সুখের অ-সুখ পর্ব-১৯

0
980

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ উনিশ

মেঘের মায়ের কিছু জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছুই বাড়ি থেকে নেয় নি মিনা। সুখ বুঝতে পারছে না এহেন রহস্য। গতকালকে যে মেয়েটা আকষ্মিক আতঙ্কে আৎকে উঠেছিলো, আজ সে মেয়েটা উধাও! মেয়েটা কী তবে আতঙ্ক থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেলো নাকি তাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে! এমন হাজারখানেক প্রশ্ন নিয়ে সুখ দাদীর রুমে বসে আছে। দাদী তার ছোট্ট ব্যাগটা নেড়েচেড়ে দেখছে। সে ঐ বাড়ি থেকে খালি হাতেই বের হয়েছিলো, নাতজামাই তাকে কত গুলো শাড়ি কিনে দিয়েছে।

ব্যাগটা বেশ খানিকক্ষণ হাতিয়ে দাদীজানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। একটা বিশ্ব জয় করার মতন হাসি দিয়ে সাদা ছোট্ট কাপড় বের করলো।

সুখ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল দাদীর পানে। দাদীর আচরণ ঠিক বোধগম্য হলো না তার। এতক্ষণ এই ছোট্ট কাপড়টা’ই খুঁজছিলো দাদী? কী আছে কাপড়টাতে? এই কাপড়টা দেখানোর জন্য’ই কী তাকে ডেকে আনলো!

সুখ বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-“তুমি কী এটা দেখানোর জন্য আমায় ডেকেছো দাদীজান!”

-“হ্যাঁ গো হ্যাঁ। এই রুমালটা আমি অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছিলাম তুমি যেদিন বাড়ি ছাড়লা হেইদিন। আসলে এইটা খোঁজার ইচ্ছা জাগে নাই কহনো, কিন্তু হঠাৎ মনে হইলো তোমার জন্য যেহেতু এই জিনিসটা বানানো হইছিলো তাই এইটা তোমার দেখার অধিকার আছে। নেও দেখো।”

শেষের কথাটা বলতে বলতেই হাতের রুমালটা দাদীজান সুখের দিকে এগিয়ে দিলো। সুখ আশ্চর্য বনে রুমালটা হাতের মুঠোই ধরলো। সাদা রুমালটা অবশ্য একবারে সাদা নেই, সময়ের বিবর্তনে সাদা রঙটাও ফিঁকে হয়ে হলদেটে রঙ ধারণ করেছে। সুখ রুমালটা খুললো। কি সুন্দর কারুকাজ। হাতে সেলাই করা ডিজাইন বুঝাই যাচ্ছে না। রুমালটায় যত্ন করে হাত বুলাতেই ডানপাশের কোণায় ছোট দু’লাইনের লেখা চোখে পড়লো যা সুতো দিয়েই বুনন করা হয়েছে।

সুখ রুমালটা আরেকটৃ উপরে তুললো। সুতো দিয়ে এত ছোট নিঁখুত লিখা যায় এ লেখাটা না দেখলে জানতোই না। লেখাটা বোধগম্য করার জন্য গভীরে দৃষ্টি দিলো সে। গুটি গুটি অক্ষরে লিখা,
“মা-বাবা কখনো মরে না, একদিন তারা আমাদেরকে তাদের গর্ভে ধারণ করে আর বড় হওয়ার পর আমাদের গর্ভে আমরা তাদের ধারণ করি। বাবা-মা মানেই আমার সন্তান আর সন্তান মানেই আমার বাবা-মা।”

সুখ এই দু’টি লাইনের লেখায় বিমোহিত হয় আর সাথে সাথে অবাক হয় বা’পাশের কোণায় আরও দু’লাইন লিখা দেখে। লাইন গুলো এমন,
“লোকে বলে আমার মা নেই, কিন্তু লোকে তো জানে না আমি আমার মা’কে আমার গর্ভে ধারণ করেছি। আমার মেয়ে,সে’ই তো আমার মা।”

সুখ অবাক চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে রয়। এই কথা গুলোর মাঝে কী যে মুগ্ধতা অনুভব করছে সে! কিন্তু তার ঝাপসা স্মৃতির ধূলো পড়া এক রহস্য হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। লেখা গুলো সে এর আগেও দেখেছে। এমন লেখার সাথে সে পরিচিত। স্মৃতির কোণা থেকে বেরিয়ে আসলো লাইব্রেরীর সে রহস্যময় রজনী। ধূলোমাখা আলমারীর কোণায় সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটার আড়ালে শুভ্র রাঙা এক গভীর রহস্যমাখা চিরকুট,যা সময়ের বিবর্তনে ঠিক রুমালটার মতন হলদেটে রঙ ধারণ করেছিলো। কিন্তু তার ভিতরে থাকা গোটা গোটা অক্ষরে লিখা রহস্য গুলো এক চুলও কমে নি বরং বেশ ভয়াবহ ছিলো।

সুখ হন্তদন্ত পায়ে দাদীর কাছে গেলো। আকষ্মিক অনাকাঙ্খিত ভয়ে হৃদয়টা কাঁপছে যেনো। মনে হচ্ছে আজ এমন কিছু শুনবে যা হয়তো গোটা জীবন’কে বদলিয়ে দিতে পারে। তবুও সে নিজেকে ধাতস্থ করলো। গলার কাছটাতে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামটা শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছে নেয়। কন্ঠটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
-“এগুলো কার লেখা দাদীজান?”

-“আর কার! তোমার মায়ের। তুমি একমাসের থাকতে সে এটা বানইছিলো। তোমারে ম্যালা ভালোবাসতো কি না। হাহ্! হঠাৎ কেমন বদলায় গেলো মানুষটা। একদম হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন উধাও হইয়া গেলো। তবে এটা মানতে হইবো, মাইয়াটা বড় ভালা ছিলো।”

সুখ যেনো আর কিছু শোনার মতন অবস্থাতে নেই। মাত্রই গলায় জমা মুছে ফেলা ঘাম গুলো নতুন করে চিলিক দিলো। মস্তিষ্কের নিউরন গুলোও বোধহয় কথাটা সহ্য করতে না পেরে কার্যক্ষমতা হ্রাস করে দিলো। নিঃশ্বাসটা যেনো বের না হওয়ার তীব্র পণ নেয়। সে ভুল ভাবে নি তবে, তার মন তো আগে থেকেই এমন কিছু শুনবে বলে তাকে সংকেত দিয়েছিলো তবে মানতে কেনো পারছে না সে? দীর্ঘ একুশ বছর যাবত মা’কে নিয়ে গড়া কথা গুলো ভুলের মঞ্জিল ছিলো? তার মা তবে বিশ্বাসঘাতক নয়! জীবন যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যায় নি?

সুখ রুমালটা হাতে নিয়ে বাগানের দিকে ছুট লাগায়। বাড়ির দক্ষিণ দিকের জঙ্গলের মতন জায়গায় চলে যায়। ভিতরে চলে নিরব বিস্ফোরণ। মা পালিয়ে যায় নি, মা হারিয়ে গেছে তবে!

সে অনুভব করে, একুশ বছর ধরে গড়া জীবনটা কেবল ভুলের সমাহার। হিসেব করেও শেষ করা যাবে না সেই ভুলের নামতা। রুমালটা নিজের মুখে চেঁপে ধরে সুখ। বহু যুগের পরিচিত ঘ্রাণ যেনো ভেসে আসলো সেখান থেকে। মায়ের ঘ্রাণ নিতে না পারলেও রুমালের সুভাষ টা কেমন মা মা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। অনেক বছর পর তার মনে হলো মা নামক মানুষটিকে না দেখার আফসোস এ জীবনে সকল দুঃখকে ছাপিয়ে গেছে। যার মা নেই তার কাছে পৃথিবী’টা নীল। কারণ বেদনার রঙ নাকি নীল!

—-

পুরো একটা দিন সুখের ঘোরের মাঝে কেটে গেলো। স্বাভাবিক, এমন নিঠুর সত্য সামনে এসেছে সামলাতে তো সময় লাগবেই। কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। সে সারাদিন নিজের মতন কাটালো। এ রহস্য উন্মোচন করতেই হবে যেকোনো মূল্যে। তার আগে তাকে এ বাড়ির রহস্য পরিষ্কার করে বাবার বাড়ি যেতে হবে। মসৃনকেও উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে।

সন্ধ্যা বেলায়, সুখ অনুভব করলো সে কিছু জানার আগেই ভেঙে পড়ছে। সে উঠে বসলো, কা-বার্ড থেকে একটা শুভ্র রাঙা শাড়ি নামিয়ে স্নানাগারে চলে গেলো। সবার আগে শরীরে স্নিগ্ধতা প্রয়োজন তারপর সবটা সুন্দর করে করা যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ।

বেশ খানিকটা সময় লাগিয়ে এই অবেলায় স্নান করলো সুখ। শুভ্রা রাঙা শাড়ি পড়েই বের হলো। কোমড়ের নিচ অব্দি লম্বা চুল গুলো ভিজে টপ টপ করে পানি পড়ছে। স্নানাগার থেকে বের হতেই সুখের ডাক পড়লো নিচ থেকে। আজ মেঘও দিনের বেশিরভাগ সময় বাহিরে ছিলো। মিনা’কে খুঁজছে সাথে মিসিং ডাইরিও করেছে থানায়। তাই সুখ নিজের মতন কিছুটা সময় কাটাতে পেরেছে।

সুখ দ্রুত হাতের জামাকাপড় গুলো বারান্দায় দড়িটাতে দিয়ে নিচে ছুটে গেলো।

মেঘও একটু আগে এসে কেবল বসেছে। এখনো রুম অব্দি যায় নি। হঠাৎ সিঁড়ির পানে তাকাতে সে হা হয়ে গেলো। স্নিগ্ধ রমনীর পদার্পণে সিঁড়ির সাথে সাথে তার হৃদয় কোণে যেনো শীতল স্রোত বয়ে গেলো। এ কেমন ধ্বংসাত্মক রূপ রমনীর!

সুখ সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে সোফার দিকে তাকাতেই হা হয়ে গেলো। অবাক কন্ঠে বলল,
-“আরে স্যার আপনি! কেইসের ইনভেস্টিগেটশন করতে করতে শহর অব্দি চলে আসলেন নাকি?”

পুলিশ অফিসার হেসে দিলেন সাথে মেঘও চাঁপা হাসলো। রেদোয়ানের খুনের তদন্ত যিনি করছেন শেখ আরশাদ, তিনিই এখানে উপস্থিত।

সুখ এগিয়ে গেলো। অফিসার হেসে বললো,
-“এসেছিলাম তো ঢাকায় একটা কাজে কিন্তু ইয়াং ম্যান এর সাথে দেখা হলো তাই চলে আসলাম। এমনেতেও একটা ইনফরমেশন জনানোর ছিলো তাই চলে আসলাম।”

মেঘের মা ততক্ষণে হালকা খাবার নিয়ে হাজির হন। সেন্ট্রাল টেবিলে খাবারের ট্রে টা রাখলেন। আরশাদ সাহেব একটু চাঁপা হাসলো কুশলাদি বিনিময় করলো তারপর সবার সম্মুখে একটা আর্জি রাখলেন,
-”আমি সুখোবতীর সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।”

সবাই সম্মতি জানাতেই সুখ নিজের রুমে নিয়ে গেলো আরশাদ শেখ’কে।

সুখের রুমে এসে আরশাদ সাহেব সুখের সাথে স্বাভাবিক কথা বললো কতক্ষণ তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে এনে বিস্ফোরণের ন্যায় একটা কথা উচ্চারণ করলেন,
-“সুৃখোবতী, তুমি বোধহয় বেঁচে গেছো রেদোয়ানের মৃত্যুতে। এই প্রথম দেখলাম, কারো মৃত্যু কাউকে এমন ভাবে বাঁচিয়ে দেয়।”

সুখ অবাক হলো। অবাক কন্ঠে বললো,
-“মানে! কী বলছেন স্যার?”

-“রেদোয়ান তোমাকে নিয়ে জঘন্য প্ল্যান করেছিলো,সুখোবতী। রেদোয়ান নারী পাচারের দলের সদস্য ছিলো। ও তোমাকেও পাচার করাে চিন্তা ভাবনা করেছিলো। রীতিমতো তোমাকে কত টাকায় বিক্রি করা হবে কোথায় পাঠানো হবে তাও প্ল্যান করা হয়ে গেছিলো। যে-ই মেরেছে ওকে, সে এক হিসেবে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে খুন তো আর আইনের চোখে ক্ষমা যোগ্য না তাই তাকে খুঁজতে হবে।”

সুখ সোফায় বসে পড়লো। এত বড় ধামাকা তার জন্য অপেক্ষারত ছিলো! এটাও শোনার ছিলো?

আরশাদ সাহেব সুখের মাথায় মমতার হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
-“যতটুকু জানতে পেরেছি মেঘও এটা জানতো। তোমাকে কেনো বলে নি আমি জানিনা। ও আমাদের কাছেও এটা লুকিয়েছে। যাই হোক তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো ঠান্ডা মাথায়। আমিও আমার ইনভেস্টিগেশনের সূত্রে জানার চেষ্টা করবো তবে সেটা পরে। আসছি। সাবধান হও। আমাদের সন্দেহের বাহিরে কেউ নেই। এমনকি মেঘও না।”

সুখ প্রথম কথায় যতটা না অবাক হয়েছিলো তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে দ্বিতীয় কথাটাই। মেঘ এসব জেনেও তাকে জানায় নি কেনো? তবে কী সে আবারও ভুল পথে পা বাড়ালো!

নিরবতায় কেটে গেলো মিনিট বিশ। সুখ ঠাঁই বসে রইল। মেঘ রুমে এসে ভ্রু কুঁচকালো, একটু আগের সুখ আর এখনের সুখের মাঝে বহুত পার্থক্য। অফিসার সুখকে কী এমন বললো!

মেঘ ধীরে এগিয়ে আসলো। সুখের পাশে বসে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কী হয়েছে অপরিচিতা! কী বলেছে আংকেল আপনাকে?”

সুখ মৃত দৃষ্টিতে তাকালো মেঘের দিকে, মেঘের আচমকা ভয় হতে শুরু করলো। তবে কী সুখ,, না না, সে এসব কী ভাবছে!

সুখ আহত কন্ঠে বললো,
-‘আপনি সব জানতেন মেঘ সাহেব! তবুও আমায় বলেন নি কেনো?’

মেঘ যা আন্দাজ করেছে তার মানে তাই হয়েছে। মেঘকে চুপ থাকতে দেখে সুখ আবার বললো,
-‘আপনিই খুন করেছেন রেদোয়ান ভাইয়াকে তাই না?’

মেঘ আৎকে উঠে। কিছু বলার আগেই তার ফোনটা উচ্চশব্দে বেজে ওঠে। ইউসুফের কল দেখে রিসিভ করে বারান্দায় চলে যায়। হঠাৎ সুখের কানে একটা আর্তনাদ ভেসে আসে। সুখ কন্ঠের অধিকারীকে চেনে। তৎক্ষণাৎ ছুটে যায় রুমের বাহিরে।

মেঘ বারান্দায় ইউসুফের সাথে কথা বলার সময় সুখকে ছুটতে দেখে দু বার পিছু ডাকে। কিন্তু কোনো ফল না পেয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা কেটে সেও বাহিরে চলে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় সে। হাতের ফোনটা পরে যায় আলগোছে। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে সুখের শুভ্র রাঙা শাড়ি’টা তাজা রক্তে লালবর্ণ ধারণ করেছে। আর তার কোলে বৃদ্ধ মরোয়ারার নিথর শরীরটা।

#চলবে

[আজ কিছু রহস্য সামনে এসেছে আর কিছু রহস্য নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। রহস্য ছড়ানো শেষ এবার আপনাদের ভাবনার পালা শুরু।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here