হৃদয়হরণী পর্ব ৩

0
908

#হৃদয়হরণী
#কলমে সৌমিতা
#পর্ব-৩

-আপনি কি ভীষণ ক্লান্ত??

-না কেন বলোতো,,,

-আপনার গলা শুনে মনে হল,,,আজকে হঠাৎ ওই ভাবে সন্ধ‍্যের সময় যেতে হল কেন?? আর কত রাত করে ফিরেছেন??আমি পেখুকে দিয়ে আপনার জন্য দই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম খেয়েছেন কি??

-উফফ একটু দম নাও তীয়া,, হ‍্যাঁ আমি দই খেয়েছি, খুব সুন্দর ছিল।আর তখন একটা প্রজেক্টের কিছু অফিসিয়াল ফ্রম দরকার ছিল তাই ওই ভাবে যেতে হল।আর ১১টার সময় বাড়ি এসেছি আমি,,,

-ওও ঠিক আছে,,

-কি ঠিক আছে?? এখন বলোতো ঠিক কতটা চিন্তা করেছো??

-একদম চিন্তা করিনি আমি,,,আপনার এসব ভুল ধারণা,,,

-আচ্ছা তাই নাকি??আচ্ছা তীয়া আমি কিন্তু আমার ঘর পুরো তোমার পছন্দ মত করে সাজিয়েছি,,,

-তার কোনো দরকার ছিল না পুলক,আমি আপনার পছন্দের ঘরেই থাকতাম,, ওটা আরও বেশি ভালো লাগতো আমার কাছে,

-সেটা আমি জানি,,কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে তুমি হয়তো এখানে এসে তোমার ঘরটাকে বেশি মিস করবে,,তাই এই চেষ্টা,,,

-আমাকে নিয়ে এত চিন্তা না করলেও হবে মিষ্টার,,আর মিথ্যে বললেন কেন ? ঘরটাতো পেখম সাজিয়েছে,,

-সেই হলো এক ও সাজানো যা আমিও তাই,,আর বলো কি নিজের প্রেমিকা+হবু বৌ কে নিয়ে চিন্তা করবো না,,,

-উফফ আপনি পারেন বটে,,

-আমি কি পারি না পারি সেটা দেখিয়ে দেবো ফুলসজ্জা রাতে,,,

-উফফ চুপ করবেন যত সব অশ্লীল কথা বার্তা,,,,

-আচ্ছা চুপ করলাম,,,(কিছুক্ষণ নিরাবতা,,ফোনের দুপাশ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ হয় না,,নিরাবতা ভেঙে অদ্বিতীয়া বলে ওঠে,,)

-পুলক আপনি কি রাগ করলেন?? আমি সরি বলছি,,(কান্নারত গলায়)

-এই এই পাগলী কাঁদছো কেন?? আরে তুমিই তো চুপ করে থাকতে বললে তাই,,,আর সরি accept করবো না,,আমি তো আমার বৌয়ের কাছেই অশ্লীল হবো,,তা না হলে তো জীবনে বাবা হতে পারবো না,,,

-পুলকের কথায় অদ্বিতীয়া হেসে ফেলে বলে,,আপনি একটা পাগল,,,

-সে জানি,, তীয়া এখন একটা গান শুনতে ইচ্ছা করছে তোমার গলায়,,, ভীষণ ক্লান্ত আমি একটু ঘুমাতে চাই তোমার গান শুনে,,,

-আমি জানি তো আপনি ভীষণ ক্লান্ত,, ঠিক আছে চোখ বন্ধ করুন। কিছুক্ষণ পর ফোনের ওপাশ থেকে একটা সুরেলা গলার স্বর শোনা গেল আর সাথে সাথেই পুলক চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে তা অনুভব করতে লাগলো,,

ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি

আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
____________________________________________

-এই প্রত‍্যেক দিন রাতে ব‍্যালকনিতে বসে গরম গরম দুধ চা খাওয়ার মজাই আলাদা,,, কিন্তু আজকে আমি দুধ চা খাবো না,,,আজকে খাবো আমি আবির দার ব্ল‍্যাক কফি,,,দেখি কেমন মিষ্টি লাগে,,,

-পেখম আবিরকে ঠিক যেই ভাবে কফি করে দিয়েছিল,,নিজেও ঠিক সেইভাবে এক কাপ কফি করে ঘরের দরজা বন্ধ করে ,ব‍্যালকনিতে এসে বসল। এই জায়গা টা ওর খুব পছন্দের, সারা ব‍্যালকনিতে শুধু শিউলী ফুল আর বেলী ফুলের গাছ আছে,,,আর মাঝ রাতে যখন হাওয়া দেয় ,সেই হাওয়ার সাথে তাদের সুবাস সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে,,,

-পেখম বেশ আয়েশ করে কফিটা সামনে নিয়ে বসে আছে,,ফোনে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে সবে মাত্র এক চুমুক যেই দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল ওর ,,মুখে হাত দৌড়ে বেসিনেং চলে যায়,, তারপর ওয়াক করে মুখের সব কফি ফেলে দিয়ে, ভালো করে দু-তিনবার জল দিয়ে কুলকুচি করে,,

ইসস কেউ খাই এই কফি??,,,ছি,,আমার এত সুন্দর মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল,,,ওয়াক,,,আবার তখন কি সুন্দর করে বলা হয়েছিল -“পাখি আমি যতবারই তোমাকে কফি বানাতে বলি হোক সে ব্ল‍্যাক কফি তবুও তাতে কেন মিষ্টতার স্বাদ পাই??(ব‍্যাঙ্গ করে)
ভাই রে ভাই এটা তোর মিষ্টি লাগে কোন দিক দিয়ে??কাকে আর কি বলবো যেমন তিঁতো লোক তেমন তিঁতো স্বাদ,,,

-আপন মনে এইসব বকবক করছিল যখন তখনই ওর খেয়াল হয় পাশের ফ্ল্যাটে ব‍্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কেউ ওকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে,,হঠাৎ মাথায় আসে এটাতো আবির দার ঘরের ব‍্যালকনি,,,এতদিন আবির দা থাকতো না বলে সবসময় ঘরটা বন্ধ থাকতো আর অন্ধকার থাকত,,,হঠাৎ ওর মনে হল ও ঘামছে,,ওর বকবক গুলো যদি আবির শুনে ফেলে তো সাংঘাতিক,,, পেখম চুপচাপ ব‍্যালকনি থেকে ঘরে চলে যায়,, তারপর ব‍্যালকনির দরজা খোলা রেখেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে,,,

-রাত ১ টা বাজে তবুও ওর ঘুম আসছে না ,,হঠাৎ খেয়াল হল ব‍্যালকনির দরজা খোলা আছে আর সেইখান দিয়ে আবিরের ঘরে আলো আসছে, ও আপন মনে বলে ওঠে এতদিন আবির দা বাড়ি না থাকায় কোনো আলো আসতো না,,আজ বাড়ি আছেন বলে আলো আসছে সেইজন্য হয়তো আমার ঘুম আসছে না। এই ভেবে ও দরজা যেই বন্ধ করতে যাবে অমনি গম্ভীর এক পুরুষালী কন্ঠ কানে এসে বারি খেলো ওর,,,

-পাখি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিস কেন??

-পেখম চমকে ওঠে ,দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর কন্ঠে বলে”আসলে আবির দা আপনার ঘরের আলো আসছে চোখে তাই ঘুমাতে পারছি না,, এতদিন তো আপনি ছিলেন না তাই আলো আসতো না বলে দরজা খোলা রাখতাম,,, কোনো সমস্যা না আমি বন্ধ করে দিচ্ছি,,,

-না থাক আমি আমার ঘরের আলো নিভিয়ে দিচ্ছি,,,(বলেই ব‍্যালকনি থেকে ঘরে গিয়ে ব‍্যালকনির ও ঘরের সর্বোচ্চ আলো নিভিয়ে দিয়ে মৃদু আলো জ্বালিয়ে দ্রুত ব‍্যালকনিতে ফিরে আসে)

-দরকার ছিল না আবির দা,,,

-সেটা তোমাকে বুঝতে হবে না পাখি,, আমি চাই না আমার জন্য তোমার কোনো সমস্যা হোক,,এখন যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো,,,অনেক রাত হয়েছে,, বেশি রাত জাগা ভালো না শরীরের পক্ষে।

-আপনি ঘুমাবেন না??

-ঘুমাবো,,তার আগে আমার রাত-প্রেয়সীর মুখটা দেখে এই চোখের তৃষ্ণা মেটাই তারপর,,, তুই যা ঘুমা,,আর শোন ঘরের মৃদু আলোটা জ্বালিয়ে রেখে দিবি,,,

-ঠিক আছে,,,(এর আবার কি হল,,কেমন কবি কবি ভাব,,আবার রাত প্রেয়সী কে?? রাত কে আবার কেউ প্রেয়সী বলে নাকি?? উফফ ভগবান এই লোক নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে,,,যাই হোক আমি বাবা লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পড়ি তা না হলে আবার ধমক খাবো)

-এইদিকে আবির রকিং চেয়ারে বসে ঘুমন্ত পেখমের দিকে তাকিয়ে আছে সেই কখন থেকে,,,বাইরে শৈতপ্রবাহ চলছে আর সেই সাথে আবির তার পছন্দের দুটো জিনিস ভালো করে উপভোগ করছে এক পেখমের ব‍্যালকনির ফুলের সুবাস আর দুই তার রাত-প্রেয়সীর ঘুমন্ত মুখ,,আর সেই মুখে যখন বাতাসের জন্যে চুল গুলো আছড়ে পড়ছে তখন তার খুব ইচ্ছে করছে নিজের হাতে সরিয়ে দিতে,,, কিন্তু আফসোস এটা পারবে না,,,
___________________________________________

-পেখু দেখ তো এটা কেমন লাগছে??

-খুব ভালো বৌমনি,,এটা নিয়ে নাও,,

-এই পেখম আমি কিন্তু এটা নিচ্ছি হলুদের সময় পড়ার জন্য,, আর দেখ এর তিনটে সেট available আছে,,,(রুশা)

-ঠিক আছে নিয়ে নে,,,কিন্তু আমাদের তো হলো ,,অর্নব, আকাশ আর দিপুরা কি পড়বে??(প্রিয়া)

-ও হো ম‍্যাইয়া দের দল এত চাপ নিও না আমাদের কেনা হয়ে গেছে,,(অর্নব)

-এই শোন আর কি কেনার আছে বল আমি একটু ডেটিংয়ে যাবো(দিপু সানগ্লাস টা পড়ে বলে)

-তোর আবার ডেটিং,,,চেপে যা ভাই(আকাশ)

-এই শোন আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে,, সেই সকালে খেয়ে কলেজ করে তারপর এখানে এসেছি,,,ও বৌমনি আগে কিছু খেয়ে নি,,আর তোমার বান্ধবীরা কোথায়,,

-ওরা ঐ দোকানে গিয়েছে,, তুই চল আগে কিছু খাবি আর তোমরাও চলো খাবে কিছু, তারপর ওরা একটা ক‍্যাফেটেরিয়ায় যায়,,,

-ওয়েটার ৭টা কোল্ড কফি আর দুটো চিকেন পিজ্জা দেবেন(অদ্বিতীয়া)

-এই তোরা এখানে আর আমরা সেই কখন থেকে খুঁজে চলেছি,,(তুর্য)

-না রে এই যে পেখমের ভীষণ খিদে পেয়েছিল তাই এলাম তা তুই কখন এলি?? মিতা, মৌ, এরা কোথায়??(অদ্বিতীয়া)

-আমরা সবাই এখানে(পিছন থেকে বলে ওঠে)

-ও চল আমাদের হয়ে গেছে,, আর বাকি আছে পেখম আর ওর বন্ধুদের কি কিনতে হবে তাই,,,(অদ্বিতীয়া)

-হাই পেখম তুমি কিন্তু একটা জিনিস জানো না আমি যেমন অদ্বিতীয়ার বন্ধু ঠিক তেমন দিপুর কাকাতো ভাই(তুর্য)

-আমি জানতাম না,,আর এই দিপু তুই কিছু বলিসনি কেন??(পেখম)

-আরে পেখম দাদাকে তো আমি এখন দেখলাম,,, এই দাভাই তুইও তো আমাকে কিছু বলিস নি যে বৌমনির বন্ধু তুই,,,(দিপু)

– surprise দেবো বলে,,,(তুর্য)

-পেখম দাদাভাই আসছে তাড়াতাড়ি কর আমাদের আবার ফিরতে হবে তো,,,(অদ্বিতীয়া)

-হ‍্যাঁ কিন্তু আমি তো বুঝতেই পারছি না কোনটা নেবো,,,ও বৌমনি তুমি বলো,,,

-আমি দেখে দেবো মিস পেখম,,,(তুর্য)

-আপনি??মানে পারবেন মেয়েদের জিনিস পছন্দ করতে??(পেখম)

-ও সব পারে,,(মৌ)

-এই অদ্বিতীয়া কেনাকাটার পর আমাদের সাথে তুই আর পেখম ঘুরতে যাবি তারপর কোনো একটা ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার করে বাড়ি চলে যাব আমরা,,আর তেমন হলে পুলককে ডেকে নেবো,,,(মিতা)

-ঠিক আছে আমি তাহলে পুলককে একটা ফোন করি(অদ্বিতীয়া)

-না না আমি যাবো না,,, ও বৌমনি আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ,,আমি এখান থেকে সোজা বাড়ি চলে যাবো,,তোমরা যাও,,,(পেখম)

-কেন পেখম চলো আমাদের সাথে,,,খুব মজা করবো আমরা,, তেমন হলে তোমার বন্ধুরাও যাবে,,(তুর্য)

-না না আমাদের অন্য প্ল্যান আছে দাদা(দিপু)

-ও তাহলে কি আর করা যাবে,,,পেখম তুমি একাই চলো তাহলে(তুর্য)

-ও যখন যেতে চাইছে না তাহলে জোড় করছিস কেন তুর্য(পিছন থেকে হঠাৎ কারোর কন্ঠস্বর শুনে সবাই পিছনে তাকিয়ে পড়ে,,,দেখে আবির দাঁড়িয়ে আছে,,, sky কালারের একটা শার্ট ইন করে পড়া, হাতাটা কনুই পর্যন্ত গোটানো,,, কালো ফরমাল প‍্যান্ট,,,চুল গুলো ব্রাশ করা স্টাইল দিয়ে,,,,)

-উফফ আমি বোধহয় মরে যাবো অদ্বিতীয়া(কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ওঠে মৌ)

-চুপ হয়ে যা মা(অদ্বিতীয়া)

-আরে আবির দা ভালো আছো??(তুর্য)

-হ‍্যাঁ,,, তোদের হলো কেনাকাটা??(অদ্বিতীয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে আবির)

-হ‍্যাঁ আমাদের সবার প্রায় হয়ে গেছে,,, শুধু পেখমের বাকি,,ও আসলে পছন্দ করে উঠতে পারছে না,,, তুই একটু সময় দে ,,তুর্য তাড়াতাড়ি পছন্দ করে দে,,,দেখি পেখমের পছন্দ হয় কি না??(অদ্বিতীয়া)

– excuse me ওই গোল্ডেন পাড়ের গোলাপী ল‍্যাহেঙ্গা আর ওই যে নীল শাড়ি ওই দুটো বার করে দিন তো(আবির)

-আবিরের কথা অনুযায়ী শপের লোকটি কাপড় বার করে দিলো,,যা সবার পছন্দ হয়ে যায়,,,

-বলছি আমাকে মানাবে তো বৌমনি এই দুটো রঙে??(পেখম)

-হ‍্যাঁ ভালো লাগবে(অদ্বিতীয়া)

-পেখমের কথায় আবির একদম ওর কাছে চলে যায় সবাই যখন ব‍্যস্ত থাকে কেনাকাটায়,,,তারপর একদম কানের কাছে গিয়ে বলে “আমি কখনোই তোমার জন্য খারাপ কিছু পছন্দ করবো না পাখি,,,আর যেখানে তোমার পোশাকের কথা সেখানে আমি বেস্ট টাই তোমাকে পড়তে বলবো,,,ও দুটো রং তোমার সাথে ভালো মানাবে,,বিয়ের দিন যেন আমারো চোখ ধাঁদিয়ে যায় তোমাকে দেখে ,”

-আবিরের প্রত‍্যেকটি কথায় পেখমের মধ্যে যেন আলাদা একটা শিহরণ খেলে যায়,,,সাথে সাথেই গাল দুটো রক্তিম রূপ ধারণ করে,,,,

-পেখম ও আর দ্বিমত পোষণ করে নি,,ওই গুলো প‍্যাক করে দিতে বলে,,,তারপর সবার কেনাকাটা হয়ে গেলে সবাই গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে নেমে আসে,,,,

চলবে,,

(যারা যারা পড়বেন অবশ্যই লাইক ও নিজস্ব মতামত পোষণ কলবেন। কপি পেস্ট করবেন না)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here