাখার যাতনা। পূর্ব উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে প্রসারিত বাহুদ্বয় আরো খানিকটা প্রসার করতেই এবার দ্রুতগতিতে মাথা ঝাঁকিয়ে কাছে আসতে বলে। মুখ ফুটে শব্দ বেরুচ্ছে না, বলতে পারছেনা ‘ কাছে আসো পাগলী মেয়ে! আমার বুকটায় দহনের প্রলয় হচ্ছে! তুমি মাথা রেখে শান্তি দাও এতে!’ পূর্ণতার চোখে বীরাঙ্গনার মতো কাঠিন্য বিরাজ করলেও আচমকা এরূপ প্রকাশ্য আবেগ দেখে শূণ্য চিন্তায় ঝাঁপিয়ে পরে পূর্বের প্রসারণক্ষম বাহুর দূরত্বে। দুধারে মেলে ধরা বাহুদ্বয় এবার বুকের উপর আছড়ে পরা মানুষটাকে আকড়ে ধরে। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজের সাথে ঠান্ডা শীতল বাতাসের অদ্ভুত কলহাস্য যেন কারো কান্নাধ্বনি পেয়ে ব্যাপক তেজী হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি তার বীভৎস লীলায় ঝড়ের তান্ডব শুরু করেছে। গাছপালা টিনের চালে আছড়ে পরছে, ধুমধাম বিকট শব্দ হচ্ছে, কোথাও যেন মানব মনে প্রকৃতির অপ্রকৃতিস্থ আচরণে বেশ ভয় ঠেকাচ্ছে।

পূর্ণতার হু হু করে ফোপানো কান্নার অশ্রুপাত জানান দিচ্ছে এতোক্ষন সে যথেষ্ট কষ্ট লুকিয়ে কথাগুলো বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলো। কিন্তু পূর্বের খোলা আচরণ যতবার প্রকাশ হয়েছে ততবার সে নিজেকে সপেছে তন্মধ্যে। পূর্ব টিনের দেয়ালে পিঠ হেলিয়ে পূর্ণতাকে বুকের মধ্যে বাহুর আড়ালে লুকানোর সুক্ষ চেষ্টায় আছে। ঠিক কোথায় রাখলে পূর্ণতাকে নিজের মধ্যে আগলে রাখা হবে? সাহিত্যিক ভাষায় ‘বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা’ দ্বারা যেটা বোঝায় সেটা কিভাবে ফলাবে পূর্ব? আপাতত জানা নেই। নিজের বুকের দিকে মাথাটা নুয়ে এলোমেলো চুলের পূর্ণতাকে একধ্যানে দেখতে থাকে সে। চুলের উপর নাক এনে ঘ্রাণের সুভাষ টেনে পূর্ণতার মুখ তুলে দেখে, চোখের অশ্রুধারা এখনো টলমল করছে। পূর্ণতা তার মায়াময় অশ্রুপূর্ণ ছোখ তুলে তাকালে পূর্ব গালে হাত রেখে ঠোঁটের ভাজে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। চোখভর্তি পানির পসরা টপটপ করে গাল বেয়ে যেন কারোর বুকে উপর পরে। এলোমেলো চুলগুলোতে আঙুলের চিরুনি দ্বারা মাথার মাঝখানে সিঁথি উঠে। পিঠের উপর চুলের বাহার ছড়িয়ে ঠোঁটজোড়া ছেড়ে দিয়ে পূর্ব শ্রান্তচিত্তে জোরে নিশ্বাস ছাড়ে। পূর্বের দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে চোখের শেষ পানিটুকু আশ্রয় নেয় পূর্ণতার। তার গর্তময় আর্কষিত থুতনিতে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ বসিয়ে বলে উঠে পূর্ব,

– ঘটনাটা কোনোভাবে স্কিপ করা যায় না?ভুলে যাও কি হয়েছিলো। ভুলে যাও সেদিন আমিও এ বাড়িতে ছিলাম। আমার চাওয়াটা কি খুব অসম্ভব?
পূর্ণতা কিছু বলেনা। টলটল চোখে এখনো তাকিয়ে আছে।

– নামটা জানলে তুমি খুব কষ্ট পাবে পূর্ণ। আগেও বলেছি তোমার উপর সামান্য আঁচড় পরলে আমি শেষ। এই নামটা বললে তুমি যে কি করবে তা ভাবলে…

পূর্বের বুক ঠেলে হতাশার ভারি নিশ্বাস যেন ছিটকে আসে। আচ্ছা নামটা কি খুবই কাছের? কাছের মানুষের আঘাতগুলো যে কতটা ক্ষতবীক্ষত, চূর্ণবিচূর্ণ, ছিন্নভিন্ন করে দেয় তা যদি ওই মানুষটা জানতো? একটাবার জানতো কতটা দুঃখ হয় মনে, দগ্ধ হয়ে বুকে, জমাটবদ্ধ হয়ে আসে নিশ্বাস। তার সাথে কাটানো সুন্দর স্মৃতিগুলো একনিমিষে পায়ের তলায় মাড়িয়ে যায়, হারিয়ে যায়, বিলিন হয়ে যায় আজীবনের জন্য। চোখে দিয়ে যায় পানি হৃদয়ে রেখে যায় অসহনীয় কষ্ট। নোংরামি করা মেয়েটার কথা মোটেও বলতে সাহস পায়না পূর্ব। ঠিক কতটা কাছের মানুষ হলে পূর্বের মতো অ-মুখ মানুষও এমন অপ্রকৃতিস্থ ভাবে হাঁসফাঁস করতে থাকে? পূর্ব জানালাটা বন্ধ করে দেয়।বৃষ্টির পানি ঢুকে পূর্ণতার ব্লাউজের হাতা ভিজিয়ে দিয়েছে বেশ। পূর্ণতা তার উত্তরের হদিশ না পেলেও এইমুর্হূতে শীতল পরিবেশে পূর্বের উষ্ণ বুকে মাথা রেখে অদ্ভুত শান্তি অনুভব হচ্ছে ওর। পূর্ণতার চুলের ভেতরে হাত ডুবিয়ে ওর গালে হাত রেখে গাম্ভীর্য আভায় বলে উঠে পূর্ব,

– তোমাকে আমি ঠিক কবে দেখি? প্রথম দর্শন কোথায় হয়েছিলো মনে আছে? তোমার শাড়িটা একটু আধটু ছেড়া ছিলো আমি গায়ের একছত্র পোশাক খুলে তোমাকে ঢেকে দেই। তখন কিন্তু তোমার প্রতি কোনোকিছুই আমার ছিলো না। অন্য দশটা নরমাল মেয়ের মতোই তোমাকে দেখেছি। তোমার সাথে খুব অসভ্য কাজ করতে পারতাম, তোমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে বহুবার বেখেয়ালে ছোঁয়াও কিন্তু ব্যাপার ছিলো না আমার জন্য। তুমি কি করে আমার নিয়মতান্ত্রিক জীবনে আগমন করলে আমি সেদিন বুঝতে পারিনি। শুধু এইটুকু আমার খেয়াল আছে, তুমি আমার এই হাতদুটোর উপর ঘুমিয়েছো। হাতদুটোয় আবদ্ধ করে তোমাকে নিজের শরীরের উষ্ণতায় সুস্থ করার চেষ্টা করেছি। বুকের ঠিক এই জায়গাটায় তুমি বালিশের মতো তোমার মাথাটা রাখতে আমি আজও সে স্মৃতি ভুলিনি। যেখানে আমার অনুমতি ছাড়া কেউ আমার রুমালটা পযর্ন্ত টাচ করতো না সেখানে তুমি আমার বুকের ভেতর স্পর্শ করেছো। তোমাকে বিশ্বাস না করলে আমার কাছে থাকার সুযোগ দিতাম? থাপ্পড় মেরে তোমাকে অপমান করতাম যেমনটা অন্য মেয়েদের এতোদিন করেছি। আয়মান সেদিন কলে যখন বললো তুমি রাজিবের কাছে ভিক্টিম হয়েছো শুনেই আমার ভেতরে যে কেমন পরিস্থিতি হয়েছিলো ভাবলেই গায়ের চামড়া এখনো দাড়িয়ে উঠে। জীবনে প্রথমবার ‘কি করবো?’ — প্রশ্নটা ভেবে আমি বাজেভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরি। এখনো বাথরুমের সেই ‘তুমি’কে মনে পরলে আমার হুলস্থুল অবস্থা হয়ে যায়। যদি তোমাকে বিশ্বাস না করতাম তবে আমার মতো মানুষ কখনো তোমার সান্নিধ্যের জন্য মরিয়া হতো না। পলিটিক্সের জন্য না অন্যকিছুর জন্য জানিনা তবে মেয়েদের কাছ থেকে রিজেকশন কখনো পেয়েছি বলে মনেহয়না। আমি স্বল্পভাষী মানুষ। তুমি একমাত্র কারণ যার জন্য আমি এতো কথা বলতে ও জানাতে আগ্রহ খুঁজে পাই। এতোকিছু জানানোর একটাই মোটিভ ছিলো পূর্ণতা! প্লিজ আমার কাছ থেকে নামটা জানার জন্য আর ফোর্স করো না।

অতঃপর পূর্বের লম্বা বক্তব্যের আড়ালে আসল কারনটা বুঝতে পারলো পূর্ণতা। পূর্ব কোনোভাবেই যে নামটি উচ্চারণ করবেনা তা স্পষ্টাকারে ফের বোঝা যাচ্ছে। পূর্ণতা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– তুমি ভাবছো নামটা জানলে আমি ভেঙ্গে পরবো?
– ভাবছিনা। গ্যারান্টি দিচ্ছি।
– তুমি বলবেনা তাইতো?
– যদি নামটা বলার মতো হতো তোমার জানার আগেই আমি তার অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতাম।

হঠাৎ রুমের কাঠদরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই পূর্ব দরজার দিকে তাকায়। পূর্ণতাকে ছেড়ে দিলে পূর্ণতা বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতেই আয়মান বাইরে দাড়িয়ে বলে,

– দোস্ত একটু দরকার। আসবি?

পূর্ণতা বিহ্বল দৃষ্টিতে মাথা ঘুরিয়ে পূর্বের তীক্ষ্ণদৃষ্টির দিকে তাকায়। পূর্ব নিশ্চয়ই সন্দেহ করছে। আয়মানের সাথে মিলে যে ও আসল ঘটনার জরিপে জড়িয়েছে তা আঁচ হয়তো করেছে। পূর্ব পরিস্থিতি ঠান্ডা রেখে চোখ দিয়ে ইশারা করলে পূর্ণতা দরজা চাপিয়ে চলে যায়। পূর্ব বালিশে মাথা রেখে জানালাটা খুলে বৃষ্টির পবিত্র কণায় ডুব দেয়। আজ তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। কেন যেন শান্তির ঘুম হবে এমন বাদলা দিনে, টিনের ঘরে, আধো অন্ধকারে।
.
ধোয়া উঠা গরম কাপে চোখ বন্ধ করে তৃপ্তির চুমুক! আহ্, কি দারুণ অনুভূতি! বজ্রপাতের তালে তালে বৃষ্টির দিনে গরম চা ও ভুনা খিচুড়ি অমৃতের মতো স্বাদ লাগে! যেনো বেহেস্তি পসরা হুট করে এমন বাদলা দিনে আসমান থেকে নেমে এসেছে! রান্নাঘরে মাটির চুলোয় বড় হাড়িতে খিচুড়ি রান্নার ঘ্রাণ পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পরেছে। সবাই যার যার প্লেট হাতে নিয়ে পূর্বপ্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। আনিশার মা সাজেদা ও পূর্ণতার মা খোদেজা দাওয়ায় বটি পেতে লেবু, শসা, পেঁয়াজ কাটছে। পূর্ণতার মামী দিলরুবা হাফ প্লেটের উপর কাটাকুটির জিনিস সুন্দর করে সাজাচ্ছে। একপাশে গোল করে কাটা শসা, এরপর লম্বা ফালি করে কাটা লেবু, এরপর স্থান পেয়েছে দেশী পেঁয়াজের টুকরা। তানিয়া উঠোনের কলপাড় থেকে কি যেনো ধুয়ে এনে দিলরুবার পাশে প্লেটে কিছু রাখলো। দিলরুবা চোখ ঘুরিয়ে তানিয়ার চন্ঞ্চলীভাব দেখে বিরক্ত হলেও তা যথাসাধ্য ভেতরে চেপে বলে উঠলো,
– মরিচ আনতে গেলি কেন? খিচুড়িতে মরিচ দিছে না?
তানিয়া মাথার উপর থেকে বৃষ্টির প্রলেপ ঝাট দিতেই বললো,
– আনাম মরিচ খাওয়ার স্বাদ আছে গো টুসটুসী মামী! খিচুড়ির লোকমায় মরিচ কামড় দিলে যে ঝাঁজটা লাগে উফ!

দিলরুবার মুখের অবস্থা এমন হলো যে এই অকালপক্কের সাথে কথা বলে নিজের রুচি বাধানোর কোনো শখ নেই। সে প্লেট নিয়ে খাওয়ার ঘরে চলে গেলো। তানিয়া হাত এগিয়ে টিনের চাল ধুয়ে পরা ঝর্ণার মতো বৃষ্টির পানি মুঠোতে পুড়ছে। আয়মান পূর্ণতাকে নিয়ে রুমের দরজা আটকিয়ে দুটো চেয়ার টেনে বসে পরে। সাগ্রতের বেলায় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো। মাথার চুলগুলো ভিজে খাড়া খাড়া হয়ে আছে, গায়ের পোশাক পাল্টে নেভি ব্লু শার্ট ও ব্ল্যাক প্যান্ট পড়নে। একহাতে হাতে ধোয়া উঠা তপ্তকর কফির মগ, থেমে থেমে তাতে চুমুক দিচ্ছে। অপরহাতে মোবাইল, যা ক্ষনে ক্ষনে কিছু টাইপ করছে।

– আই উইল কিল ইউ!
সাগ্রত মেসেজ দেখে মুচকি হাসে রিপ্লায় করে,
– আই উইল কিস ইউ। ওয়েট ফর দ্যাট। আমি আসছি তো। দেখো কি করি।
– কি?মানে? আপনি না এক সপ্তাহের জন্য গিয়েছেন?
– কাজ যদি একদিনে শেষ হয় তো সমস্যা কি? এসে তোমাকে বাজাচ্ছি। ওয়েট

সাগ্রতের অন্যমনস্কের হাসি ও ফোনের বিপরীতে টাইপিং দুটো পূর্ণতার কাছে উদ্ভট লাগছে। আয়মান পূর্ণতার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জবাব রেখে বলে উঠে,
– ভাবির সাথে চলে বুঝোস না? স্নেহা ভাবি কিন্তু জোশ দেখতে! দেখবি ভাবিরে?
– হারামি! আমি এখানে ভাবি দেখতে আসছি?

হঠাৎ সাগ্রত কফিতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলে উঠে,

– আমার কান সজাগ, সরি। সবকিছু শুনে ফেলেছি। আয়মান? তোমার ভাবিটা বুঝছো একা থাকে। বিশাল ফ্ল্যাটে এখন তার মন বসছেনা তাই কাজের টাইমে টেক্সট করেছে।
– ভাবি একা থাকে মানে? আপনার বাবা মা?
– নেই। পরপারে টপকে গেছে। স্নেহা ও অনাগত একজন ছাড়া বর্তমানে আমার কেউ নেই।
– অনাগত? ভাবী কি প্রেগনেন্ট ভাইয়া?

সাগ্রত সহজসাধ্য হাসিতে বলে উঠে,
– হ্যাঁ। সেভেন্থ মান্থ রানিং।

পূর্ণতা খবরটা শুনে এতো খুশি হলো যেনো নিজের মা হওয়ার সংবাদ শুনেছে। পূর্ণতা চট করে আয়মানের গালে থাপ্পড় মেরে দিলো। আয়মান যেন আকাশ থেকে ধপাস করে পরলো! পূর্ণতা ওকে মারলো কেন? এই খুশির সংবাদের চড় দিলো কি বুঝে? পরক্ষনে পূর্ণতা তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
– দেখ হাঁদা! তাড়াতাড়ি কর! তোর পোনাপুনি গুলোর সাথে আমার গুলো বিয়ে দিবো বুঝলি? তোর মেয়েকে তুলে এনে আমার ওয়াসিফ বাড়ির বউ বানাবো। বল বিয়ে করবিনা?

আয়মান গালে হাত দিয়ে ভিনগ্রহী প্রাণীর মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আছে! পূর্ণতার কি মাথায় সিট আছে নাকি? আয়মান বোকা দৃষ্টিতেই বলে উঠে,
– বইন তুই ঠিক আছোস? ভাদ্র মাসের পাগলা কুত্তা কামড় দিছে? যদি কামড়ানি খাস তো চল, তোরে দুটা টিটেনাস দিয়াই আনি।
সাগ্রত খিলখিল করে হাসতে থাকে। এই দুজনের কর্মকাণ্ডে রীতিমতো পেটের ভেতর হাসিতে ঝড় উঠে যাচ্ছে। বহু চেষ্টায় হাসি আটকে সাগ্রত বলে উঠলো,
– তোমরা দুজন কি ছোট্টকালের বন্ধু?
আয়মান ফট করে বলে উঠে,
– না ভাই। নেংটাকালের বন্ধু। আমি, পূর্ণতা, শ্রেয়া জন্মের পর থেকেই একে অপরকে চিনি।
– ওহ্ মাই গড! এতো পুরোনো সম্পর্ক টিকে কি করে?

হঠাৎ হাস্যোজ্জ্বল মুখ দুটো কালো আধারে মিইয়ে গেলো। নামের তালিকায় যে আরো একজন অন্তর্ভুক্ত ছিলো তার নাম নেওয়াও এখন হারাম। পূর্ণতা মাথা নিচু করে ফ্লোরে পায়ের নখ খোচাচ্ছে। আয়মান ভারাক্রান্ত মুখে একটুকরো হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

– আমরা চার বন্ধু ছিলাম। আমি, শ্রেয়া, পূর্ণতা, রাজিব। আমি অবশ্য সবার থেকে আটমাসের বড়। আমরা চার পরিবার বিল্ডিংয়ের একই ইউনিটের চারটা ফ্ল্যাটে থাকতাম। বন্ধু, সহপাঠী, ভাইবোনের মতোই একে অন্যকে দেখে বড় হয়েছি। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতেও আল্লাহর রহমতে আমরা একসাথেই ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ্ হয়তো ভালোর জন্যই আমাদের এক বন্ধুকে আড়াল করে দিলো। রাজিব খুব বড় ধরনের একটা খারাপ কাজ করলো। এরপর থেকে ও আমাদের সাথে নেই।
– তোমাদের পরিবার খুব ঘনিষ্ঠ?
– হ্যাঁ। যদি পূর্ণতা বা শ্রেয়া আমাদের বাসায় থাকতে চাইতো কখনো ‘না’ শব্দ উচ্চারণ করতো না। এতোটাই বিশ্বাস আর ভরসা করে আমাদের সবার পরিবার।
– মনে কিছু না করলে একটা কথা বলবো। আমি মানি যে, বেস্টফ্রেন্ড জিনিসটা বিপরীত ধর্মী ছেলেমেয়ের জন্য না। একসময় না একসময় তারা প্রেমে পরে। তোমাদের মধ্যে এমন হয়নি?
– আমাদের মধ্যে এমন হয়নি। রাজিবের বেলায় যেটা ছিলো ওটা ছ্যাঁচড়ামি।

সাগ্রত এবার পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলে,
– মিসেস পূর্ণতা? আপনার সামনে আয়মানের মতো সুন্দর একটা ছেলে ঘুরঘুর করতো, কখনো ফিল কাজ করতো না? ওকে দেখে তো আমারই মাথা ঘুরে গেছিলো।

শেষের কথাটা সাগ্রতের জন্য সত্য না হলেও মেয়েদের জন্য সত্য। আয়মানের চওড়া বুকের শেপের দিকে একবার হলেও রাস্তায় হাঁটা মেয়েদের সরু নজর পরবে। প্রাণখোলা হাসির দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুড়বে হয়তোবা দৃষ্টিগোচরে কেউ সেই হাসির প্রেমেও পরে যেতে পারে। সুন্দর দেখতে আয়মান বন্ধুটা কখনো ভাইব্রাদার বা জিগারের দোস্ত ছাড়া পূর্ণতার জীবনে তেমন বেশি কিছু ছিলোনা। পূর্ণতা হেসে বলে,

– এই হারামিটা এতো সুন্দর দেখেই তো আমি ওর মেয়েকে আমার বাড়ির বউ বানাতে চাই। ও যদি ছেলে হয়ে দেখতে এতো লাজাবাব হয় তাহলে ভাবুন বাপকা বেটি কতো প্রিটি হবে?

আয়মান লজ্জাজনক হাসি দিয়ে বলে উঠে,
– তোর বাড়িতে মেয়ে পাঠায়া আমি দেদারসে তোর পোলার সাথে উইস্কি খামু। তোর জামাইরে বলবি একটা বার সেকশন খুলতে।

খিলখিল হাসিতে মেটে উঠে আয়মানের ঘর। সাগ্রত, পূর্ণতা ও আয়মানের হাস্য কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে বৃষ্টিময় পরিবেশ। কিন্তু পরবর্তীতে এই হাসিগুলো কি মিলিয়ে যাবে? ‘বেশি হাসলে কাঁদতে হয়’ — প্রবাদের মতো সত্য হবে? সাগ্রত চাপা ব্যথায় ব্যথিত হয়। কি মধুর সম্পর্ক ওদের মধ্যে! কি বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসা বিরাজ করে তিনজনের বন্ধুত্বে! কিন্তু নামটা জানার পর কি হবে এ দুজনের? হাসিগুলো কোথায় নিরুদ্দেশ হবে? ফিরে কি আর আসবেনা? সাগ্রত হুট করে মুখের হাস্য লালিমা হ্রাস করে পূর্ণতার হাসিখুশি চেহারায় তাকিয়ে থাকে। পূর্ণতা হঠাৎ সাগ্রতের দৃষ্টি দেখে বলে উঠে,

– কিছু বলবেন ভাইয়া?
– বলার অনেক কিছুই আছে। আপনার হাসবেন্ড কেন আপনাকে বলতে চাচ্ছেনা তা এখন পরিস্কার বুঝতে পারলাম।

পূর্ণতা চুপ করে তাকিয়ে আছে। আয়মানও এখন মুখ গম্ভীর করেছে। সাগ্রত কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে টেবিলে মগ রেখে বলে উঠে,
– আপনার থুতনিতে যে ছোট্ট একটা গর্ত আছে তা অদ্ভুত সুন্দর। আপনার হাসিতে একটা নিষ্পাপের ছোঁয়া আছে। কেউ আপনার হাসিটা দেখলে শুধু দেখতেই চাইবে, তার মন ভরবেনা তাতে। আমরা একটা কোলের বাচ্চার হাসি দেখার জন্য আকুপাকু করি আপনার বেলাতেও এমনটা হয়ে থাকে। আপনি কাছের মানুষগুলোকে বুকটা উজাড় করে বিশ্বাস করেন তা দেখে কেউ চাইবেনা আপনার বিশ্বাসের ডোরটা ভাঙুক। পূর্ব আপনাকে এতোটা ভালোবাসে যা পরিমাপ করা দুঃসাধ্য। আপনার হাসিটা যখন কান্নায় মিলিয়ে যাবে সেই দৃশ্যটার জন্য উনি নিজের ঘটনাও মাটি করতে প্রস্তুত। এবং উনি সেটাই করছেন। আপনাকে কিচ্ছু বলেনি। আর মনেহয়না সে বলবে। আমি এখানে সত্য দেখাতে এসেছিলাম কিন্তু অনেক কিছুই শিক্ষা পেলাম। ভালোবাসার জন্য দিনক্ষন লাগেনা, লাগে শুধু মূহুর্ত। এই মূহুর্তগুলো উনি আপনার নামে করে দিয়েছেন। উনি একজন ব্যস্ত জীবনের মানুষ। তার উপর রাজনীতিতে জড়িত তবুও আপনাকে নিয়ে তার খুব স্বপ্ন। এমন স্বপ্নচারিনীর ঠোঁট ভেঙ্গে যখন কান্নার আর্তনাদ আসবে উনি সেটা সহ্য করতে পারবেন না। সত্যিকার অর্থেই ভেঙ্গে যাবেন।আপনি শক্ত হোন ছোটবোন। আপনি ভাঙ্গলে ওই মানুষটার শক্ত খোলসটা ভেঙে শত্রুর সাহসের পাল্লা ভারি করবে। একটা পুরুষ যেমন মেয়ের জীবনটা নরক বানাতে পারে। একটা মেয়ে চাইলে পুরুষের গোটা জগত ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। পূর্ব কষ্ট পেলেও আপনাকে বলবেনা। হয়তো উনি এখন অমানুষিক যন্ত্রণায় আছেন সেটাও আপনাকে বুঝতে দিচ্ছেনা। শান্ত স্বাভাবিক মূহুর্তে আপনি যখন তার মুখের দিকে তাকাবেন তখন বুঝবেন তার যেন কিছুই হয়নি। যখন বুকের উপর হাত রাখবেন তখন ঠিকই বুঝবেন হৃৎপিন্ডের ধুকধুকানির সাথে উনি নিজের সকল তীব্র উৎকন্ঠা চেপে রেখেছেন। ‘যা দেখা যায় তা সত্যি হয়না, যা দেখা যায়না তাই সত্যি হয় ‘– কথাটা জানেন তো? নিজেকে সামলে ওই মানুষটাকেও সামলান। এভাবে ছোটোখাটো ব্যাপারে জীবনের গতি থামাবেন না। সময়, স্রোত, জীবন – কোনোটাই কারোর জন্য থেমে থাকেনা।

সাগ্রত জোরে নিশ্বাস ছেড়ে পকেট থেকে একটা কাগজের ভাজ বের করে। টেবিলের উপর মগের নিচে রাখতেই উঠে দাড়িয়ে পরে। পূর্ণতার দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালে পূর্ণতা হতভম্ব দৃষ্টিতে দাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে দেয়। আয়মানের মস্তিষ্কে বুদ্ধির চাকাটা কোথাও যেন জং ধরে আটকে গেছে, ঠিকমতো ঘুরছেনা, কিছুই বুঝতে পারছেনা সাগ্রত কি বলছে। সাগ্রত মিষ্টি হেসে পূর্ণতার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে,

– কাজের উছিলায় আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। আমি নতুনভাবে আপনাকে দেখতে চাই। অবলা, দূর্বল, লান্ঞ্চিত পূর্ণতা না। আল্লাহ্ হাফেজ ছোটবোন। আবার দেখা হবে।

সাগ্রত জানালার কপাট খুলে চামড়ার ব্যাগটা বাইরে ছুড়ে মারে। ঝপ করে বৃষ্টির মধ্যে মাটিতে পরার শব্দ হতেই জানালা দিয়ে লাফিয়ে পরে সাগ্রত। হাত ঝাড়া দিতেই পূর্ণতার উদ্দেশ্যে কপালে আঙুল তুলে ‘স্যালুট’ ইশারা করে মিলিয়ে যায় বৃষ্টিতে। নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি যেন বাতাসে কুজন শব্দ ছেড়ে দিয়েছে, কানে প্রতিধ্বনির মতো লাগছে, ‘আল্লাহ্ হাফেজ ছোটবোন, আবার দেখা হবে’। ‘আবার দেখা হবে। ‘

আয়মান মগের দিকে তাকাতেই চিরকুটটা দেখে। মগ উঠিয়ে চিরকুট নিয়ে পূর্ণতার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,
– এটা তুই খুলবি না আমি খুলবো?
– তুই খোল।
– সিউর তো?
– হ্যাঁ সিউর।

আয়মান জানালা দিয়ে আকাশের পানে দৃষ্টি রেখে মনেমনে কিছু বললো। চিরকুটটা খোলার সাহস না হলেও পূর্ণতার জন্য খুলতে হবে। আয়মান ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে চিরকুটটা খুলে ফেললো, কালো বলপেনের কালিতে যে নাম ছিলো তা জানার জন্য যতোটা উদগ্রীব ছিলো এখন উদ্ধৃতির জন্য একটুকুও গলা ভেদ করে শব্দ করতে পারছেনা। সাদা চিরকুটটা ধরে শোপিসের মতো স্থির হয়েছে গেছে। আয়মান পূর্ণতার দিকে পিঠ দিয়ে সাদা চিরকুটে আরো একবার চোখ বুলালো। পরিস্কার লেখায় দুটো অক্ষরমালা একত্রে সাজানো। কি সুন্দর নাম!! এই নামটা ঠোঁটের কোণায় উচ্চারণ করলে নিমিষেই মনটা প্রাণচাঞ্চল্য হয়ে উঠে। সাদা চিরকুটে একফোঁটা পানি পরে কালো কাজলের মতো কলমের কালিও যেন ছড়িয়ে পরতে লাগলো। পূর্ণতা ব্যাপক অস্থিরতায় ছটফট করতেই আয়মানের কাধ ঘুরিয়ে হাত থেকে চিরকুট নেয়। চট করে আয়মানের চোখ লুকানো দৃশ্য পূর্ণতা দেখে ফেলে। আয়মান চোখের পানি লুকাচ্ছে কেন? আয়মান চোখে হাত দিয়ে অনেকটা পালিয়ে যাওয়ার মতো দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। পূর্ণতা সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ৈ থেকে শেষমেশ হাতের ভেজা চিরকুট মেলে ধরতেই গোটা গোটা অক্ষরগুলো ভেসে উঠে, ‘শ্রেয়া’। আবার দেখে, ‘শ্রেয়া’। আরো কয়েকবার দেখে ‘শ্রেয়া’। পাগলের মতো বিছানার উপর থেকে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দেখে নাহ্…শ্রেয়াই লিখা আছে। কেন লিখা আছে? এই নাম কেন লিখেছে? শ্রেয়া ছিলো? অসম্ভব! কি করে হবে? শ্রেয়া হতেই পারেনা। হতে পারেনা।

#FABIYAH_MOMO ?

‘ চলবে ‘

( রিচেক দেইনি। অসংখ্য বানান ভুল থাকতে থাকে। ক্ষমাপ্রার্থী। এই একমিনিট আগামী পর্বে ইনশাআল্লাহ চমকে যাবেন…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here