কবুল বলার ঠিক আগ মুহূর্তে পাত্র বিয়ের আসর থেকে উঠে দাঁড়ালো আর বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে অস্বাভাবিক কথা উচ্চারণ করে বলল
-‘এ বিয়েটা আমি করবো না।’
ব্যস,পাত্রের বলা একটা বাক্য পুরো বিয়ে বাড়ির জাঁকজমকপূর্ণ আনন্দটাকে নিরব করে দিতে সক্ষম হলো।মানুষ অদ্ভুত বা ভুল কিছু শুনে ফেলেছে এমন মুখ করে রইল।বাড়ির সব মানুষই পাত্রের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চাইল এমনকি পাত্রীও।লাল বেনারসী পড়া চোখে এক আকাশ ঝলমলে স্বপ্ন নিয়ে বসে থাকা তরুণীর স্বপ্ন গুলো জেনো হঠাৎ করেই নিকষ কালো আধাঁরে পরিণত হলো।পাত্রীর বাবা আজাদ শেখ ছুটে আসলেন,ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন
-‘বাবা আমাদের পরিচালনায় কী ভুল হয়েছে বলো আমরা শুধরে নিবো তবুও এসব কথা বলো না।’
পাত্র ততক্ষণে মাথার পাগড়ী খুলে ফেলেছে।এবার পাত্র আজাদ শেখের দিকে দু’কদম এগিয়ে গিয়ে বলল
-‘ও আপনার মেয়ে হয়েছে সেটাই ওর জীবনের বড় ভুল।আর এই ভুলের মাশুল দিবে ও চিরকাল।
আজাদ শেখ অবাক কন্ঠে বললেন
-‘আমার মেয়ে হয়েছে সেটা ওর ভুল, মানে?তুমি কী বলছো মসৃন? হুট করে এমন সময় এসব কথা তো মোটেও যুক্তিযুক্ত না।আচ্ছা আমরা সব কথা পরে আলোচনা করি,নিরিবিলিতে? আগে বিয়েটা হোক?’
মসৃন নামের ছেলেটা মাথা দু’পাশে দুলিয়ে বলল
-‘এ বিয়েটা আর হবে না সেটা শুনেন নি হবে হবে করেও না হওয়া শ্বশুর মশাই? এখন বিয়ের আসরে বসা আপনার এই বিয়ে ভেঙে যাওয়া মেয়েটাকে কে বিয়ে করবে সেটাও আমি দেখি।আপনিও বুঝেন একটা বাবার মেয়েকে বিয়ের আসরে বিয়ে না করে ফেলে যাওয়া টা কোন ধরনের কাজ।’
আজাদ শেখ থমকে গেলেন সাথে চমকেও গেলেন।বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন
-‘তু তুমি কে?’
মসৃন বাঁকা হাসলো,মুখে সেই হাসি বজায় রেখেই বলল
-‘একদিন যে মানুষটাকে আপনি বিয়ের আসরে বসিয়ে চলে এসেছিলেন আমি তারই বোনের ছেলে।আমার খালামনি রেহানা।নাম টা মনে আছে তো?’
আজাদ শেখ দু’কদম পিছিয়ে গেলেন।বুকের মাঝে ভীষণ চাঁপ অনুভব হলো জেনো।তার ভাই-বোনেরা এগিয়ে আসলো।আজাদ শেখকে ধরে বসালো চেয়ারে।আজাদ শেখের অতীত মনে পড়লো,এমনই এক রাতে বিয়ে বাড়িতে আলোকসজ্জায় ভরপুর,চারপাশে হৈচৈ, লাল বেনারসী পড়ে একটা ষোলো কিংবা সতেরো বছরের তরুণী হাজার খানেক স্বপ্ন চোখে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিলো সে ছিলো সেই তরুণীর স্বপ্ন পূরণের সাথী কিন্তু শেষ অব্দি বিয়েটা হয় নি।বিয়ের আসরে এক স্বপ্ন ভাঙা তরুণীকে ফেলে সে চলে এসেছিলো নিজের বাবা চাচার হাত ধরে। কখনো আর ফেলে আশা নিস্তব্ধ তরুনীর খোঁজ নেয় নি,স্বপ্ন ভাঙা তরুনীর শেষ পরিহাস কখনো ফিরে দেখার প্রয়োজন বোধ করে নি কিন্তু আজ সেই পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগের অতীত তার সামনে নিষ্ঠুর বর্তমান হয়ে দাঁড়ালো?
আজাদ শেখ উঠে দাঁড়ালো, মেয়ের হবু জামাইয়ের সামনে দু’হাত জোড় করে বলল
-‘বাবা সে তো অনেক বছর আগের কাহিনী, তখন পরিস্থিতি প্রেক্ষাপট ছিলো ভিন্ন আর আজ আরেক রকম।সেই ঘটনার উপর ভিত্তি করে তো তুমি এসব বলতে পারো না,আমার মেয়ের এত বড় ক্ষতিটা করো না। তাহলে তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য রইল কী?’
এবার বরের বেশে থাকা ছেলেটা একবার কনের দিকে তাকালো, বেশ কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত স্বরে বলল
-‘সুখোবতী আমায় ক্ষমা করে দিও।আমি এতীম না আমার বাবা,মা,ভাই-বোন সব আছে।আর আছে আমার পরিবারের সবচেয়ে দুঃখী সদস্য ছোটমা যাকে তোমার বাবা অনেক বছর আগে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে,রঙিন বসন্ত এনে দিয়েছিলো কিন্তু কেবল মাত্র আমার নানা যৌতুক দিতে পারে নি বলে সেই স্বপ্নকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ভেঙে দিয়ে চলে এসেছিলো।যখন আমার ছোটমায়ের এমন ধ্বংসাত্মক অতীতের কথা শুনলাম তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারি নি তাই তোমার বাবার এই ভুলের মাশুল দিবে তুমি।’
বিয়ের কনে সুখ কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না কেবল ফ্যালফ্যাল করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।এবার আজাদ শেখ হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো মসৃনের সামনে, দু’চোখের অশ্রু ঝড়িয়ে অপরাধী কন্ঠে বলল
-‘এসবই তো তোমার জন্মের আগের কথা।তুমি বা সুখ কেউই তখন ছিলে না আর এতে তো সুখের কোনো দোষ নেই তাহলে শাস্তি কেনো ওকে দিবে?’
-‘ওকে শাস্তি দিলেই তো আপনি যন্ত্রণা পাবেন।সেই নিকৃষ্ট কাজের অনুশোচনা তো এ অব্দি করেন নি আজ সময় হয়েছে অনুশোচনা করার।যে মেয়েটাকে বেঁচে থেকেও মৃত বানিয়ে দিয়েছেন, যার বাবা মেয়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়েছিল তাদের সবার হয়ে আজ আমি প্রতিশোধ পূরণ করলাম।সামান্য টাকার কাছে হেরে গিয়েছিলো এক গরীব বাবা,স্বপ্ন দেখা এক তরুণী। আজ আপনার তো যথেষ্ট সামর্থ আছে দেখি কী করতে পারেন।’
বর আর দাড়ালো না বিয়ে বাড়িতে।ধপধপ পায়ে খুব দ্রুতই বিয়ে বাড়ির গেইট থেকে বেরিয়ে গেলো।সুখোবতী কেবল গেইটের পানে চেয়ে রইল।একটা মানুষ এত নিঁখুত অভিনয় করতে পারে মসৃনকে না দেখলে জানতেই পারতো না।বিয়ের আগে সে সুখের পিছে কতদিন ঘুরলো,তার দিন দুনিয়ায় কেউ নেই বলে দয়া মায়া কুড়ালো অবশেষে সেই সুদর্শন মানবের জন্য যখন সুখের মন গললো তখনই এই ধাক্কা টা পেতে হলো?
বিয়ের আসরে যখন চাপা গুঞ্জনে ভরে গেলো তখন কেউ ঠাস করে চড় বসালো সুখের গালে।সুখ চমকে উঠলো সাথে সাথে চমকে উঠলো উপস্থিত প্রত্যেক টা মানুষ।যে মেয়েটার সদ্য বিয়ে ভাঙলো তাকে কোন মানুষ এভাবে চড় দিতে পারে? সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে চড় দেওয়া ব্যাক্তিটার দিকে তাকালো।মানুষটা আর কেউ না সুখের সৎমা সানজিদা বেগম।
সানজিদা বেগম সুখের হাতটা ধরে টেনে দাঁড় করালো।দুই গালে আরও দু চারটে চড় বসিয়ে হিংস্র কন্ঠে বলল
-‘অপয়া,অলক্ষী মেয়ে।জানতাম তোর কপালে ভালো কিছু নেই।মান ইজ্জত সব গেলো।এখনো এখানে বসে আছিস কোন মুখে? লজ্জা শরম নেই বুঝি তোর? যা গলায় দড়ি দিয়ে মর।’
সুখ তার টানা টানা ডাগর আঁখি যুগল বাবার পানে নিবদ্ধ করে। সেই আঁখিতে জেনো রাজ্যের বিষন্নতা আর অসহায়ত্ব।আজাদ শেখ মেয়ের দৃষ্টির মানে বুঝতে পারেন।ছুটে আসে মেয়ের কাছে,বুকে জড়িয়ে নেন মেয়েকে।দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় বাবা জেনো তিনি।ছোট্ট মানুষের মতন কেঁদে উঠে বাবা আর আহাজারি করে বলে
-‘আজ সব আমার জন্য হলো মা।আমায় তুই ক্ষমা করিস।তোর বাবা দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় আর অপরাধী বাবা যার নিজের ভুলের জন্য সন্তানের জীবনটা শেষ।এই পাপের কোনো ক্ষমা হয় না।সেদিন আমি সেই তরুণী আর তার বাবার দুঃখ অনুভব করতে পারি নি তাই আজ আমার উপরওয়ালা আমাকে তা অনুভব করিয়ে দিলো।এই পোড়া মুখ, এই লজ্জা আমি ঢাকবো কেমন করে মা? এই মানুষের যে ধীক্কার পাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’
সুখের চোখ জেনো পানিশূন্যতায় আক্রান্ত। এত বড় ধাক্কা টা তাকে বোধহয় পাথর বানিয়ে দিলো।সুখের ফুপি সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনার স্বরে বলল
-‘তুই চিন্তা করিস না সুখপাখি আমরা এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করবো।ওর বিরুদ্ধে আমরা মামলা করবো।একটা মেয়েকে বিয়ের আসরে বসিয়ে,বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে মাঝ পথে ছেড়ে যাওয়াটা অন্যায়।এর বিরুদ্ধে আমরা আইনি স্টেপ নিবো।আমাদেরকে মিথ্যে বলে ভুলিয়েছে সেই ছেলে।বাবা মা পরিবার থাকা স্বত্তেও নিজেকে এতিম দাবী করেছিলো সবকিছুর বিরুদ্ধে মামলা করবো।’
এতক্ষণ বাকশূণ্য হয়ে থাকা সুখের মুখে বুলি ফুটলো।বুলি গুলো এত ধারালো ছিলো যে ক্ষতবিক্ষত করে দিলো উপস্থিত সকলের অন্তর।ভীষণ করুন স্বরে সুখ বলল
-‘পুলিশকে ঠিক কি বলবে ফুপি? একটা ছেলে তোমাদের কাছে এসে নিজেকে এতিম দাবি করে কতগুলো মিষ্টি কথা বলতেই তোমরা কিছু যাচাই-বাছাই না করেই নিজের মেয়েকে তার গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিলে?আর ছেলেটা কেনো তোমাদের মেয়েকে বিয়ে করে নি,কারণ মেয়ের বাবাও কত বছর আগে তার খালামনিকে বিয়ের আসরে রেখে যৌতুক না দিতে পারায় বিয়ে ভেঙে চলে এসেছিলো।তাহলে ফুপি দোষের পাল্লা কারটা বেশি ভারী একটু বলবে?’
নিস্তব্ধ হয়ে গেলো চারপাশ। সুখের সৎমা বেধড়ক মারধর শুরু করলো সুখের উপর।সবাই যখন মারধর ঠেকাতে ব্যস্ত তখন সুখের ছোট সৎবোন ছুটে এসে চিৎকার দিয়ে বলল
-‘আম্মু আপাই তাড়াতাড়ি আসো আব্বা জেনো কেমন করছে।’
সবাই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। আজাদ শেখ তো মাত্রই এখানে ছিলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখে আজাদ শেখ কোথাও নেই।সবার প্রথম সুখই ছুট লাগায় বাবার ঘরে।সুখের পিছে পিছে ছুটলো সবাই।
আজাদ শেখের মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে আর নিথর দেহটা পড়ে আছে মাটিতে হাতে একটা ছোট্ট কাগজ যেখানে লিখা
-‘স্বাধ করে মেয়ের নাম রেখেছিলাম সুখ।কিন্তু মেয়ে জন্মের পর পাঁচমাসের ছোট্ট মেয়েটাকে ফেলে তার মা পালিয়ে গেলো।সুখের জীবনকে সুখে ভরপুর করার জন্য আনলাম সৎমা যার কৃপায় সুখের জীবন সুখহীনতায় ভরে উঠলো।আজ আবারও আমার পাপের ফলের জন্য মেয়েটার জীবনে কলঙ্ক লেগে গেলো। মেয়ের জীবনটা হয়ে গেলো সুখের অ-সুখ।’
সুখ বাবার দেহের পানে তাকালো।পৃথিবীতে সব থেকে বেশি ভালোবাসা মানুষটাও আজ বিদায় নিলো? বটগাছের ছায়া বিহীন সুখ টিকবে তো? না সুখহীনতার গল্পে ভরে উঠবে সুখোবতীর নির্মম জীবন।
#চলবে
#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা