হৃদয় মাঝারে সিজন২ (পর্ব ১)

0
1330

১.
কাজি কবুল বলার পরও প্রায় অনেকটা সময় হয়ে গেছে কিন্তু বর কবুল বলছে না। বর বিয়েতে রাজি না সেটা জেনে কনে পক্ষের লোক বর পক্ষ কে কম কথা শুনায়’নি। মাহতিম নিশ্চুপ ভঙ্গিতে কনে পক্ষের করা অপমান সহ্য করছে। তার করার কিছুই নেই। মাহতিম যে তার মন অন্য কারো জন্যে যতনে রেখেছে। কিন্তু শুধু নিজের কথা ভাবলেই তো আর হবে না। যারা ছোটবেলা থেকে আদর-যত্ন করে লালন পালন করেছে তাদের কথাও ভাবতে হবে। কিন্তু কি করবে মাহতিম বুঝতে পারছে না।

‘ভাইয়া প্লিজ বিয়ে টাটা ককরে নাও, ওরা বাবা মাকে কত্তো বাজে কথা বলছে।’

মাহতিমের সামনেই ছোট বোন চাঁদনী হাত’জোড় করে কথা গুলো বললো।

‘কি করবো আমি?’

মাহতিমের কথা শুনে চাঁদনী রেগে গিয়ে বলে,

‘বিয়ে যখন করবেই না তাহলে রাজি হয়েছো কেনো? আমাদের অপমান করার জন্য তুমি এতোটা নিচে নামবে ভাবতে পারিনি!’

মাহতিম চাঁদনীরর দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে থাকা কাজিকে হুংকার দিয়ে বলে,

‘বিয়ে আজকে পড়াবেন নাকি সারাদিন এখানেই বসে থাকতে হবে?’

মাহতিমের কথা শুনে তার পরিবারের সবার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে। কাজি সাহেব বোকার মত কিছুক্ষন মাহতিমের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার নতুন করে বিয়ে পড়ানো শুরু করে।
.
মাহতিম কবুল বলার পর এখন ফারিহার কবুল শুনার অপেক্ষায় সবাই আছে। একজন হুজুর আর ফারিহার ভাই ফারিহার রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে। রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা। ফারিহার ভাই পিয়াস ভেবেছে ফারিহা রুমের ভিতরে এখনো সাঁজছে।

‘ফারু দরজা খোল পরে সাঁজতে পারবি আগে কবুল বলে নে।’

পিয়াসের কথার জবাবে আর কোনো কথা শুনা যায়নি। পিয়াস কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে বিরক্তি ভঙ্গিতে আবারো বোনকে ডাকতে লাগলো।

‘এই ফারু দরজা খুলবি নাকি দরজা ভাঙা লাগবে আমার?’

এবারও কোনো জবাব আসেনি। এবার পিয়াস কিছুটা রেগে যায়। জোরে দরজায় একটা লা’থি দেয়। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। পিয়াসের পিছনে ওর বাবা এসে দাড়ায়।

‘কি হয়েছে এরকম রাগারাগি করছিস কেনো?’

‘তোমার গুনধর মেয়ের কি হয়েছে দরজা খুলে না কেনো?’

পিয়াসের কথা শুনে নুরুল সাহেব কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। কারন ফারিহা যে বলেছে সে এই বিয়েটা করবে না। কিন্তু নুরুল সাহেবেরই বা কি করার আছে। তার মেয়ে তো বিয়েতে দিব্যি খুশি ছিলো। হুট করেই কালকে রাতে বলে সে এই বিয়েটা করতে পারবে না। নুরুল সাহেব ব্যাস্ত থাকার কারনে অতোটা গুরুত্ব দিয়ে মেয়ের কথা শুনেনি। পিয়াস কয়েকজন কে ডেকে দরজা ভাঙার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে সফলও হয়েছে। ঘরের ভেতরে ডুকে সবাই অবাক! ফারিহা ঘুমাচ্ছে, এটা দেখে পিয়াস প্রচন্ড ক্ষেঁপে যায়। সাথে নুরুল সাহেব মেয়ের কান্ড দেখে হতভাগ হয়ে যায়। পিয়াস ফারিহাকে টেনে তুলে বলে,

‘এই আজ তোর ঘুমানোর দিন নাকি যে সারাদিন ঘুমাচ্ছিস?’

ফারিহা ঘুমঘোরে এখনো, কে কি বলছে কিছু তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। এর মধ্যেই রুমের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পাত্রর ফুপি প্রবেশ করে।

‘এই মাইয়ারে দিয়ে সংসারের কোনো কাজকর্ম হইবো না। মানুষ বিয়ের দিনও ঘুমায় কি কইরা?’

এমন তেজময় কন্ঠস্বর শুনে ফারিহার ঘুম উড়ে যায়, প্রতিবাদের স্বুরে বল,

‘এই বয়স্ক আন্টি একদম আমার ঘুম নিয়ে মজা করবেন না। আপনাদের বর আমাকে কাল রাতে ফোন দিয়ে বলেছে উনি এই বিয়েটা করতে পারবে না। আমি তো শুধু আমার না হওয়া বর মশাইকে একটু সাহায্যই করছি চুরি করছি না।’

ফারিহার কথা শুনে মাহতিমের ফুপি প্রচন্ড রেগে যায়। রুমে এতো মানুষ উনি কিছু চাইলেও বলতে পারছে না। এক এক করে পাত্রপক্ষের সবাই রুমে প্রবেশ করছে। এতক্ষনে চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে বিয়ের কনে বিয়েতে রাজী না। নুরুল সাহেব মেয়ের কান্ড দেখে হতাশ হন আবারো। একটা ছেলে বলেছে বিয়ে করবে না সেও তাই মেনে নিলো। মেয়েটা এমন কেনো কে জানে! এই পৃথিবীতে বাঁচতে হলে চালাক হতে হবে। ফারিহার মত সহজ সরল মন তো আর সবার না যে সে মানিয়ে চলতে পারবে, কোনো সমস্যা হবে না।

‘আপনারা আমাদের এভাবে অপমান না করলেও পারতেন বেয়াইন সাহেব।’

মাহতিমের বাবার কথা শুনে নুরুল সাহেবের ধ্যান ভাঙে।

‘আপনাদের ছেলের এতে কোনো দোষ নেই ভাই?’

নুরুল সাহের কথা শুনে মাহতিমের বাবা মাথা নিচু করে ফেলে।
.
.
‘ভাই আমাদের ভাবির বিয়ে ভেঙে গেছে।’

কথাটা শুনা মাত্রই সামনে থাকা ছেলেটির মুখে হাসি ফুঁটে উঠে।

‘এটাই তো চেয়েছি আমি সাইমুন। তুমি আমাকে এতো সাহায্য করেছো যা বলার বাহিরে। কি বলে যে আমি তোমাকে ধন্যবাদ দিবো!’

বলেই ছেলেটি পি’স্ত’ল বের করে সাইমুন নামের ছেলেটা কে গুলি করে। মুহুত্বের মাঝেই পুরো রুম কেঁপে উঠে।

‘আমি চাইনা আমার এই অপকর্মের সাক্ষী কেউ থাকুক।’

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় ছেলেটি। রুমের বাহিরে বেরিয়ে একজন গার্ড কে ডেকে বলে,

‘রুমের ভেতর একটা মৃত দেহ আছে, আশা করি আর কিছু বলতে হবে না আমাকে!’

হুংকারের ন্যায় কথাটি বলতেই গার্ডটি কেঁপে উঠে। কোনো মতে ভয়কে একপাশে রেখে বলে,

‘ন..না স্যার ব্যবস্থা করছি আমি।’

‘গুড।’

বলেই ছেলেটি গাড়ির চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বাহিরে চলে যায়।
.
হই-হুল্লোড়ে মেতে থাকা বিয়ে বাড়ি পুরো নিস্তেজ হয়ে গেলো। পাত্রপক্ষের লোকজন আরো আগেই চলে যায়। যাওয়ার আগে তারা বলে গিয়েছে পাত্র কোনো কল দেয়নি ফারিহাকে। এতো ক্রোধের ভেতরে কোনো পরিবার কারো কোনো কথা শুনেনি। ফারিহা রেগে আগুন হয়ে আছে এতো অপমান করে গেছে পাত্রপক্ষ তাকে অথচ দোষ সব পাত্রের।
‘পাত্র যদি বিয়েতে রাজি নাই থাকে তাহলে তারা এতো অভিনয় কেনো করলো! কেমন পরিবারের বউ হতে যাচ্ছিলাম আমি!’
বিড়বিড় করে কথাগুলো নিজেই নিজেকে বললো ফারিহা। পিছন থেকে পিয়াস ফারিহাকে গাট্টা মেরে বলে,

‘এই কি এতো বিড়বিড় করছিস? বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কষ্টে পাগল হয়ে গেছিস নাকি?’

‘ভাল্লাগেনা ভাইয়া, ভাবছি যে তোমরা কেমন পরিবারের সাথে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছ!’

‘কেনো কি হয়েছে? পরিবারের লোকজন তো ভালোই আছে।’

পিয়াসের কথা শুনে বিরক্ত হয় ফারিহা।

‘যে পরিবারে ছেলের মতামতের কোনো মূল্য থাকে না সেটা অদ্ভূত ফ্যামিলি না? ছেলেটা বিয়ে করতে চায় না তাকে জোর করে আমার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে তার ফ্যামিলি। আজ আমাকে যদি ছেলেটা ফোন করে এসব না বলতো তাহলে তো আমি একটা নরকে গিয়ে পড়তাম।’

‘এই ওয়েট ওয়েট, ওরা কিন্তু বলেছে মাহতিম তোকে কোনো ফোন দেয়নি। এটাও তাহলে মিথ্যাে বলেছে ওরা, নাকি তুই মিথ্যে বলেছিস সবাইকে?’

পিয়াসের কথা শুনে রেগে যায় ফারিহা। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফোন নেয় ফারিহা।

‘এই দেখ কাল রাতে এই নাম্বার থেকে ফোন করেছে আমাকে ওই মাহতিম, তিন মিনিট একান্ন সেকেন্ড কথা বলেছি।’

বলেই পিয়াসের সামনে তার ফোনটা এগিয়ে দেয়।

‘কল দে তো এই নাম্বারে।’

ফারিহাও কোনো কথা না ভেবে মাহতিমের নাম্বারে কল দেয়। কল দেওয়ার সাথে সাথেই একজন মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে আসে ‘আপনার ডায়াল কৃত নম্বর টি এই মুহুর্ত সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ কথাটা শুনে ফারিহা আর পিয়াস দুজনেই হতাশ, ফারিহা ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মারে। সাথে সাথেই ক্রিংক্রিং শব্দে ভেজে উঠে ফোনটা। চরম বিরক্তি নিয়ে ফারিহা আবার কষ্ট করে ফোনটা বিছানা থেকে তুলে নেয়। একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।

‘এই ফারু ফোন টা রিসিভ কর তো মাহতিম হতে পারে।’

পিয়াসের কথা মত ফারিহা ফোন রিসিভ করে।

‘আপনি কি মিস. ফারিহা বলছেন?’

ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই এমন কথা শুনে বিরক্ত হয় ফারিহা। তারপরও ভদ্রতার খাতিরে বলে,

‘জ্বী, আপনি কে বলছেন?’

‘মাহতিম চৌধুরী বলছি, বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘আর ভাষা খুঁজে পেতে হবে না আপনার। আপনি আমাকে ফোন করে বলেছেন বিয়েটা ভেঙে দিতে তাই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছি। এবার আপনারা এখানে এসে যত জন লোক খাবার খেয়েছেন এবং কি কি খেয়েছেন সেই লিষ্ট টা করে টাকা গুলো বিকাশে পাঠিয়ে দিন।’

‘এই আপনাকে আমি কখন ফোন করে বললাম যে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে? বিয়েটা যেহেতু আপনি ভেঙ্গেছেন তাই আমি কেনো টাকা দিতে যাবো? বিয়ে করেননি এতে আমি খুশি তবে করলেও আমি অখুশি হতাম না। ভালোই হয়েছে এমন কৃপণ একটা মেয়েকে আমার বিয়ে করতে হয়নি!’

রাগে দুঃখে ফারিহা ফোনটা আবারো বিছানায় ছুড়ে মারে।

‘এই তুই না বলেছিস মাহতিম তোকে ফোন করেছে তাহলে মাহতিম এখন স্বীকার করলো না কেনো?’

‘সেটাই তো ভাবছি ভাইয়া, নাম্বারও ছিলো অন্য একটা। তারপর কণ্ঠও মিলে না মাহতিমের সাথে। তাহলে কে সেই অচেনা লোক যে আমার বিয়েটা আমার হাতেই ভেঙ্গে দিয়েছে?’

চলবে……

#হৃদয়_মাঝারে
#সিজন_২
#সুচনা_পর্ব
#হালিমা_চৌধুরী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here