হৃৎপিণ্ড_২ ( দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ) পর্ব ১৩

0
357

#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৩
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
ইমনের নেওয়া হুটহাট সিদ্ধান্ত গুলোর কোন মাথা মুণ্ডু খুঁজে পায় না তার পরিবার এবং বন্ধু বান্ধব’রা। তবুও সকলেই সিদ্ধান্ত গুলো মানতে বাধ্য হয়। কারণ সে যে একরোখা, জেদি, ভীষণ রাগী। তাকে ঘাটাতে গেলে সবকিছুই হিতে বিপরীত হয়ে যায়। তাই কেউ বাড়তি কোন বাক্য ব্যয় করেনি। সবটা এক কথায় মেনে নিয়েছে। সে হিসেবেই পরেরদিন সকাল থেকে এনগেজমেন্টের তোরজোর চলছে। আত্মীয় স্বজন বলতে দু’পরিবারের সদস্য আর বন্ধু দিহান এবং সায়রী৷ ইতোমধ্যে দু’পরিবারের সকল আত্মীয় স্বজন’কে জানানো হয়ে গেছে আজ এনগেজমেন্ট আর সামনে মাসের আট তারিখ তাদের বিয়ে। সঠিক সময় সকলের কাছে ইনভাইটেশন কার্ড ঠিক পৌঁছে যাবে। মেহেন্দি অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ,বিয়ে, বউভাত থেকে শুরু করে ঘটা করে হানিমুন সবটাই হবে। এতো কল্পনা জল্পনা শেষে বিয়ে, বিয়ের মতো বিয়ে না হলে চলে? তারওপর বন্ধু বান্ধবীদের মধ্যে শেষ সেই বিয়ে করছে। সকলের কাছে অবশ্যই স্মরণীয় একটা বিয়ে হওয়া চাই। ইমন চৌধুরী ম্যারিড উইথ মুসকান জান্নাত। এটা কি সাধারণ কোন বিষয় নাকি? আর কার কাছে বিষয় টা কেমন জানেনা ইমন তবে তার কাছে পুরো পৃথিবী জয় করার চেয়েও কঠিন। কারণ সে যে কারো মনের পৃথিবী জয় করেছে আর কেউ তার মনের! এ পৃথিবী জয় করা কি সহজ কথা নাকি?

মুরাদ’দের বাড়িতে সবাই রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। দিহান সকালে এসে মুরাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব বাজার করে সেই যে বাড়ি গেছে আর একবারো এ বাড়ি মুখো হয়নি৷ মুরাদের কলটা অবদি ধরছে না। বাধ্য হয়ে সায়রীকে কল করলো মুরাদ কিন্তু সে একি কাহিনী রিং হয়েই যাচ্ছে তো হয়েই যাচ্ছে কেউ ধরার নাম নেই। রেগেমেগে ইমন’কে ফোন করে একচোট গালাগাল করলো মুরাদ। ইমন উচ্চস্বরে হেসে বললো,

“এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? নিশ্চয়ই বিজি আছে দুপুরের দিকে ঠিক এসে যাবে। ”

মুরাদ প্রচন্ড ক্ষেপে বললো,

” ঐ শালা আর শালার বউরে আর একটা ফোন দিমু না আমি। বলছিলাম দু’জনই জানি সকাল থেকে এ বাড়ি থাকে বা*রা এখনও আসতে পারলো না। ”

অসহ্য রকমের ক্রুদ্ধ হয়ে ফোন কাটলো মুরাদ৷ ইমন সে মূহুর্তেই দিহান আর সায়রী’কে ফোন করলো কিন্তু কেউই কোন রেসপন্স করলো না।
.
মুসকানের মা আর চাচি মিলেই সব রান্নাবান্না করছে। রিমি টুকটাক সহায়তা করছে। ইমনের আবদার বা আদেশ হিসেবে মুসকান’কে অন্তত পক্ষে একটা আইটেম বানাতে বলেছে। তবে সে টুকু আবদার বা আদেশ করে বেচারা ততোক্ষণ স্বস্তি পায়নি যতোক্ষণ না আইটেম টা রান্না করা শেষ হয়। নিজ হাতে চিকেন রোস্ট তৈরী করেছে মুসকান। সে যতোক্ষণ রান্নাঘরে ছিলো ততোক্ষণই রিমিকে জ্বালিয়ে মেরেছে ইমন৷ এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে রিমি বলেই ফেলে,

” তা ভাইয়া আপনি তিনটা বছর বিদেশে টিকলেন কি করে! ”

সে কথায় কিছুটা লজ্জা পেলেও নিজের স্বভাব স্বরূপ গম্ভীর্য বরণ করে উত্তর দেয়,

” এ প্রশ্নের সঠিক জবাব আমার থেকে তোমার হাজব্যান্ড ভালো দিতে পারবে। ”

সবটা খুব ভালো মতোনই জানে রিমি তবুও ঠাট্রা করার সম্পর্কে ঠাট্টার সুযোগ টা মিস দেয়নি।
.
বারোটা বাজে মুসকান গোসল শেষ করে বিছানায় বসে ফ্রেন্ডদের ফোন করছে। সবাইকে ফোন করে করে তারা কখন আসবে এখনো এসে পৌঁছালো না কেন সেই অভিযোগই করছে। রিমি তার পিছনে বসে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুলগুলো শুকাচ্ছে। শেষ কলে পূজার সঙ্গে কথা শেষ করে ফোন কাটতেই ইমনের কল এলো। বক্ষঃস্থলে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেলো মুসকানের। এক ঢোক গিলে রিসিভ করে কানে দিতেই ইমন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

“একটা মানুষের ফোন এতো ওয়েটিং কিভাবে থাকতে পারে? প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্যও কি তোকে পাওয়া যাবে কি হয়ে গেছিসরে তুই!”

মুখটা ভার করে মুসকান বললো,

“ফ্রেন্ডদের ফোন করছিলাম একজনের সঙ্গে কথা বলেই অপরজনকে কল দিয়েছি তাই টানা ওয়েটিং পেয়েছো। ”

“হ্যাঁ তোর তো আবার ফ্রেন্ডদের লিষ্ট বহুত লম্বা। ”

“টিটকারি দেবে না। ”

“শাট আপ! যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনবি, আমার দাদি মানে বাবার ফুপু সে আসবে আমাদের সঙ্গে। মুরুব্বি বলতে বংশের মধ্যে তাকেই আমরা মান্য করি। দাদি যেহেতু কাছে ধীরেই থাকে তাই শুধু তাকে নিয়েই আসছি। ”

চোখ, মুখ শক্ত করে মুসকান জবাব দিলো,

“হুম এটা আমাকে না বলে দাদাভাই কে বললেই হতো। ”

ইমন বুঝলো ধমক খেয়ে মহারানী দারুণ চটে গেছে তাই শান্ত স্বরে বললো,

” বাবা,মায়ের সামনে কমফোর্টেবল থাকবি জানি তোকে না জানিয়ে হুট করে অপরিচিত কাউকে নিয়ে যাবো? আর দাদি তো অবশ্যই ভিতরে গিয়ে তোকে দেখবে নানারকম জিগ্যাসাবাদ করবে তখন যদি আনকমফোর্টেবল ফিল করিস? আমার বউয়ের যেনো কোনো কিছুতে অস্বস্তি বোধ না হয় তা তো আমাকেই দেখতে হবে। নাকি অন্য কেউ এসে দেখে যাবে? ইডিয়ট একটা! রাখছি। ”

ফোন রাখতেই মিশ্রিত অনুভূতি’তে সিক্ত হয়ে গেলো মুসকান। লজ্জায় স্নিগ্ধ গাল দু’টো রক্তিম আভায় ছেয়ে গেলো। রিমি বললো,

“কি রে কি বললো ভাইয়া? ”

মুসকান নিশ্চুপ রইলো। রিমি পিছন থেকে সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিগ্যেস করলো,

” কি ব্যাপার হুম?”

লাজুক হেসে মুসকান বললো,

” তার নাকি কোন দাদি আসবে সেটাই জানালো। ”

“হুম তো বেশ মশলা মাখিয়ে জানিয়েছে বুঝি? ”

মুসকান মুখ ঘুরিয়ে বললো,

” ধুর…সব সময় ইয়ার্কি মারো তুমি। ”
.
মুসকানের বন্ধু’রা ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আর বান্ধবী’রা মুসকানের রুমে বসে তার শাড়ি,গহনা গুলো দেখছে। শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে গলায় একটা ওড়না চাপিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে মুসকান। ইমন ব্রাইডাল ভাবে সাজতে নিষেধ করায় একটুও মেকআপ করেনি সে। রিমি তার চুলগুলো আঁচড়ে দিচ্ছে। হঠাৎ পূজা বলে ওঠলো,

“এই মুসু এনগেজমেন্টে শাড়ি পরবি,মেহেন্দি, গায়ে হলুদ, বিয়ে,বউভাত সব অনুষ্ঠানেই শাড়ি পড়বি এটা কেমন কথা হলো?”

মুসকান কিছু বলার পূর্বেই রিমি বললো,

” ইমন ভাইয়া শাড়িটাই বেশী লাইক করে। আমি বলেছিলাম গর্জিয়াস ল্যাহেঙ্গা বা গাউনের কথা ভাইয়া নাকচ করে দিয়েছে। ”

পূজা কটাক্ষ করে বললো,

“আসলে ভাইয়ার জেনারেশন আর আমাদের জেনারেশন বেশ অনেকটাই গ্যাপ তো তাই উনার পছন্দের সাথে আমাদের মিলবে না। কিন্তু মুসকান’কে যেহেতু বিয়ে করছে সেহেতু ওর দিকটাও চিন্তা করা উচিত ছিলো। ইশ আমাদের মুসুর কপালে ওল্ড ভার্সন জামাইয়ের পাশাপাশি সবই ওল্ড ওল্ড হয়ে যাচ্ছে। ”

স্বর্ণা পূজার পেটে গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

” দোস্ত পঁচাচ্ছিস কেন? মুসু মন খারাপ করবে। ”

পূজা ঠোঁট টিপে হেসে উচ্চকণ্ঠেই বললো,

“তা আমাদের ওল্ড ভার্সন দুলাভাইটি আসবে কখন?”

মুসকান চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললো,

” একদম আন্ডারইস্টিমেট করার ট্রাই করবি না। শাড়ি শুধু তারই পছন্দ নয় শাড়ি আমারও পছন্দ। তাছাড়া বিয়ের জন্য শাড়ির থেকে পারফেক্ট অন্য কিছু হতেই পারেনা। তাই যদি হতো আমার হবু হাজব্যান্ড হাজার টাকার ল্যাহেঙ্গা,গাউন রেখে জার্মান থেকে লাখ টাকার শাড়ি নিয়ে আসতো না। তোর বোধ হয় ইমন চৌধুরী ব্যাপারে জ্ঞান খুবই স্বল্প। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারিস ফলাফল কিন্তু এটাই হবে যে তোদের আপডেট ভার্সন গুলা সব ইমন চৌধুরীর হাঁটুর নিচেই পড়ে থাকে!”

পূজা থমথমে মুখো ভঙ্গিতে জোর পূর্বক হাসির রেখা টানলো,বললো,

“আমি কিন্তু জাষ্ট ফান করছিলাম। বান্ধবী’র সঙ্গে ফান করবো না তো কার সঙ্গে করবো বল। ”

“আমি একদম ফান করিনি রে আমার বান্ধবী মজার ছলেই হোক আর যে ছলেই হোক আমার লাইফ পার্টনার নিয়ে আফসোস করবে আর আমি মেনে নেবো? শোন এতো আফসোস করিস না যে মানুষ টা’কে আমি স্বামী হিসেবে পেতে যাচ্ছি অনেক নারী বহু ত্যাগ, তপস্যা করেও এমন মানুষ’কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পায় না। আমি অনেক সৌভাগ্যবতী তাই এমন একজন মানুষের বুকভরা ভালোবাসা পাচ্ছি, সারাজীবনের জন্য নিজের করে তাকে পেতে চলেছি। এমন ভাগ্য সত্যি সবার হয় না রে। ”

অবাক হয়ে মুসকানের দিকে তাকিয়ে রইলো পূজা। শুধু সে একা নয় রুমের প্রতিটি সদস্যই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওরা শুধু মুসকানকে দেখছে না। দেখছে মুসকানের চোখে, মুখে ফুটে ওঠা কারো প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস’কে। মুসকানের দৃষ্টি’র প্রগাঢ়তাই যেনো বুঝিয়ে দিচ্ছে ইমন চৌধুরী’র প্রতি তার সমস্ত অনুভূতি’কে। ইমনকে নিয়ে মুখে প্রতিটি বাক্য, শব্দ উচ্চারিত হওয়ার সময় তার চেহেরায় যে উজ্জ্বলতা প্রকাশিত হয় তা কেবল এটুকুই বোঝায় মুসকান ইমন চৌধুরী ব্যাতিত কিছুই নয়৷ আর ইমন মুসকান ব্যাতিত কিছুই নয়।

অমন সিরিয়াস একটা সময় রিমি আচমকাই চিল্লিয়ে ওঠলো,

“আল্লাহ তোদের আলাপে আলাপে কতোটা সময় লস হয়ে গেলো। দেখি মুসু আর কথা নয় এবার মুখটা তুই নিজেই সাজিয়ে নে তারপর আমি শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি। ”

সকলের মাঝেই যেনো স্বস্তি ফিরে এলো। মুসকানও মুচকি হেসে দু’হাতে ফেইস পাওডার ডলে তা আবার মুখে ডলতে লাগলো। পূজা বললো,

” তুলি দিয়ে দে হাত দিয়ে লাগবে না। ”

“ধুর আমি এভাবেই দেই শেষে হালকা ফিনিশিং দিবনি। ”

হালকা পাওডার মেখে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে,চোখে কাজল লাগালো মুসকান। স্বর্ণা বললো,

“তোকে তো এতেই ব্রাইডাল লাগছেরে মুসু। ”

রিমি মাথা দুলিয়ে হেসে বললো,

“হুম এজন্যই তো ভাইয়া ব্রাইডাল সাজতে না করেছে। এইটুকু’তেই সে কুপোকাত হয়ে যাবে!”

হিহিহি করে হেসে ওঠলো সবাই। মুসকান কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

“আমি কিন্তু শাড়ি পড়বো না। ”

রিমি ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

” আচ্ছা ভাইয়া এসেই পরাবেনি তুই বরং ওয়েটিংয়ে থাক। ”

পুরো রুমে সবাই হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে এমন সময় ইমনের টেক্সট এলো। মুসকানের ফোন স্বর্ণার হাতে ছিলো তাই সে হৈচৈ বাঁধিয়ে বললো,

“এই এই ভাইয়ারা বেরিয়েছে বেরিয়েছে। ”

বুকের ভিতর ধক করে ওঠলো মুসকানের। নিঃশ্বাস ক্রমশ অস্থির হতে শুরু করলো। কোনরকমে এক ঢোক গিলে মনে মনে বললো,

” আল্লাহ আমাকে শক্তি দাও এতো নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি কেন আমি? ”
.
মেরুন রঙের জর্জেট শাড়িটা যে মুসকানের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ গায়ে এতো সুন্দর মানাবে ভাবতেই পারেনি কেউ৷ শুধু একজনই ভেবেছিলো সে হলো ইমন। তাই তো প্রেয়সীর জন্য বেছে বেছে প্রতিটা স্পেশাল ডে’র জন্য স্পেশাল স্পেশাল শাড়ি ফিক্সড করেছে। চুলগুলো সব পিছনে ছেড়ে দেওয়া। ঘনকালো পাপড়িতে ভরা মায়াবী আঁখি যুগলে লেপ্টে রয়েছে কৃষ্ণবর্ণীয় কাজল। জর্জেট শাড়িটা গায়ে একদম মুড়িয়ে আছে। গলায় ইমনের দেওয়া ডায়মন্ডের নেকলেস,কানে ডায়মন্ডের ছোট্ট ছোট্ট এয়ার রিং ঝলমলে আকার ধারণ করেছে। দু’হাত ভর্তি মেরুন প্লাস হোয়াইট কালারের ব্রাইডাল চুড়ি যেনো তাকে এবং সাজকে স্বয়ংসম্পূর্ণাতে পরিণত করেছে। না জানি আজ ইমন চৌধুরী’র কয়বার হার্ট মিস যায়!আর কিছুর জন্য না হলেও তার মুগ্ধময়ীর লাজুকলতা তার হৃৎপিণ্ড’তে কম্পন ধরাতে বাধ্য করবে।

চলবে…
রিচেক দেইনি। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here