বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দে চারপাশ ভারী হয়ে উঠেছে।টিনের চালায় ঝুপ ঝুপ শব্দ নুপুরের ছন্দ তুলছে।সন্ধ্যা নেমেছে কিছুসময় পূর্বে।দূরের হিজল গাছের কোনো এক ঢালে বসে হুতুম পেঁচা অনবরত ডাক ছাড়ছে।ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির শব্দে সেই ডাক করুন আত্ননাদের মতো শুনাচ্ছে।ঘরে একফোঁটা আলো নেই।মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানিতে সারাঘর আলোকিত হয়ে উঠছে।বিছানার একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সেঁজুতি।হারিকেনের মৃদু আলো তার করুন আত্ননাদের সাক্ষী।বালিশে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।তার কান্নার শব্দ বেশিদূর অবধি যায় না।বৃষ্টির ঝুপঝাপ শব্দতরঙ্গের সাথে মিলিয়ে কোথায় যেনো হারিয়ে যায়।সেঁজুতির করুন আত্ননাদ কারো কানে পৌঁছায় না।
অনেকটা সময় অতিবাহিত হতে চলল।কান্নারা সে কখন তাকে বিদায় জানিয়ে গেছে।চোখের কোণে লেগে থাকা পানি শুকিয়ে উঠেছে।ধীরেধীরে শোয়া থেকে উঠে বসলো সেঁজুতি।রাতের গভীরতা বেড়েছে।বৃষ্টিও কমে গেছে বোধহয়।চুপিচুপি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে।হারিকেনটা মৃদু করে জ্বালিয়ে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার জন্য অগ্রসর হতে গেলে হঠাৎ ওড়না টান পড়ে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল।পিছন ফিরে তাকাতে দেখলো হামিদা তার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।শ্যামলা গায়ের রং হামিদার।হারিকেনের আলোয় তেল চকচকে কালো দেখাচ্ছে।ডাগর ডাগর আঁখি দুটোতে সে কি বিস্ময়।মাঝরাতে সেঁজুতিকে পা টিপে ঘর থেকে যেতে দেখে চমকালো না সে।শুধু চুপিচুপি বলল,
“আপা এত রাইতে তুমি কই যাও?”
হামিদার কথায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারে না সেঁজুতি।ক্ষণকাল মৌন থাকে।তারপর পা টিপে টিপে কয়েক পা এগিয়ে হামিদার একেবারে কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বলল,
“আগে বল আম্মারে কিছু কইবি না?”
হামিদার বিস্ময়ে মাথা দুলায়।সেঁজুতি আরেকটু গলা খাদে নামিয়ে বলে,
“হিজল তলায় উনি আমার অপেক্ষায় আছেন।একবার দেখা কইরা চইলা যাইবো।”
“এত রাইতে মেঘ বাদলা মাথা লইয়া সাবেত ভাই তোমার লগে দেখা করতে আইবো।চিঠিডা তো তুমি পড়লা না।”
“হু।তুই আম্মারে কিন্তু কিছু কইবি না।জানলে আমারে মাইরা ফেলবো।”
“কিন্তু এত রাইতে তুমি যাইবা কেমনে?উনি যদি না আসে?”
“উনি আসবো।তুই আম্মারে সামলাবি আমি গেলাম।”
সেঁজুতি কয়েক পা এগুতেই হামিদা আবার চাঁপা স্বরে বলল,
“আমার খুব ডর করে আপা।যদি কিছু হয়?”
“কিচ্ছু হইবো না।উনার লগে আমার কথা কইতেই হইবো।”
“আমি আসি তোমার লগে?”
“না একদম না।তুই ঘরে থাক আম্মা যদি জাইগা যায় খুব খারাপ হইবো।”
হামিদা আর কথা বাড়ায় না।চুপচাপ সেঁজুতির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
ঘর হতে বেড়িয়ে উঠানে পা রাখতে কয়েকটা কুকুর একসাথে চেঁচিয়ে উঠল।ভয়ে সেঁজুতির আত্না কেঁপে উঠে।তবুও সে থামে না।পা টিপে টিপে সাবধানে উঠান পেরোয়।চারদিক নীরব অন্ধকারে ছেয়ে আছে।চারপাশে কাঁদা মাটির সোঁদা গন্ধ।তিরতির করে মৃদু হাওয়া বইছে।হাল্কা শীত শীতভাব পরিবেশে।সেঁজুতি ভালো করে গায়ে ওড়না পেছিয়ে নিয়ে বড় করে গোমটা টানে।বাড়ির পিছনে বড় হিজল গাছটাকে এখান থেকে দানবের মতো দেখাচ্ছে।চারপাশের ঝোপঝাড় গুলো বৃষ্টির পানিতে সজীব হয়ে উঠেছে।সেঁজুতি ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়।তার বুক ধুকধুক করছে।ঘন ঘন শ্বাস উঠানামা করছে।অজানা এক শিহরণে সারা শরীর কেঁপে উঠছে।মনে মনে কয়েকবার আয়াতুল কুসরী পড়ে বুকে ফুঁক দিলো সেঁজুতি।গন্তব্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সে।আর কয়েক পা মাত্র।
হিজল গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে উৎসুক হয়ে এদিক সেদিক দেখছে সাবেত।আধঘণ্টা ধরে সে অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে জায়গায় দাঁড়িয়ে সেঁজুতির অপেক্ষা করছে।মশা কামড়ে তার পা দুটো ফুলিয়ে ফেলেছে।বৃষ্টি হওয়ায় এই দিকটায় মশার উপদ্রব অনেক বেড়েছে।নিশুতি রাতে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে মশাগুলো দলবলে বেড়িয়ে এসেছে তাজা রক্ত খাওয়ার লোভে।মশার কামড়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়ছে সাবেতের।ঘাড়ের কাছে কয়েকটা মশা এসে বসতেই ঠাশ করে শব্দ তুলল।নাহ আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।পা দুটো অবশ হয়ে আসছে।
“এই জায়গায় এত মশা পারছে না আমাকে তুলে নিয়ে যেতে।সর সর! বাবার জন্মে কখনো রক্ত খেতে পাস নি?তাই আমাকে পেয়ে ইচ্ছা মতো কামড়ে শেষ কতে দিচ্ছিস?”
সাবেত কথা শেষ করতে পারলো না নিশুতি রাতে রমনীর খিলখিল হাসির শব্দ কানে ভেসে আসলো।সাবেত চমকে উঠে।হাসির শব্দ তার মস্তিষ্ক বিকল করে দিচ্ছে।অপূর্ব সেই হাসিতে কতশত মাদকতা উপছে পড়ছে।সাবেত অবাক চোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেঁজুতিকে দেখলো।হারিকেনের মৃদু আলোয় সেঁজুতির কাজল কালো চোখ দুটি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে।পদ্মফুলের পাপড়ির ন্যায় সুরু ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে রেখেছে সেঁজুতি।সাবেত দ্বিতীয় বারের মতো খুন হলো।হ্যাঁ নিশুতি রাতে ষোড়শী নারীর নিষ্পলক চোখের চাহনি দ্বারা আরো একবার খুন হলো সাবেত।সেঁজুতির টলটলে ডাগর ডাগর আঁখি দুটি পদ্মবিলের ন্যায়।সাবেতের ইচ্ছে হলো সেই পদ্মবিলের স্বচ্ছ জলে ডুবসাঁতার কাঁটতে।সাবেতের নেশাযুক্ত চাহনি দেখে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করলো সেঁজুতির।বুকে কম্পন ধরিয়ে দিলো।সারা দেহ জুড়ে শিহরণ। অজানা শংকায় তার দেহ কাঁপে উঠছে।সাবেত দু পা তার দিকে এগিয়ে এলো।সেঁজুতির বুক ধুক ধুক করছে।নিশ্বাস বাড়িয়ে হয়ে আসছে।ধম ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।বাতাসে অক্সিজেনের বড্ড শুন্যতা বলে তার মনে হচ্ছে।সাবেত আর একয়েক পা এগিয়ে এলেই তার দমটা গলায় আটকে পড়বে।এমন পরিস্থিতি কি করে সামলে নিবে সেঁজুতি ভেবে পায় না।ভয়ে ভয়ে একবার সাবেতের দিকে তাকিয়ে নতজানু হয়ে দাঁড়ায় সে।তার আর সাবেতের মাঝে দূরত্ব একহাত জায়গা মত।সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এত রাইতে ডাকলেন কেনো?কেউ যদি দেইখা ফেলে?”
“এত যদি ভয় তবে এলে কেনো?”
“আপনি হামিদার হাত দিয়া চিঠি পাঠাইলেন কেনো?”
“ওমনি আসতে হলো?ভয় করলো না একবার? অচেনা অজানা একটা পুরুষ মানুষ যদি কোনো ক্ষতি করে।”
সেঁজুতি মাথানত অবস্থায় চোখ তুলে সাবেতকে একবার দেখলো।সাবেত ফর্শা গালে ঘন চাপদাড়ি মাঝে সুরু গোলাপ রাঙা দুটো ঠোঁট।কি অপূর্বই না দেখাচ্ছে।সেঁজুতির ইচ্ছা হলো একবার ছুঁয়ে দেখতে কিন্তু সাহস হলো না।ভয়ে বুক দুরুদুরু করতে লাগলো।সাবেত ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল,
“ভয় করে নি আসতে?যদি তোমার আম্মা দেখে ফেলতেন?”
“আম্মার শরীর ভালো না,ঘুমাইতাছেন।”
“চিঠি টা পড়েছো?”
“হামিদা পড়ছে।”
“তুমি পড় নি?”
সেঁজুতি মাথা দুলায়।সাবেত কয়েক সেকেন্ডে চুপ থেকে বলল,
“কাল চলে যাচ্ছি।”
“জানি।”
“তবে যে বললে চিঠি পড় নি?”
“হামিদা কইছে।”
সাবেত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সেই শ্বাস সেঁজুতির কানে গিয়ে ঠেকে।আচকা কেঁপে উঠে সেঁজুতি।কান গরম হয়ে উঠে।নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতো অনুভুতি তার সারা দেহমন জুড়ে।তবুও নিজেকে শান্ত রাখে।নিজের দূর্বলতা কিছুতেই সে সাবেতকে বুঝতে দিবে না।সাবেত মৌনতা ভেঙে আরেকটু কাছে সরে এলো।পকেটে হাত দিয়ে একটা চিঠি আর একটা ছোট্ট বাক্স বের করে এগিয়ে দিলো সেঁজুতির দিকে।সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
“কি আছে এহানে?”
“আমি বলবো না ঘরে গিয়ে দেখো।আর শুনো আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো।আর এসেই আব্বাকে তোমায় পছন্দ করার বিষয়টা খুলে বলবো।ততদিন মন দিয়ে পড়াশুনা করো মেট্রিক টা ভালো করা চাই।না হয় লোকে বলবে ডাক্টার সাবেতের বউ মেট্রিক ফেইল।”
সাবেতের শেষের কথায় সেঁজুতির দু কান গরম হয়ে উঠল।লজ্জায় তার মাটি ফাঁক করে ঢুকে যাতে ইচ্ছে হলো।তবে মনে মনে খুশির ঝলক উকি দিতে লাগলো।প্রথম প্রেমের অনুভুতি সারা মনে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।কি অপূর্ব সেই অনুভুতি।এখন তার নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে।
সেঁজুতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে।ক্ষেতের আইল ধরলো সাবেত।পানি ভেঙে রাস্তায় উঠবে তারপর বাড়ি।
চলবে,,,।