হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব ৬

0
499

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০৬]

সিদাত অফিস থেকে বেরিয়েই দেখলো সাইফ তার গাড়ি নিয়ে অফিসের সামনে বসে আছে। সাইফকে এই সময়ে দেখে সিদাত চাপা হাসলো। নিজে বাইকের চাবি নিয়ে আবার নিজেই নিতে এসেছে। সাইফ যে কোন ধাতু দিয়ে তৈরি সেটা একমাত্র উপরওয়ালাই ভালো জানে।

সিদাত আর না দাঁড়িয়ে গুণগুণ করতে করতে ফন্ট সিটের দরজা খুলে উঠে বসলো। কাঁধের কালো কুচকুচে ব্যাগটা পেছনের সিটে অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে বললো,
–“বাইকের চাবি নিয়ে এখন আবার দরদ দেখাচ্ছো ভাইয়া?”

সাইফ গাড়ি ঘুরিয়ে ব্যস্ত স্বরে বললো,
–“কেন জানিস না, আমার দরদ সবসময়-ই একটু বেশি!”

সিদাত হাসলো। দুই ভাই নীরবতা পালন করলো। এর মাঝে সিদাত হঠাৎ বলে ওঠে,
–“মেয়ে পছন্দ হয়েছে?”

মেয়ের কথা শুনে সাইফের বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেলো। বললো,
–“বয়ফ্রেন্ড থাকা মেয়েকে আমার একদম পছন্দ না। আমি আমার মতো ফ্রেশ কাউকে চাই!”

সিদাত ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“খুঁজো। খুঁজলেই পাবে!”

সাইফ কোণা চোখে সিদাতকে পরখ করে কপালে ভাঁজ ফেললো। অতঃপর আবার রাস্তার দিকে চেয়ে মিনমিন করে বললো,
–“এত হাসিস না। আমার মতোই কপাল ফুটো হবে তোর!”
–“কিন্তু আমার মনে হয় না!”

সাইফ অস্ফুট স্বরে বললো,
–“কেন মনে হয় না?”
সিদাত হলদে পথে চেয়ে আনমনে বললো,
–“জানি না ভাইয়া। তবে মন বলে!”
সিদাতের কথা শুনে সাইফ ঠাট্টা মশকরা করলো। তবে সিদাত মোটেও রাগ করলো না। বরং ভাইয়ের সাথে নিজের নামে আরও দুই এক শব্দ জুড়ে দিয়ে নিজের বদনাম করলো। সাইফ হাসি থামিয়ে বলে,
–“নিজের বদনাম করতেও মুখ কাঁপে না?”

সিদাত চাপা হাসলো শুধু। কিছু বললো না। পপরমুহূর্তেই সিদাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে জানালার কাচে মাথা এলিয়ে দিলো। চোখ জোড়ায় ব্যথা, যন্ত্রণা লেপ্টে আছে। সঙ্গে রয়েছে বিষণ্ণতার রেশ।

আজ শো-তে কোনো এক মা-ছেলে এসেছিলো। তাদের সংগ্রাম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার গল্প শুনে তার চোখ জ্বলজ্বল করছিলো। বক্ষখানা ব্যথায় মুঁচড়ে যাচ্ছিলো। বারবার শয্যাশায়ী মাকে মনে পরছিলো। তার মা-টাও কেন ওনার মতো হলো না? মায়ের অনুপস্থিতির ব্যথা পৃথিবীর কোনো জিনিস কী আদৌ ভুলাতে পারে? আজ যে সিদাত না চাইতেও নিজের মাথায় মায়ের মমতার হাত বুলানোর জন্যে বড্ড লোভী হয়ে পরেছে। অবশ্য এই লোভ প্রায় প্রতিদিন-ই হয়। কিন্তু মায়ের কাছে এই ধরণের আবদার করে মায়ের মন ভেঙে দিতে চায় না। সিদাত জানে, তার মা এই কঠিন ব্যাধির কারণে আকাশসম আফসোস, বিতৃষ্ণা বুকে গেঁথে রেখেছে। যা তার মাকে প্রতিনিয়ত পোড়ায়, ভীষণরকম পোড়ায়।

বাড়ি ফিরে সিদাত সোজা মায়ের ঘরে চলে গেলো। ফিরোজা খাতুন তার মাকে খাওয়ানো শুরু করেছে সবে। সিদাত মৃদু গলায় ফিরোজা খাতুনের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আজ মাকে আমি খাইয়ে দিবো ছোটো মা। আপনি বরং খেয়ে নিন।”

ফিরোজা পিছে ফিরে সিদাতের মুখপানে চাইলেন। বড্ড শুকনো লাগছে মুখখানা! ফিরোজা কথা বাড়ায়নি। চলে গেলেন তিনি। সিদাত খুব যত্ন করে মাকে খাইয়ে দিয়ে সব গুছিয়ে রাখলো। মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো নির্বাক চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। সিদাত আলতো হেসে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
–“আজ আবার সেই মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছে জানো মা? তবে মজার ব্যাপার হলো আমি আজও তার নাম জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি!”

বলেই সিদাত হাসতে লাগলো। জয়ার চোখজোড়া হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠলো। যেন সে আগ্রহী সিদাতের কথা শুনতে। সিদাতও সেটা আঁচ করতে পারলো। এজন্য ভেতরের কষ্ট গুলো মাকে বুঝতে না দিয়ে সে তরীর সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা সব একে একে বলতে লাগলো। জয়াও আগ্রহী হয়ে সব শুনছে। সিদাতের কেন যেন মনে হলো নিকাব রাণীকে নিয়ে তার মায়ের আগ্রহের শেষ নেই৷ গল্প শুনতে শুনতে জয়া ঘুমিয়ে গেলো। সিদাত মায়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসলো।

বের হতেই দেখলো বাড়ি নীরব, সুনশান। তাও খাবার টেবিলের এক চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে ফিরোজা খাতুন। হয়তো-বা সিদাতের জন্যেই। সিদাত দেয়াল ঘড়ির দিকে চাইলো। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে বারোটা পেরিয়ে গেছে। ফিরোজা খাতুনও ক্লান্তহীন বসে আছে। সিদাত এগিয়ে গেলো ফিরোজার কাছে। সিদাতকে নজরে এলে ফিরোজা শুকনো হেসে বললো,
–“তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম বাবা। খাবার বাড়বো?”

সিদাত কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ইতিবাচক মাথা নাড়ালো। ফিরোজা খাতুন উঠে দাঁড়ালেন। ব্যস্ত হয়ে ছুটলেন রান্নাঘরে। সিদাতও কিছুক্ষণ পরপর রান্নাঘরে হাঁটা দিলো। ফিরোজা খাতুন সিদাতকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বললো,
–“আরেহ! টেবিলে গিয়ে বসো। গরমে দিয়ে রান্নাঘরে কী করছো বাবা?”

সিদাত কোনো প্রতি উত্তর না করে ফিরোজার সামনে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“একটু হাত বুলাবেন ছোটো মা। একটু মমতার জন্যে ভীষণ ব্যাকুল হয়ে আছি। মাকে তো বলতে পারবো না। এজন্য আপনাকে বলছি। যদি একটুখানি কষ্ট লাঘব হয়।”

——————–
তরীর আজ ঘুম আসছে না কেন যেন। এজন্য তরী শোয়া ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে চলে গেলো। রাত-বিরেতে চা খাওয়ার অভ্যাস আছে তার। এজন্য দেরী না করে চুলোয় পানি বসিয়ে দিলো। একমনে চেয়ে রইলো পাতিলের মধ্যে। কিছু একটা খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছে সে। কী যেন একটা ভেবে তরী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ফুপির রুমে চলে গেলো। দরজা আলতো ফাঁক করে ফুপিকে পরখ করে নিলো। অতঃপর তরী আবার রান্নাঘরে এসে চা বানিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। টেবিলের ওপর থেকে টেবিল ল্যাম্প আর তরীর গোপন কিছু সরঞ্জাম নিয়ে বারান্দায় হাঁটা দিলো। চা-টা আগেই বারান্দায় রেখে এসেছে।

সব ঠিক করে তরী মেঝেতে বসে চা-টা হাতে নিলো। ধোঁয়া ওঠা চায়ে হালকা ফুঁ দিয়ে শব্দের সাথে চুমুক দিলো। সঙ্গে সঙ্গে তরীর সর্বাঙ্গ জুড়ে প্রশান্তির রেশ ছেয়ে গেলো। সে চা টি হাতের নাগালের বাইরে রাখলো। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে তরী হাতে খাতা-পেন্সিল তুলে নিলো। গভীর রাতে সে তার পছন্দের কাজ করবে। তরী স্কেচ করতে শুরু করে দিলো। ছোটো থেকেই তরীর আঁকা-আঁকি নিয়ে বড্ড আগ্রহ। ছোটো থেকে স্বপ্ন দেখেছে একসময় সে চারুকলা নিয়ে পড়বে। নিজের অদম্য সখকে পূরণ করবে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণে বাঁধা এলো বাবার কাছ থেকে।

বাবা আকবর সাহেব একদম পছন্দ করেন না ছবি আঁকা। কারণ ছবি আঁকা মানেই মানুষ আঁকতে হবে। অথচ তরী তার বাবাকে আশ্বস্ত করেছিলো সে কখনোই মানুষের প্রতিরূপ আঁকবে না। কিন্তু তার বাবা তাকে বোঝালো। আকবর সাহেব যা মেনে চলেন তা দুনিয়ার মানুষ মানে না। চারুকলায় ভর্তি হলে অবশ্যই, অবশ্যই মানুষের প্রতিরূপ আঁকতেই হবে। এখনকার মানুষজনদের কাছে এগুলো ব্যাপার না। এজন্য আকবর সাহেবের নিষেধাজ্ঞা তরী নীরবে মেনে নেয়। কিন্তু সখ, স্বপ্ন কোথাও না কোথাও তো থেকেই যায়। তাই তরী প্রায় রাতে ঘুম না আসলে বারান্দায় বসে স্কেচ করে। স্কেচবুক এবং পেন্সিলগুলো তরী অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে কিনেছে।

এখন তরী একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ এবং তার নিচে দিয়ে কৃষ্ণচূড়ায় রাঙানো পথের স্কেচ করছে। যদিও রঙহীন ছবিটায় বোঝা যাচ্ছে না এটা আদৌ কোনো কৃষ্ণচূড়ার গাছ কী না। তবে তরী কৃষ্ণচূড়ায় রঙও দিবে না। থাকুক নাহয় কিছু সাদা-কালো ছবি। সব ছবিতে রঙের ছোঁয়া লাগবেই, এটা তরী মানতে পারে না। এই সাদা-কালো ছবিও তরীকে চমৎকার ভাবে শান্তি দেয়।

তরী যখন ছবি আঁকতে ব্যস্ত তখন কেউ তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে ছিলো। তরী বুঝেও উঠতে পারলো না পথের সোডিয়াম আলোর নিচে এক অবয়ব দাঁড়িয়ে। সেই অবয়ব সিদাত। বিষণ্ণ চিত্তে আর ভালো লাগছিলো না দেখে সিদাত অনয়ের কাছেই আসছিলো। হঠাৎ দোতলার দিকে নজর যেতেই দেখলো সেখানে একটি মেয়ে বসে আছে। যদিও চেহারা আবছা, তবে সিদাতের কেন যেন মনে হলো এটা তরী৷ এজন্যে সে সেখানে-ই থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। চেহারা আবছা আলোয় বোঝা না গেলেও সিদাত ভালো করেই দেখলো তার হতে কলম চলছে। হয় কিছু একটা লিখছে নয়তো ছবি আঁকছে। যেকোনো কিছু একটা হতেই পারে। সিদাত তরীর বারান্দা থেকে বেশি দূরে নয়। খুবই নিকটে।

হঠাৎ তরী সেটা রেখে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিলো। অসাবধান বশত তরী অপর হাতে ধরে রাখা ল্যাম্পের আলো তরীর মুখের ওপর গিয়ে পরলো। সিদাত তরীর মোহময় মুখখানা দেখে থমকে গেলো। ল্যাম্প সরে যাওয়ার পরেও সিদাত সেদিকেই চেয়ে রইলো। মুগ্ধতার রেশ কাটছে না। মনে হচ্ছে যেন কতকাল এই মুখখানা দেখার জন্যে তৃষ্ণার্ত ছিলো। অথচ পরিচয় মাত্র সাত দিনের। সাত দিনের মধ্যে দু’দিন দেখা হয়েছে। সিদাত অনুভব করলো তার বক্ষঃস্থলের বড়ো পাথরটা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। ভেতরের দহন ধুঁয়ে সেখানে ভেজা কাঁদা – মাটির মতো অনুভব হচ্ছে।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

বিঃদ্রঃ রেগুলার ক্লাস, পড়াশোনা, পরীক্ষা মিলিয়ে মোটামুটি ব্যস্ত। তার ওপর খুব বেশি পরিশ্রমের কারণে দুর্বল হয়ে গিয়েছি। ছোটো পর্বের জন্য দুঃখিত। আর হ্যাঁ গঠনমূলক মন্তব্য চাই কিন্তু। অন্তত আপনাদের মন্তব্য দেখে প্রাণ জুড়াতে চাই। ভালোবাসা অবিরাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here