#হৃদয়ের এপিঠ ওপিঠ
পর্ব ঃ- ০৪
~আঁখি দেব তৃপ্তি
ইরা,
বিশাল একটি বাসার সামনে অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, আর ভালো লাগছে না। মানুষের আর্থিক অবস্থা কতোটা খারাপ এই লকডাউনে তা এই লাইনই প্রমান করে। একজনের বাসায় চাকরি পাওয়ার আসায় হাজার মানুষের লাইন!
প্রায় ৩ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার সিরিয়াল এলো। একটি কক্ষে আমাকে ডাকা হয়েছে। আমি আস্তে আস্তে কক্ষে প্রবেশ করলাম। মনে হচ্ছে এটা বসার ঘর, খুব বড় ঘরটা,চারপাশে দামী দামী জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল, কতো আভিজাত্য নিয়ে সুখে আছে মানুষজন আর আমরা ভালোভাবে দুবেলা খেতে পারি না।
সোফায় একজন রূপবতী মহিলা বসা। তিনি আমাকে বসতে ইশারা করলেন। আমার খুব নার্ভাস লাগছে। এতো মানুষ দেখে চাকরিটা পাবার আশা প্রায় শূন্যের কৌটায় এসে দাঁড়িয়েছে। কী জানি এখন কী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।
“আপনার নাম কী?”- মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
” ইরা” – কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম।
“নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই আপনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলুন।”
আমি ঘাড় নেড়ে “আচ্ছা” বুঝালাম।
“আপনার এই চাকরি করতে চাওয়ার কারণ কী?”
বহুদিন কাউকে নিজের দুখের কথা বলি না। বলার সু্যোগও পাই না। আজ কেউ প্রশ্ন করছে দেখে হৃদয় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।
“উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের আদরের একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি। কলেজে পড়ার সময় একটি ছেলের সাথে প্রেম হয়ে গেলো। ভালবেসে ফেললাম ছেলেটাকে খুব বেশি। একদিন পরিবার সব জানতে পেরে আমার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে ফেললো। আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ছেলেটি তখন সবে পড়ালেখা শেষ করেছে। ছেলেটির পরিবার আমাদের ছেয়ে অনেকটা দূর্বল ছিল কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল ছেলেটি একদিন ভালোকিছু করবে। নানান রঙিন স্বপ্নে আমি ভাসতাম তখন। মনে করতাম জীবনে ভালবাসাটাই সব, ভালবাসা থাকলে খোলা আকাশের নিচেও সুখের ঘর বাধা যায়। কিন্তু একসময় আমার জীবনে সব মিথ্যা প্রমাণিত হলো। জীবনের প্রয়োজনের কাছে হেরে গেল ভালবাসা। ”
“ঠিক বুঝলাম না। তুমি কাকে বিয়ে করেছিলে।”
“বাবা মার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম ছেলেটির সাথে। তারপর সংসার, প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল। ও একটা চাকরি পেলো, আমাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসলো। আস্তে আস্তে চাহিদা বাড়তে শুরু হলো। একপর্যায়ে গিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলো ও। তারপর শুরু হলো লকডাউন, আর মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি রইলো না। মেয়েকে ঠিকমতো খাওয়াতে পারি না আমি। নিজেরা শুধু ডাল ভাত খেয়ে পড়ে থাকি।”
“তোমাদের ভালবাসা কী এখনো খুব জোড়ালো?”
“হাসালেন ম্যাডাম, ভালবাসা! শব্দটাই এখন আমার কাছে হাসির পাত্র। জীবনে প্রয়োজনটা ভালবাসার আগে। কেউ না খেয়ে থাকলে তার ভালবাসার কথা শুনে পেট ভরে না। আর তখন এসব শুনতেও অসহ্য লাগে। জীবনের একটি ভুল সিদ্ধান্ত আমাকে আজ এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।”
“বুঝেছি, আচ্ছা তুমি যাও।”
“আচ্ছা, আসি ম্যাডাম।”
বেড়িয়ে এসে কেমন কেমন লাগছে। বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম এতোটা বোধহয় বলা উচিত হয়নি। কী আর করা যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। ইতু নিশ্চয়ই এতোক্ষণ আমাকে না দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি করছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।
সুজয়,
“এতো দেরী করলে, মেয়েটাতো কাঁদতে কাঁদতে শেষ ”
“কেমন বাবা হয়েছো মেয়েকে একটু সময় রাখতে পারো না! আমি কী ইচ্ছে করে দেরী করেছি নাকি? কতো মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল।”
“এরকম কথা বলছো কেন, আমি তোমাকে কীভাবে বললাম আর তুমি কীভাবে বলছো!”
“হ্যা, আমি সবসময়ই খারাপ কথা বলি। তুমি যা বলো তাই ভালো।”
“ইরা বেশিবেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। ”
“কী বেশি বেশি হবে? দেখতে পাচ্ছ না মেয়েটা কয়দিন ধরে শুধু দুধ খেয়ে আছে। এইটুকুতে কী এখন ওর পেট ভরে। ঘরে সারাদিন বসে না থেকে কোনো কাজ খুঁজতে পারো না?”
“তোমার মতে কী আমি কাজ খুঁজছি না।”
“হ্যা, খুব খুঁজছো দেখতে পাচ্ছি তো। বসে বসে শুধু মোবাইল আর টিভি। বাকিরা খাচ্ছে নাকি উপোস থাকছে কোনো খোঁজ খবর নেই।”
“ইরা থামো বলছি।”
“কী থামবো, বিয়ের আগে তো কতো বড় বড় কথা বলতে। এখন কী হলো। এভাবে আর কয়দিন চলবে। রাস্তায় গিয়ে নামার বাকি আছে। অন্য লোকের বাসায় আমাকে দিয়ে কাজ না করিয়ে তোমার শান্তি হবে না। কোথা থেকে কোথায় এনে নামিয়েছো তুমি আমায়? ইচ্ছে করে গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাই।”
আর সহ্য করতে না পেরে আমি ইরাকে জোরে একটা চড় মারলাম৷ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে ও।চড়ের সাথে ইরা বিছানায় গিয়ে পড়লো। ইতু খুব কান্না করছে, ভয় পেয়ে গেছে বোধহয়। আমার আর এখানে একটুও দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সোজা বেড়িয়ে এলাম ঘর থেকে।
প্রায় ৩ ঘন্টা হয়ে গেছে বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেছি। বিকেল হয়ে এসেছে, খুব ক্ষিদেও পেয়েছে কিন্তু বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। পকেটে ১০০ টাকা আছে। এ দিয়ে ডাল ভাত খাওয়া হয়ে যাবে। দেখি কোনো হোটেল পাই কিনা।
খেতে বসে ইরার কথা মনে হলো। ওরা খেয়েছে তো। আমি কী সত্যিই দিন দিন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি? ইরা আজ হঠাৎ এমন করলো কেন? ওর সাথে কী কেউ খারাপ ব্যবহার করেছিল নাকি অন্য কিছু। ইরা সত্যিই বলেছে আমি জোর দিয়ে কোনো কাজেরই চেষ্টা করছি না। ওকে কতো স্বপ্ন দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, আজ আমি ওর কাছে অপরাধী হওয়াই স্বাভাবিক।
টেবিলে ভাত, ডাল, মাছ পড়ে আছে। এই হোটেলে ১০০ টাকায় সব হয়ে গেছে। ক্ষিদের জ্বালা আর সইতে পারছি না। খেয়ে নেই, তারপর কী করা যায় ভাববো।