#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১২
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
রাগে শরীর রিরি করছে ইমনের। মুসকানের ধারে কাছে ভিন্ন কোন পুরুষ’কে সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। যতোই মুসকানের সামনে তীব্র প্রতিবাদ না করুক তবুও মন থেকে কখনোই সে মানতে পারবেনা মুসকানের এক ঝাঁক ছেলে বন্ধু রয়েছে। হ্যাঁ তার হয়তো মেয়ে বন্ধু রয়েছে তবুও মুসকানের পাশে কোন ছেলে বন্ধু’কে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। বিষয়’টা অনেকটা স্বার্থপরতা হলেও পারছে না ইমন৷ এর উপযুক্ত কারণ এটা ধরে নেওয়া যায় মুসকানের বয়সটা অল্প। এ বয়সটা চোখে রঙিন চশমা পড়ে থাকার মতোনই। নির্দ্বিধায় মুসকান ভালো পরিবারের মেয়ে কিন্তু তার বয়সটা নিতান্তই কম। মুসকান কেবল তার চোখে একটি বাচ্চা শিশু অবুঝ শিশুর মতোনই যার দ্বারা যে কোন সময় ভুল হয়ে যেতে পারে দোষটা তাকে সে তার বয়সের দেবে। দেবে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সেই সাথে দোষী হবে সে নিজে এবং মুরাদ। তাই মুসকান যেনো বিপদগামী না হয় সেজন্য সর্বক্ষণ তৎপর থাকতে হবে৷ এতোদিন মুরাদ, দিহানের ভরসায় রাখলেও তারা কেউ পুরোপুরি মুসকানের টেককেয়ার করতে পারেনি। পারবে কি করে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ ব্যাতিত এই টেককেয়ার কেউ করতে পারবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি ঘুরিয়ে ভার্সিটির সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ইমন৷ সাত মিনিটের মাথায় রিকশা এসে থামে ভার্সিটির সামনে। মুসকান নামার পূর্বেই মিতুল তার ভারা দিয়ে দেয়। মুসকান নিষেধ করতে গিয়েও করতে পারেনা। তারপর তারা এক সঙ্গেই ভার্সিটির গেটের দিকে যেতে নেয়। তখনি কর্ণকুহরে ভেসে ওঠে দৃঢ়, গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ। যে কন্ঠে কেবল একটি শব্দই শুনতে পাওয়া যায় “মুসকান” মুসকানের পুরো শরীর শিউরে ওঠে সে পিছন ঘুরার পূর্বেই মিতুল ভ্রু কুঁচকে পিছন ঘুরে জিগ্যেস করে,
” কে আপনি? ”
চোয়ালজোড়া দৃঢ় হতে শুরু করে ইমনের। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি’তে কেবল সম্মুখে তাকিয়ে থাকে। মুসকান শঙ্কিত হয়ে ইমনের দিকে ঘুরে এক ঢোক গিলে প্রশ্ন করে,
“নানাভাই তুমি!”
মিতুল আচমকাই মুখ টিপে হেসে ফেলে। মুসকান’কে জিগ্যেস করে,
“ইনি তোমার নানাভাই? কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে বড়ো ভাই সে যাহোক আসসালামু আলাইকুম নানা।”
দু’হাত মুঠো বন্দি করে ফেলে ইমন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে থাকে মুসকানের দিকে। মনে মনে সালাম ফেরালেও প্রকাশ্যে মিতুলের দিকে ফিরেও তাকায় না৷ যেহেতু মুসকানের রিলেটিভ সেহেতু মিতুল আলাপ জমাতে হ্যালো বলে হাত বাড়িয়ে দেয়। মেজাজ এবার অসহ্য রকমের গরম হয়ে যায় ইমনের তাই মিতুলের দিকে এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেয় যে ভয়ে গলা শুকিয়ে বক্ষঃস্থলও কেঁপে ওঠে। হাত ফিরিয়ে নিয়ে ক্লাস আছে বলেই মিতুল ঢুকে যায় ভার্সিটির ভিতরে। মুসকান তখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইমন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“গাড়িতে গিয়ে বসবি একটা কথা বাড়াবি তো সকলের সামনে থাপড়াতে শুরু করবো। ”
চমকে তাকায় মুসকান থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে পা বাড়ায় গাড়ির দিকে। ইমনও দেরী করে না দ্রুতগতিতে গিয়ে গাড়িতে ওঠে বসে। রক্তিম দৃষ্টিজোরা রাস্তার দিকে নিক্ষেপ করে গাড়ির হুইলে হাতজোড়া স্থির করে প্রশ্ন করে,
” ছেলেটা তোর ক্লাসমেট? ”
মুসকানের অন্তরে যেনো কেউ সুঁচ ফুটিয়ে দিলো প্রশ্নটা ঠিক এমনই ছিলো৷ কারণ মিতুল তো সিনিয়র বড়ো ভাই ক্লাস মেট নয় এটা শুনলে ইমনের রিয়্যাকশন ভয়াবহ হবে তা সে খুব ভালো করেই জানে। ক্লাসমেট হলে ছাড় পেতো কিন্তু এবার কি ছাড় পাবে? পরোক্ষণেই ভাবলো তার কি পরিচিত থাকতে পারেনা? এই সিম্পল একটা বিষয়ে এতো রিয়্যাক্ট করার কি আছে। মনের সঙ্গে কথোপকথন সেরে মুসকান নিম্ন স্বরে জবাব দিলো,
” না ভার্সিটির বড়ো ভাই। ”
দু’চোখ বদ্ধ করে নিজের রাগটা সংবরণ করার চেষ্টা করলো ইমন। বললো,
“আমি বলেছিলাম যখন যেখানে যে কাজে বের হবি অন্তত পক্ষে একটা টেক্সট দিবি। ”
ভার্সিটি বলে জানায়নি এটিই উত্তর দেওয়ার জন্য মুসকান বলতে নিলো,
” আসলে ভার্সিটি তাই…”
ইমন তৎক্ষনাৎ ক্রুদ্ধ গলায় জিগ্যেস করলো,
“আমি বলেছিলাম কিনা? ”
” হ্যাঁ বলেছিলে কিন্তু ভার্সিটি বলেই জানাইনি৷ আর দেখো নানাভাই মিতুল ভাই মাঝরাস্তা থেকে রিকশায় ওঠেছে। আমার কিছু করার ছিলো না। বিনাদোষে আমার সাথে খারাপ আচরণ করবে না। আমার এসব ভালো লাগে না। ”
ক্রোধে ফেটে পড়লো ইমন বদ্ধ গাড়িতে ভেতরকার অবস্থা সম্পর্কে কেউ অবগত নয়। শুধু একজোড়া মানব-মানবীই জানে তাদের একে অপরের সঙ্গে কি পরিমাণ সংঘাত চলছে! দু’হাতে প্রচণ্ড শক্ত করে মুসকানের কাঁধ চেপে ধরলো ইমন। নিচু স্বরে কাঠিন্য গলায় প্রশ্ন করলো,
” জনসম্মুখে নানাভাই বলতে বলেছিলাম? বাড়িতে এসব সহ্য করি বলে রাস্তা ঘাটে এসব সহ্য করবো? এই আমার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কি বল, বল আমার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কি? ”
কেঁপে ওঠলো মুসকান সশব্দে এক ঢোক গিলে শঙ্কিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো। ইমন দু’হাতে জোর বাড়িয়ে আবার ঝাঁকিয়ে বললো,
” বল স্পিকআউট।”
দুচোখ বেয়ে বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হলো মুসকানের। নিঃশ্বাস হয়ে গেলো তীব্র। কিন্তু ইমন নিজেকে সংযত করতে পারছে না৷ আবার মুসকানের চোখের পানিও সহ্য করার ক্ষমতা নেই। তাই মুসকানকে ছেড়ে দিয়ে হুইলে মৃদু ঘুষি দিয়ে বললো,
” ডেম ইট। ”
পরপরই আবার মুসকানের কাঁধ চেপে ধরলো৷ একদম কাছে গিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
” আমার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কি এই উত্তরটাই দিতে পারিস না? তাহলে আমাকেই দায়িত্ব’টা নিতে হবে আজ এই মূহর্ত থেকে প্রতিটা সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে তুই ফিল করতে বাধ্য ইমন চৌধুরী’র সঙ্গে এক্সএক্টলি তোর রিলেশনটা কি! ”
ভয়ে ক্ষণে ক্ষণে গা শিউরে ওঠছে মুসকানের। ইমন তো তার সঙ্গে এতো খারাপ আচরণ কখনোই করেনি। তাহলে আজ কেনো এতো হার্ড হচ্ছে তার প্রতি, কি এমন করেছে সে? ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে মুসকান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকিয়ে শক্ত হাতের বাঁধন থেকে ছোটার চেষ্টা করছে। ব্যাথায় কাঁধ জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে ইমন সশব্দে শ্বাস নিতে নিতে ধীর গতিতে মুখ এগোচ্ছে তার দিকে। বদ্ধ ডোরের সাথে পিঠ ঠেকতেই শেষ পর্যায়ে ভয়ে খিঁচ মেরে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছিলো মুসকান। ইমন ওর অমন অবস্থা দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েও পারলোনা। নিজের ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা তার কোমল ওষ্ঠজোড়া দখল করে নিলো। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ছেড়েও দিলো। মুসকান তখন বদ্ধ শ্বাস ছেড়ে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে ইমন এক পলক তার মুখোশ্রী দেখে নিয়ে গলার দিকে ওড়না সরিয়ে ঘাড়েও ওষ্ঠ ছুঁইয়িয়ে দিলো। সহ্য করতে না পেরে দু’হাতে ইমনের শার্ট আঁকড়ে ধরলো মুসকান। কয়েক পল সময় নিয়ে ইমন এক ঝটকায় সরে গেলো। নিম্ন স্বরে বললো,
” আজ ক্লাস করতে হবে না। ”
মুসকান নিঃশব্দে কাঁদছে। ইমন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। মাথায় তার অনেক চিন্তা সেই সাথে মন মস্তিষ্ক পুরোটা জুড়েই মুসকান’কে নিজের করে পাওয়ার তীব্র নেশা ধরেছে। যেই নেশা পান না করা অবদি সে ক্ষান্ত হবে না। তার শুরু টা বুঝি আজ এখান থেকেই।
.
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে মুসকানের দিকে তাকালো ইমন। মেয়েটার নিঃশ্বাসের প্রতিটা শব্দই যেনো ইমন ইমন ধ্বনি তুলে চারপাশ মুখরিত করে তুলেছে। আর তার প্রশস্ত বুকটায় মিলছে শান্তি, তৃপ্তি। মুসকানের দিকে একটু ঝুঁকতেই আবারো শিউরে ওঠলো মুসকান। ইমন গম্ভীরতা বজায় রেখেই হাত বাড়িয়ে তার মাথায় সুন্দর করে ওড়নাটা চাপিয়ে দিলো,দু’হাতে কোমলীয় চোয়ালজোড়া সন্তর্পণে মুছে দিয়ে কপালে আলতো চুমু খেলো। চোখজোড়া নিবদ্ধ করে শেষ অশ্রুকণা টুকু ঝরালো মুসকান। সঙ্গে সঙ্গে সেটুকুও বলিষ্ঠ হাত দ্বারা মুছে দিলো ইমন। মুসকানের বক্ষঃস্থলের প্রতিটা কম্পনই ইমনকে খুব সুক্ষ্ম ভাবে স্পর্শ করছে। তবুও নিজেকে দৃঢ় রেখে গাড়ি থেকে নেমে মুসকানকে নামতে বললো। মুসকান নিশ্চুপ হয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। ইমনের দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকাতেই ইমন তার হাত আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গেলো ভিতরে।
.
ইরাবতী’র সঙ্গে কথোপকথন শেষে ইমন মুসকান’কে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। ভয়ে আড়ষ্ট মুসকান এবার মাথা ঘুরে বসে পড়লো বিছানায়। ইমন ভ্রুজোড়া কুঁচকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে মুসকানের গালে স্পর্শ করে বললো,
” ঠিক আছিস? ”
সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদে ওঠলো মুসকান। ইমন আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো,
“মেইন প্রবলেম টা কি মুসু? ”
পরোক্ষণেই হুঁশে এলো ইমন তার থেকে এতো কঠোরতা পেয়ে অভ্যস্থ নয় মুসকান। আচমকাই এমন রূপে বেশ ঘাবড়েই গেছে ধরা যায়। ওষ্ঠজোড়া কিঞ্চিৎ চৌকা করে নিশ্বাস ছাড়লো ইমন। মৃদু কন্ঠে বললো,
” আমাদের এনগেজমেন্টের জন্য যে শপিংগুলো করেছি সেগুলো দেখাতে নিয়ে এসেছি। আগামীকালই এনগেজমেন্ট হবে আমাদের, এটাই ফাইনাল ডিসিশন আমার। ”
মুসকানের কোন ভাবান্তর হলো না তবে তার কান্না কিছুটা কমে এসেছে। ইমন ওকে ছেড়ে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। পাঁচ’টা শপিং ব্যাগ বের করে এনে রাখলো বিছানায়। মুসকান তখনো মুখ ঢেকেই আছে। ইমন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুসকানের কাছে গিয়ে বসলো। হাত বাড়িয়ে মুসকানের দু’হাত সরিয়ে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কান্না কাটি করে পুরো মুখটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে মুসকানের। সিক্ত ওষ্ঠজোড়া মৃদু কাঁপছে। এক কোণায় কিছুটা রক্তজমাটও বেঁধে আছে। ইমন নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে সে এক কোণায় আলতো স্পর্শ করলো। চোখ বুজে ফেললো মুসকান। নিচু সুরে বললো,
” আমি কোন অন্যায় করিনি নানাভাই। ”
” বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে কেবলমাত্র ডাকাতরাই বলতে পারে আমি কোন অন্যায় করিনি,আমি কোন অন্যায় করছিনা। ”
মুসকান নিঃশব্দে বসে রইলো ইমন বিরক্তি ভঙ্গিতে পাশের শপিং ব্যাগ গুলো সামনে এনে বললো,
” সবগুলা খুলে খুলে দেখবি কালকের জন্য এই পাঁচটার মধ্যে একটা চয়েজ করবি। আর হ্যাঁ কাল থেকে তুই আমার বাগদত্তা সো আমার পারমিশন ব্যাতিত এক পা’ও নড়া চলবে না। ”
” আমি ব্যাক্তিত্বহীন হয়ে থাকতে পারবো না। ”
” স্বামীর পারমিশন নিয়ে চলাফেরা করলে কোন স্ত্রী ব্যাক্তিত্বহীন হয়ে যায় না। বেশী কথা বলবি খুব খারাপ হবে মুসু। ”
মুসকান এতো কিছুর মাঝেও শেষ ত্যাড়ামিটুকু করলো বললো,
” বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না। ”
বাঁকা হেসে ইমন বললো,
“তাহলেতো বিয়ের পাঠ কাল চুকাতেই হয় ”
চলবে….
এবার ইমন মুসকানের বিয়েটা বেশ বড়োসড়ো অনুষ্ঠান করেই দিবো ভেবেছি। ইনভাইটেশন কার্ড তৈরী হচ্ছে সবাই পেয়ে যাবে আশা করি।