#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৪
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
ইমনের সিক্ত বুকে লেপ্টে রয়েছে মুসকান। দু’জনই দু’জনের আর্দ্র উষ্ণতায় মিলেমিশে একাকার। বৃষ্টির বেগ বাড়ার সাথে সাথে ইমনের পায়ের বেগও বেড়ে গেলো। চোখ বুঝে ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে ব্যস্ত মুসকান। ইমনের আর্দ্র শরীরের সুঘ্রাণে মাতোয়ারা মন। কেমন একটা ঘোরে চলে গেছে মুসকান৷ সেই ঘোর থেকেই নাকের ডগা ডাবিয়ে দিলো ইমনের উষ্ণ বুকে। এক পলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সামনে স্থির রাখলো ইমন৷ ওষ্ঠ কোণে ফুটে ওঠলো ঈষৎ হাসি।
গাড়ির ডোর খুলে মুসকানকে অতি সন্তর্পণে বসিয়ে দিলো ইমন৷ তারপর নিজে বসে ডোর লক করে দিলো। আচমকাই চমকে ওঠলো মুসকান। যেনো ভিন্ন এক গ্রহ থেকে সদ্য পৃথিবীতে আবর্তন করেছে সে। ইমন যখন তার সিটবেল্ট বাঁধতে কাছে যায় তৎক্ষনাৎ চিল্লিয়ে ওঠে মুসকান,
“এসব কি হচ্ছে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়? ”
থতমত খেয়ে আবারো কথার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। বলে,
“কি হচ্ছে এসব কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? কোন সাহসে আপনি আমাকে টাচ করলেন বলুন? ”
ততোক্ষণে ইমন সিটবেল্ট লাগিয়ে নিজের সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। মুসকানের শেষ প্রশ্ন শুনে সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
“নিজেকে অনেক বেশীই বড়ো এবং ম্যাচিওর প্রমাণ করতে চাইছো। বাট যতোটা দেখাচ্ছো ততোটাও তুমি নও। ”
“গাড়ি থামান। আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাব না। কোথাও যেতে চাইনা মি. ইমন চৌধুরী। ”
“জাষ্ট স্যাট আপ মুসু! রাগ মানবো, অভিমান মানবো কিন্তু বেয়াদবি নয় ”
সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো ইমন। মুসকান কিছুটা দমে গিয়ে শান্ত গলায় তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করলো,
“আপনি আমায় কোন সাহসে এভাবে নিয়ে আসতে পারেন? এটা কি কোন ভদ্র মানুষের তালিকায় পড়ে? গায়ের জোর আছে বলেই রাস্তাঘাট থেকে একটা মেয়েকে এভাবে তুলে আনবেন? আমি না হয় বেয়াদব আপনি কোন সভ্য, ভদ্র সমাজের বাসিন্দা যে এভাবে নিয়ে আসলেন? কোন অধিকারে এমনটা করলেন আপনি? ”
ছোট মুখে এতো বড়ো বড়ো কথা হজম হচ্ছিল না ইমনের। তারওপর তার সভ্যতা,ভদ্রতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। একত্রিশ বছর বয়সী এক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ’কে মাত্র আঠারো বছর বয়সী এক তরুণী ভদ্রতা, সভ্যতা শেখাচ্ছে! আক্রোশে ফেটে পড়লো ইমন। হুট করেই গাড়ির ব্রেক কষলো। অজানা ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠলো মুসকানের। এক ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে আড় চোখে তাকালো ইমনের দিকে। ইমন চোখে মুখে ক্রোধ ফুটিয়ে চোয়ালজোড়া দৃঢ় করে কিছু বলতে উদ্যত হবে ঠিক তখনি খেয়াল করলো মুসকান কিছুটা ভয় পাচ্ছে । যে ভয়টা তার পুরো মুখশ্রীতেই ফুটে ওঠেছে৷ মেয়েটা হয়তো ভাবছে এখন তাকে জোরালো একটা ধমক খেতে হবে, শুনতে হবে তিক্ত কিছু বুলি। কিন্তু মেয়েটা কি জানে? তার ভয় মিশ্রিত মুখখানি, মায়াবিশিষ্ট দৃষ্টিজোড়া, সিক্ত কোমল ওষ্ঠজোড়ার মৃদু কম্পণ ইমন চৌধুরীর বক্ষঃস্থলে তুলেছে মরণাত্মক ঝড়। এই মোহাবিষ্ট মুখশ্রী, ওষ্ঠকোণের নিম্নাংশে অবস্থিত হার্ট টাচিং তিলক সৌন্দর্য এতোগুলো দিন পর এতো কাছ থেকে দৃষ্টিপাত করতে দেওয়ার জন্য হলেও জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবদি মেয়েটাকে নিজ বক্ষঃস্থলে যত্নে রাখার প্রতিজ্ঞা করবে সে। মেয়েটা কি জানে না ইমন চৌধুরীর হৃৎপিণ্ড সে। এতটুকু ভয় পাওয়া নেহাতই বোকামি। তার বোঝা উচিত ইমন চৌধুরীকে আহত করার জন্য তার ঐন্দ্রজালিক দৃষ্টিজোড়াই যথেষ্ট।
চোখ বুজে ছোট্ট করে একটি শ্বাস ত্যাগ করলো ইমন। তারপর শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মুসকানের দিকে৷ মুসকান কাঁচুমাচু হয়ে বসে রইলো। ইমন তার কাঁচুমাচু ভণিতা দেখে স্মিথ হেসে শান্ত ভণিতায় মোহনীয় সুরে উত্তর দিলো,
“বন্ধুর বোনের সাথে আমার কিসের সম্পর্ক তা পুরো পৃথিবীর লোক জেনে গেলো অথচ বন্ধুর বোনই জানলো না! ”
বিস্ময়ান্বিত হয়ে তাকালো ইমন মুসকান চুপসে গেছে দেখে মুচকি হেসে বললো,
“রিল্যাক্স জানানোর ব্যবস্থা শিঘ্রই করছি। আর হ্যাঁ এ পৃথিবীতে যেসব পুরুষদের বন্ধুর বোন রয়েছে তাদের সকলেরই বন্ধুর বোনের প্রতি কিছু ন্যায্য অধিকার রয়েছে। তাই এ মূহুর্তে আমি সে অধিকারেরই সৎ ব্যবহার করছি।”
আশ্চর্যান্বিত হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মুসকান ইমন ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসি বজায় রেখেই গাড়ি স্টার্ট দিতে উদ্যত হবে এমন সময় হাঁচি দিয়ে ওঠলো মুসকান৷ পরপর দু’টো হাঁচি দিতেই ইমনের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো৷ সেই সাথে চোখে মুখে ফুটে ওঠলো দুঃশ্চিতার ছাপ। অস্ফুট স্বরে ‘ওহ শীট’ বলেই বিচলিত হয়ে মুসকানের ওড়নায় স্পর্শ করলো। মুসকান চমকে ইমনের হাতের ওপর নিজের হাত রাখতেই ইমন সে হাত সরিয়ে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাঁধে লাগানো সেপ্টিপিন গুলো খুলে ফেললো। কাঁদো কাঁদো মুখে মুসকান বললো,
“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না আমি কিন্তু চিল্লাবো। ”
ইমন শান্ত গলায় বললো,
“যতো খুশি চিল্লাতে পারো শুধু আমার কাজে বাঁধা দিও না। ”
“মানে!”
আর কোন কথা বললো না ইমন। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে ওড়না চিপে পানিটুকু গাড়ির জানালার বাইরে ফেলে ঘুরে বসে মুসকানের মাথা মুছতে শুরু করলো৷ বিস্ময়ান্বিত হয়ে স্থির বসে রইলো মুসকান। কি করে রাগ, অভিমান ধরে রাখবে সে? জাদুরাজ যে তার ভালোবাসা, যত্ন দিয়ে ঠিক বশীভূত করে নেবে তাকে৷ কান্না পেয়ে গেলো তার পরোক্ষণেই ভাবলো কাঁদলে চলবে না বরং মানুষ টা কে কিছুটা শাস্তি দিতে হবে। সেই সাথে উত্তর দিতে হবে তার সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা প্রশ্নগুলোর।
দীর্ঘসময় মাথা মুছে গায়ের কাপড়ের ওপর স্পর্শ করে ভেজাটা অনুভব করে ওড়না গলায় জড়িয়ে দিলো ইমন। মুসকান আবারো আরেক হাঁচি দিতেই প্রচন্ড চিন্তান্বিত হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো ইমন। ইমনের অমন বিচলিত মুখটা দেখে একটু মায়া হলো মুসকানের সেই সাথে খানিকটা প্যারা দিয়ে পৈশাচিক আনন্দও হলো। তাই মুচকি হেসে মুখটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে রাখলো। প্যারা মানে জটিল প্যারা তার অসুখ করা মানেই ইমন চৌধুরীর জন্য ভয়ানক প্যারা।
.
রাস্তায় থাকা কালীনই ইমন মুরাদকে ফোন করে মুসকানের সিচুয়েশন জানায়। ইমন তার বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে মুরাদ রিমিকে বাইক করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে মুসকানের এক সেট কাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসে। চৌধুরী বাড়িতে যখন ইমন মুসকান পৌঁছায় নিচে শুধু ইরাবতী, মরিয়ম আক্তার,রিমি আর সায়রী ছিলো। মুসকান মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকতেই ইরাবতী বলে ওঠে,
” যাক মহারানীর তাহলে পা পড়লো আমার বাড়ি। ”
ইমন বললো,
” শুধু পা নয় পুরো শরীরই নিয়ে এসেছি ” বলেই মুসকানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও ঠান্ডা লেগে গেছে। আমি মুরাদকে ওষুধ আনতে পাঠিয়েছি হালকা খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। ”
“বাব্বাহ তুই থেকে ডিরেক্ট তুমি! ”
সায়রীর কথা শুনে সকলেই মিটিমিটি হাসতে শুরু করলো। মুসকান চরম অস্বস্তি নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শীত লাগছে খুব কিন্তু ইমনের ঢং দেখে তার একটুও চেঞ্জ করতে মন চাচ্ছে না৷ বার বার শুধু একটিই প্রশ্ন করতে মন চাচ্ছে, গত তিনবছরে এই দরদ গুলো কোথায় ছিলো?
“আমার ভবিষ্যৎ সন্তানের মা এখন বড়ো হয়ে গেছে এখনো তুই তে আঁটকে থাকলে ভারী অবিচার করা হবে না?”
লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো মুসকানের। মরিয়ম আক্তারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। ইমন পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎক্ষনাৎ মুসকানের হাত চেপে ধরে সায়রীকে ইশারা করলো কাছে যেতে। সায়রী যেতেই মুসকানের হাত তার হাতে তুলে দিয়ে বললো,
“ফটাফট ইনাকে রেডি করে নিচে নিয়ে আয়। আর শোন আমার রুম তার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে শুধু আমার পোশাকগুলো কষ্ট করে দিয়ে যাস। ”
ইরাবতী আর মরিয়ম আক্তার ততোক্ষণে ছেলেমেয়েদের থেকে মনোযোগ ওঠিয়ে নিয়েছে। রিমি সায়রী আর মুসকানের সাথেই উপরে চলে গেলো। ইমনও মাথা ঝাঁকিয়ে চুলের পানি ফেলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে উপরে ওঠে গেলো।
.
ড্রয়িং রুমে ইমনের বাবা আকরাম চৌধুরী এবং মা ইরাবতী উপস্থিত রয়েছে। উপস্থিত রয়েছে মরিয়ম আক্তার সহ মুসকানের বড়ো চাচাও। তাদের উপস্থিতির মাঝেই মুরাদ এবং ইমন আসলো। এনগেজমেন্ট এবং বিয়ের ডেট ফাইনাল। যদিও মুসকানকে এসবের কিছুই জানানো হয়নি। ইমনের মতামতের ভিত্তিতেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সিদ্ধান্ত শেষে মুসকানের বড়ো চাচা বেরিয়ে গেলো। মুরাদও মরিয়ম আক্তার আর রিমিকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেলো। দিহান, সায়রী,মুরাদ, মুসকান সকলকেই আজ ইমনের বাড়ি থাকতে হবে৷ অবশ্য এসবের কিছুই জানে না মুসকান। সায়রী তাকে উপরের ঘরেই খাবার দিয়ে ঠান্ডা এবং জ্বরের ওষুধ খাওয়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটার সেই ছোট্ট বেলা থেকেই কোল্ড ফোবিয়া রয়েছে। একটু ভিজতে না ভিজতেই জ্বর, ঠান্ডা লেগে গেছে। নাক দিয়ে সমান তালে পানি আসছে৷ ইমনের পুরো রুম আজ টিসুময়। লম্বা লম্বা চুলগুলো এখনো শুখায়নি। মাথায় তয়ালে বেঁধে চুপচাপ শুয়ে আছে মুসকান৷ সায়রী পাশে বসেই ফেসবুক স্ক্রল করছিলো। এমন সময় রুমে ঢুকলো ইমন। সাদা রঙের টিশার্ট এবং কালো রঙের ট্রাউজার পরিহিত সে। ট্রাউজারের পকেটে একহাত গুঁজে চোখে মুখে গম্ভীর্যতা ফুটিয়ে ধীর পায়ে আগাচ্ছে সে। সায়রী তাকে দেখে ওঠে দাঁড়ালো বললো,
“ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে কমে যাবে। ”
“হুম তুই নিচ থেকে ঘুরে আয়। ”
“কি করবি? শোন এখনি কিছু বলিস না ভয়ানক কাণ্ড বেঁধে যাবে। ”
“যা বললাম তাই কর বাকিটা আমি দেখছি। ”
ভ্রু কুঁচকে মুসকানের দিকে তাকালো সায়রী। মুসকান চোখ বুজে শুয়েই আছে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। ভেবেই এক ঢোক গিলে ইমনের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। সায়রী বেরিয়ে যেতেই ইমন সটান সটান পা ফেলে দরজা লক করে দিলো। তারপর লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে বিছানায় মুসকানের পাশে গিয়ে বসলো। একহাত মুসকানের কপালে ছুঁয়ে জ্বরের মাত্রা দেখে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ওষ্ঠজোড়া ছুঁইয়িয়ে দিলো কপালে। মুসকানের তপ্ত শ্বাস তার চিবুক ছুঁয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস ছাড়লো। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে চোখ জোড়া মেলে মুসকানের পুরো মুখশ্রীতে সন্তর্পণে নজর বুলিয়ে বিরবির করে বললো,
“তোমার মনের ঘরে যে তালা তুমি ঝুলিয়েছো সে তালার চাবিকাঠি কেবল আমার বক্ষঃস্থলেই লুকায়িত রয়েছে। ”
চলবে..
রিচেক দেইনি৷ পর্বগুলো ছোট হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ ১০তারিখ থেকে এই গল্পটির বড়ো বড়ো পর্ব এবং রেগুলার গল্প পাবেন সকলেই। ভর্তিজনিত যাবতীয় কার্যক্রম ৯ তারিখের মধ্যেই শেষ করবো ইনশাআল্লাহ। দোয়া করবেন আমার জন্য সকলেই।