#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
পর্বঃ এগারো (১৯৫০+শব্দ)
[কপি নিষেধ]
আধাঁর ঘরে হঠাৎ এমন চিৎকারে সবাই হতবাক। চিৎকার টা চেনা মানুষের। দ্রুত যাদের যাদের হাতে স্মার্ট ফোন ছিলো তারা ফ্লাশলাইট জ্বালালো। হিমার হাতের কাছে ফোন থাকায় সে-ই ফ্লাশলাইট সবার আগে জ্বালালো। লাইটের আলোটা প্রথম ড্রয়িং রুমের মেঝেতে পরতেই লাল তরল পদার্থ সবার চোখে লাগল। হিমা নিজের হাতে যে ভেজা ভাবটা অনুভব করে ছিলো সেটা দেখার জন্য ফ্লাশলাইট টা নিজের হাতে মারলো। হঠাৎ হিমা ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলে,
-‘রক্ত!’
উপস্থিত সবার মাঝে গুঞ্জন শুরু হয়। তন্মধ্যেই অধিকাংশ মানুষ নিজেদের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে ফেলেছে। পুরো ড্রয়িং রুমে গল গল রক্তের স্রোত। এর মাঝেই কারেন্ট চলে আসে। রক্তের উৎস অনুধাবন করতে গিয়ে বীভৎস দ্বিখণ্ডিত মানুষটাকে দেখে উপস্থিত সবাই চোখ বন্ধ করে ফেলে।সুখ ভয়ে ভয়ে নিজের পাশে তাকাতেই দেখে শেরওয়ানী পড়া রেদোয়ানের শরীরটা তার সাথে হেলে পড়ে আছে। সেই শরীরটার সাথে মাথাটা নাম মাত্র লেগে আছে।ভয়ে আতংকে সুখ চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে উঠে।রীতিমতো একটা ছুটাছুটি পরে যায়। সুখের শরীর থেকে দ্বিখন্ডিত শরীরটাকে কেউ সরিয়ে দিচ্ছে অনুভব হতেই সুখ চোখটা খুলে তাকায়। তার সামনেই মেঘ দাঁড়িয়ে আছে।
সুখ আরেকবার বীভৎস রেদোয়ানের দিকে তাকিয়ে ছুট লাগায় ড্রয়িং রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমের দিকে।পেট থেকে উগড়ে আসে বমি। কী ভয়ানক জিনিস দেখলো সে এটা! সুস্থ সবল রেদোয়ানের মিনিট পাঁচের মধ্যে এমন অবস্থা!
সুখদের বাড়িতে একটা হৈ চৈ বেঁধে গেলো। পাড়া প্রতিবেশী সব হাজির হলো। বাতাসের চেয়েও দ্রুত বেঁগে একটা কথা প্রচার হলো সুখের কপাল পুঁড়লো,রেদোয়ান নামক ভালো ছেলেটাকে প্ল্যান করে কেউ খুন করলো, কিন্তু কে?
রেদোয়ানের বাবা পাথর হয়ে সোফার এক কোণায় আগের ন্যায় বসে আছে। এলাকার একজন লোক চাঁদর দিয়ে রেদোয়ান এর বীভৎস শরীরটা ঢেকে দিয়েছে।
সুখ বমি করার পর ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে লীলাবতী দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সুখের কাছে গিয়ে সুখকে ধরে। মেঘেরাও কারেন্ট যাওয়ার পরপরই এখানে উপস্থিত হয়েছিলো।তাই সবটা ঘটনা তারা দেখেছে।
সুখের অবস্থা নাজেহাল। ভয়ে আর আতঙ্কে তার মুখ নীল বর্ণ ধারণ করেছিলো। মেঘ ডাক্তার ডাকিয়েছে। নিজের সাথে রেদোয়ানের ভয়ংকর, সদ্য মৃত শরীরটা হেলে থাকার দৃশ্য টা সুখ সহ্য করতে পারে নি। পুরো বাড়িময় আহাজারি। রেদোয়ানের মা লিলুয়াও ছুটে এসেছেন ছেলের শেষ পরিণতি দেখার জন্য। মাত্র এক ঘন্টায় বাড়ির চিত্র বদলে গেলো। যেহেতু খুন হয়েছে পুলিশ আসাটা স্বাভাবিক। পুরো এলাকায় রমরমা খবর এখন। এ জেনো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সুখদের বাড়ি। কিন্তু এসবই সুখের অজানা। সুখ নিজের বিছানায় টানটার হয়ে শুয়ে আছে। ডাক্তার দেখে ঔষুধ দিয়ে গেছে।
সুখের রুমে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লীলাবতী, হিমা,অনু,মেঘ আর ইউসুফ। সুখের জ্ঞান ফিরতেই সে চট করে ওঠে বসে। আহাজারি পুরো বাড়িময়। পুলিশ নিজেদের মতন খোঁজ করছেন। রেদোয়ান এর লাশ পোস্টমর্টেম করার জন্য নেওয়া হয়েছে। এটা যে পরিকল্পিত খুন সবাই ই জানে, বুঝতেও পেরেছে। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর কাজ টা কে করেছে?
সুখের মাথা ভার হয়ে আসছে। একমাস আগে এ বাড়িতে আহাজারি হয়েছিলো,এমনই বিয়ের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান মৃত বাড়িতে রূপদান করেছিলো। সেদিনের পর হতে বাড়িটা একদম নিস্তব্ধতায় ঘিরে গেলো। আজ আবার সেই একমাস আগের স্মৃতিচারণ। সুখ নিজের মাথা চেপে ধরলো।
সুখকে উঠতে দেখেই বাহিরের ঘর থেকে লিলুয়া ঝড়ের বেগে ছুটে আসলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই সুখের গালে অনবরত চড় লাগাতে লাগাতে আর্তনাদ করে বলল
-‘অলক্ষী,অপয়া মেয়ে। প্রথম বিয়ের সময় নিজের বাপকে খেলি এখন আমার ছেলেটা। আমার আগেই বুঝা উচিত ছিলো তোর মতন মেয়ে আর কিইবা উপহার দিবি আমাদের। বেজন্মা একটা বাচ্চা পেটে ধরে আছিস তোর লজ্জা করে না? সেদিন তোর মা বলেছিলো তোকে গলায় দড়ি দিতে সেটাই ঠিক ছিলো, তোর মরে যাওয়ার উচিত অলক্ষী।’
মেঘ দ্রুত ছুটে আসলো। লীলাবতী আর হিমা মিলে ফুপিকে সরালেন। সুখ মুখ ঢেকে রইল। ঠিক কী করছে বুঝা গেলো না। মেঘ ইশারা করতেই অনু আর হিমা লিলুয়াকে ধরে ঘরের বাহিরে নিয়ে গেলেন।
মেঘ সুখের মাথায় হাত রাখলো। এ স্পর্শে কোনো লালসা নেই, আছে এক রাশ ভরসা। লীলাবতী এগিয়ে এসে সুখের বাহুতে হাত রেখে কাঁপা কন্ঠে ‘আপাই’ বলতেই সুখ আঁকড়ে ধরে লীলাকে। ছিটকে উঠে কান্না। আহাজারি করে বলে,
-‘আমি কী এতই অলক্ষী রে লীলা? সত্যিই আমার মরে যাওয়া উচিৎ? আমার বিয়ের লাল কাপড় কেনো বারবার সাদাতেই রূপান্তরিত হচ্ছে? আমি বুঝি এত অপয়া?’
লীলা কিছু বলার আগেই বাহির ঘর থেকে গুঞ্জন ভেসে আসলো। কেউ বলছে, “এ মেয়েকে ঘর থেকে বের করে দেও, নিশ্চয় এই মেয়ের প্রতি কারো কুনজর আছে”। কেউবা বলছে, “লীলার মা তোমারও একটা অবিবাহিত মেয়ে আছে,ওর কথা ভেবে কঠিন একটা ব্যবস্থা নেও।অলক্ষী,অপয়া রাখার চেয়ে খালি ঘর থাকবে তাও ভালো।”
সুখের আচমকা কান্না টা থেমে গেলো। মেঘ ভীত দৃষ্টিতে তাকালো সুখের পানে, মেয়েটার এখন যে অবস্থা এমুহূর্তে এসব কথা বেশ ক্ষতিকর ওর জন্য। অন্যের বাড়ি বলে কিছু বলাও যাচ্ছে না,তাহলে আরেক কেচ্ছা রটে যাবে। কিন্তু ভাবনার বিষয় একটাই,খুনটা করলো কে?
মেঘ সুখের মাথায় বার দুই এক হাত বুলিয়ে নিবিড় কন্ঠে ভরসা দিয়ে বলল
-‘এসব কথা আপনি গায়ে মাখাবেন না অপরিচিতা। আপনি অলক্ষী,অপয়া কিছু না। আপনি শক্ত হোন।’
লীলাবতী এবার পূর্বদৃষ্টিতে তাকালো মেঘেদের দিকে।কোমল কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘আপনাদের ঠিক চিনলাম না,আপাই এর কী হন?’
-‘বন্ধু।’
মেঘের ছোট্ট উত্তরে লীলাবতীর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মিললো। ইউসুফ এতক্ষণ চুপ ছিলো,এবার ধীর পায়ে মেঘের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
-‘স্যার মেমকে জানাবেন না সেই খবরটা?’
ইউসুফের চেয়েও ধীর কন্ঠে মেঘ উত্তর দিলো
-‘দেখছো তো অপরিচিতার অবস্থা। এসময়ে কোনো কিছুই সে নিতে পারবে না। আমরা সবটা পরে জানাবো। তবে ইউসুফ খুনটা কী একবারই ভুল হয়েছে?’
-‘এমন মানুষ বেঁচে থেকেই বা কী করতো স্যার? এ মরে গেছে মানে অনেক মানুষ বেঁচে গেছে।’
-‘তাদের তালিকায় তোমার মেমও আছে তাই না ইউসুফ?’
মেঘের প্রশ্নে ইউসুফ কেবল মাথা নাড়ালো। সুখ নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দক্ষিণের দিকে জানালাটার পানে। সুখের জীবন অ-সুখেই কাটবে তবে!
সুখের রুমে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো পুলিশ প্রধানসহ আরও কয়েকজন ইন্সপেক্টর। পুলিশ ভদ্রলোক সুখের সামনে এগিয়ে এসে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-‘আপনি এখন ঠিক আছেন আম্মু?’
সুখে এবার তার অলস দৃষ্টি পুলিশের পানে নিবদ্ধ করলো। এত স্নেহের ডাক সে কতদিন শুনে না। মাথা নাড়িয়ে বলল,
-‘জ্বি ঠিক আছি।’
পুলিশ ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন,
-‘আপনার সাথেই তো বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো মি.রেদোয়ান এর?’
-‘জ্বি হ্যাঁ।’
-‘আচ্ছা ঠিক কী ঘটেছিলো একটু বলবেন?’
পুলিশ অফিসারের প্রশ্নে সুখ একদম প্রথম থেকে সব বিবরণ দিলো। পুলিশ অফিসার সব মনযোগ সহকারে শুনে সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-‘আপনি বিশ্রাম নেন আম্মু। আমরা দেখছি সবটা। ভেঙে পড়বেন না একদম। আস্থা রাখুন।’
পুলিশটার কোমল আচরণে সুখ যেনো বাবার আদল পেলো। পৃথিবীতে বাবা মা হীন সন্তান গুলো একটু স্নেহ পেলেই সেই স্নেহের মাঝেই নিজের বাবা মায়ের ছায়া খুঁজে বেড়ায় নিজেদের দুঃখ ভুলার জন্য। সুখও সেই নিয়মের বাইরে না।
পুলিশ অফিসারের সাথে সুখের যাবতীয় কথা শেষ হতেই মেঘ এগিয়ে গেলো। ভদ্রতার সহিতে বলল
-‘কী বুঝলেন আঙ্কেল? কোনো ক্লু পেলেন? কে করেছে?’
পুলিশ অফিসার সুখের দিক একবার তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন
-‘তোমার ফোন পেয়েই তো আসলাম মেঘ। আমরা পুরো বাড়িটা’ই ভালো মতন খোঁজাখুঁজি করলাম কিন্তু সন্দেহ জনক কিছু পেলাম না। ধারনা অনুযায়ী বলা যায় এই কাজটা করতে খুনি সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট ব্যয় করেছে কিন্তু কী নিঁখুত ভাবে সবটা করেছে। খুব ধারালো অস্ত্রে কাজটা করা হয়েছে। ছোট খাটো অস্ত্র দ্বারা এমন দ্বিখণ্ডিত করা যেতো না শরীর টা। কিন্তু অস্ত্র টা গেলো কোথাই? ওনাদের বাড়ির পেছন থেকে বিদ্যুৎ এর মেইন সুইচ,সেটা অফ করে ড্রয়িং রুমে আসতে এক থেকে দেড় মিনিটের ব্যাপার। আমরা সেই সুইচ এর হাতের ছাপ নিয়েছি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোনো হাতের ছাপ পাওয়া যায় নি। খুনি গ্লাভস অথবা অন্য কিছু ব্যবহার করে সুইচ অফ করেছে। মারাত্মক বুদ্ধি বলা যায়।’
ঘরের প্রত্যেক টা সদস্য চুপ করে সবটা বিশ্লেষণ শুনলো। মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘দেখুন কিছু পাওয়া যায় কি-না। খুবই নৃশংসতা ছিলো খুনের ব্যাপারটায়।’
পুলিশ অফিসার মাথা নাড়ালো তারপর হঠাৎ কিছু মনে হতেই জিজ্ঞেস করল
-‘তা তুমি এখানে কী বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিলে? কোন পক্ষের হয়ে এসেছিলে?’
-‘এইতো আঙ্কেল কন্যাপক্ষেরই ছিলাম। বিদ্যুৎ যাওয়ার পরপরই আমরা এসেছিলাম।’
পুলিশ অফিসার চোখ ছোট ছোট করে বললেন
-‘তাহলে সন্দেহের তালিকা থেকে তুমিও বাদ যাচ্ছো না ইয়াং ম্যান।’
মেঘ কেবল বাঁকা হেসে মাথা নাড়ালো।মেঘই খুন হওয়ার পরপর পুলিশকে কল দিয়েছিলো।পুলিশ অফিসার তার এক বন্ধুর বাবা।
দুপুরের মতন হৈ হুল্লোড় এখন আর নেই। সব যে যার মতন চলে গেছে নিজেদের গন্তব্যে। ফুপি ও ফুপাও চলে গেছেন,সাথে সুখের চাচা চাচী, চাচাতো ভাইবোন ও গিয়েছে। বাড়িতে কেবল রয়ে গেছে লীলা,লীলার মা,সুখ,দাদীজান। সন্ধ্যার দিকে অনুর মা অসুস্থ হওয়ায় অনু আর হিমা চলে যায়। আর, মেঘকে সুখই চলে যেতে বলে। মেঘ জোড় করলেও সুখের কথার উপর কথা বলার ভরসা পায় না।
এখন সুখের ঘরে সুখ আর লীলা বসে আছে। মাথার উপর ফ্যান টা অদ্ভুত শব্দ করে ঘুরছে। ভয়ঙ্কর নিরবতায় এ শব্দটা জেনো বেশ জোড়েই শোনাচ্ছে। সেই দুপুর হতে এ অব্দি দাদীজান সুখের রুমে পা রাখেন নি। দাদীজানের কথা অব্দি শোনা যায় নি। সুখের খারাপ লাগছে, ভীষণ খারাপ। তবে কী দাদীজানও মুখ ফিরিয়ে নিলো?
হঠাৎই নিরবতা ভেদ করে কারো পদধ্বনি শোনা গেলো।সুখ আর লীলা দু’জনই দরজার দিকে তাকাতে দেখলো লীলার মা সানজিদা বেগম তাদের রুমে উপস্থিত সাথে দাদীজানও। দাদীজানের মুখমন্ডলে কেমন নিষ্প্রাণতা। সুখ কেবল তাকিয়ে রইল দাদীজানের পানে। একটু স্নেহের আশায় হয়তো।
সানজিদা বেগম সুখের কাছে এগিয়ে এলো। আজকে তার কন্ঠে রুক্ষতা নেই, তবে আছে গাম্ভীর্যতা। বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘আমি নাকি মা হয়ে উঠতে পারি নি সুখ?’
হঠাৎ সানজিদা বেগমের এহেন প্রশ্নে উপস্থিত তিনজনই অবাক হলো।কী জবাব দিবে ভেবে না পেয়ে সুখ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। সানজিদা বেগম একই সুরে আবার বললেন
-‘কী হলো বল, আমি কী সত্যিই মা হয়ে উঠতে পারি নি?’
সুখ ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘আপনাকে কে বলেছে এসব আম্মা? আপনি তো পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা।’
সানজিদা বেগম তাচ্ছিল্য হাসলো। চোখের কোণায় অশ্র ঝিলিক দিয়ে উঠলো বোধহয়। হাসি বজায় রেখেই বলল
-‘আমি সবচেয়ে ভালো মা? কই তোর দিকে তো কখনো ফিরে তাকাই নি।’
-‘আপনি তো লীলাবতীকে ভালোবাসেন। আর সবটাই লীলাবতীর ভালোর জন্য। মায়েরা মাঝে মাঝে স্বার্থপর হয় নিজের সন্তানের জন্য সেক্ষেত্রে আপনিও হয়েছেন। আপনি তো খারাপ মা না। তবে হ্যাঁ, মা হিসেবে আপনি ভালো হলেও মানুষ হিসেবে আপনি কেমন সেটা বলার অপেক্ষা থাকে না।’
সুখের এহেন কথায় সানজিদা বেগম কেমন প্রতিক্রিয়া করবে ভেবে উঠতে পারে না। ক্ষানিকটা সময় চুপ থেকে তার বা’হাতে থাকা কাপড়ের ব্যাগ টা সুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
-‘আজ আমি খারাপ মানুষ না, তোর কথা অনুযায়ী একজন ভালো স্বার্থপর মা হয়ে তোর কাছে ভিক্ষা চাইতে আসলাম। এই মুহূর্তে তুই এই বাড়ি ছেড়ে,সব অধিকার ছেড়ে চলে যাবি।’
-‘আমার অপরাধ?’
সুখের প্রশ্নে সানজিদা বেগম চোখের কোণের জলটা মুছে ব্যাগটা সুখের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
-‘তোর এ পৃথিবীতে আসাটাই তোর সবচেয়ে বড় অপরাধ আর দ্বিতীয় অপরাধ তোর ভালোমানুষি। এ বাড়ি থেকে চলে যা। তোর শরীরে বেজন্মা বাচ্চা গর্ভে ধরার যে কলঙ্ক লেগেছে সেটা তোর শরীরেই রাখ। আমার মেয়েটাকে আমার বুক দিয়ে আমি পৃথিবীর বুক থেকে আগলে রাখবো। তুই এই বাড়ি, এ এলাকায় থাকলে সবাই ধীরে ধীরে সব জেনে যাবে। আমার মেয়েকেও আমি এ বাড়ি থেকে দূরে পাঠিয়ে দিবো। নাহয় এ বাড়িরই এ কোণে পরে থাকবে। তুই চলে যা।’
সুখ অবাক কন্ঠে বলল
-‘আম্মা আপনি এসব জানলেন কীভাবে?’
-‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না। তোর উপর অবিচার করেছি তাই এই পাপের বোঝা আমার উপর পড়েছে। কাল লীলুই বলেছে সবটা আমাকে। এই ধাক্কা আমার সহ্য করতে একটা দিন লেগেছে। তুই চলে যা। মায়ের শেষ আবদারটা রাখ।’
সানজিদা বেগম এর কথার পরিপ্রেক্ষিতে কী বলা উচিত সুখের জানা নেই। কেবল ব্যাগ টা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, লীলাবতী বাঁধা দিতে গেলে সুখ থামিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেইট পাড় হয়ে আঁধারময় রাস্তায় নেমে এলো। তার পিছে পিছে আসলো বিধবা বৃদ্ধা মনোয়ারা। সুখ রাস্তায় পা রেখে পিছে তাকালো। বৃদ্ধ মনোয়ারা বেগম অশ্রু ভেজা চোখে তাকিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল
-‘পোঁড়া কপাল নিয়া পৃথিবীতে আইছিলা এবার লইড়া যাও। যত দ্রুত পারবা আমারে এই পাপের মহল থেইকা নিয়া যাইবা। মনে রাখবা এই দ্বারের খিল খুইলা এক অভাগিনী বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে তোমার ফেরার অপেক্ষায়। জীবন যুদ্ধ জয়ী হইয়া ফিইরো।’
সুখ টলমল চোখে দাদীজান আর শখের বাড়িটা পিছে ফেলে ধীর গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। উপরওয়ালা একটা বাড়িছাড়া করেছে তাকে, কিন্তু মানুষ তো জানেনা এবার পুরো পৃথিবীটাই সুখের। একা বৃদ্ধা টলমলে চোখে দরজা ধরে আঁধারে দাঁড়িয়ে রইল। একা যুবতী হেঁটে যাচ্ছে গন্তব্যহীন পথে। এই কোটি কোটি মানুষের পৃথিবীতে এই দু’জন নারী বড্ড একা। একদম কূল কিনারা বিহীন। এক নারীর শেষ সম্বল দাদীজানকে হারিয়ে নতুন গন্তব্যের খুঁজে যাচ্ছে, আরেক নারী গন্তব্যহীন নারীর পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজা ধরে। মাঝে মাঝে পৃথিবীতে মানুষ গুলো এত অসহায় কেনো হয়ে যায়? বৃদ্ধা আর তরুনীর মাঝে আজ তফাত নাই। পুরো পৃথিবীতে তারা বড্ড একা,ভীষণ একা। তাদের সঙ্গী হয়ে আদৌও আসবে কেউ? ভালো হওয়ার শাস্তি হিসেবে কী গন্তব্যহীন পথ হলো সুখের ভবিষ্যত?
~”একা মানুষ চলে পথান্তরে,ভেঙে নিয়মের বাঁধ,,
এই পৃথিবীতে ভালো হওয়াটা বুঝি,বড্ড অপরাধ?”
#চলবে