হৃদয়ে মেঘগলি পর্ব ৮

0
611

#হৃদয়ে_মেঘগলি
|০৮|
লাবিবা ওয়াহিদ

তখন শেহরিম এমবিবিএস এর চতুর্থ ইয়ারে ছিলো। তার মায়ের তখন খুব দুঃখ, বড়ো ছেলেকে নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারলো না। সেই শোকে তিনি দিন-রাত কোনো এক চিন্তায় বিভোর থাকতেন। একদিন দুঃস্বপ্ন দেখলেন তার ছোট ছেলেও একই কাজ করেছে এবং এর কারণে তার সুন্দর সংসার টানা-হেঁচড়ায় রয়েছে। এজন্যে বেশ ভয়ে শেহরিমের মা সিদ্ধান্ত নিলেন শেহরিমকে এই বয়সেই বিয়ে দিবেন। যদি শেহরিমের কাউকে পছন্দ হয়ে যায়? আর তাঁর স্বপ্নটাও সত্যি হয়ে যায়? এজন্যে গোপনে তিনি মেয়ে দেখা শুরু করলেন। তার স্বামী, সন্তানের অগোচরে। এভাবে মেয়ে দেখতে দেখতে একদিন রাস্তায় সে তাশুতিকে দেখতে পায়। যাকে দিয়ে বিয়ের ঘটকালি করাচ্ছে সেও শেহরিমের মায়ের সঙ্গে ছিলো। তাশুতিকে প্রথম দেখায় তার ভীষণ পছন্দ হলো। এজন্যে ঘটককে তাশুতিকে দেখিয়ে সব-রকম খোঁজ – খবর লাগালো। ওরা চলে যেতেই তাশুতির সাথে একটি ছেলে দেখা করতে আসলো। তাশুতি হেসে হেসে সেই ছেলেটির বাহু জড়িয়ে কোথাও চলে গেলো।

কিছু দিনের মধ্যে শেহরিমের বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় শুরু হলো। হৈ-হুল্লোড়ের মূল কেন্দ্রবিন্দু শেহরিমের বিয়ে। শেহরিম কিছুতেই রাজি নয়। তার এখনো ভবিষ্যৎ বাকি। দেশের বাইরে গিয়ে পিএইচডি করা তার স্বপ্ন। ডাক্তারি পড়ার মাঝপথে বিয়ে হলে তার পড়াশোনায় ক্ষতি হবে। এ মুহূর্তে তার বিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। শেহরিমের বাবা তার স্ত্রীকে বুঝালো। কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হলো না। তার এক কথা, বিয়ে আজ নাহয় কাল করতেই হবে। তাহলে আজ বিয়ে করলে মন্দ কী? সে তো ছেলের ভালোর জন্য-ই বলছে। এমনও তো নয় যে তাদের ছাত্র ছেলের বউয়ের খরচ জুটানোর সামর্থ্য নেই।

শেহরিমের কোনো যুক্তি-ই সে শুনবে না। সে মেয়ে পছন্দ করেছে এবং তাকেই শেহরিমকে বিয়ে করতে হবে ব্যাস। শেহরিম পড়াশোনার যুক্তি দিলো। এর উত্তরে শেহরিমের মা বললো, “পড়ার মতো পড়লে এই সমস্যা তুচ্ছ।”

দিন কে দিন খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিলো শেহরিমের মা। সে তার জেদে অনড়। সে বিয়ে করিয়েই ছাড়বে। মায়ের করুণ অবস্থায় শেহরিম বেশ বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজি হলো। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হলো তাশুতির মামার বাসায়। তখন তাশুতি মামার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করতো। ঢাকার বাতাস অনুভব করার প্রবল ইচ্ছে ছিলো তার। তাইতো নিজ বাসস্থান ছেড়ে মামার বাড়িতেই এসে উঠে। এতে মামা অথবা মামী কারোই কোনো অভিযোগ ছিলো না। আনোশী তখন তার অসুস্থ বাবার সঙ্গে গাজীপুরে থাকতো। সেখানে পড়াশোনা করছিলো সে।

হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব তাও আবার বড়োলোক ঘর থেকে। তাশুতির মনে না চাইতেও লোভ জমে গেলো। ছেলেকে দেখে তো তার মস্তিষ্ক উড়ান দেয়। যদি ছেলেটা তার স্বামী হয় তাহলে তার জীবন ধন্য হয়ে যাবে। শুরু থেকেই পড়াশোনায় বেশ অনিহা তাশুতির। পড়াশোনার চাইতে ফ্যান্টাসি লাইফ বেশি পছন্দ করতো। কিন্তু বাবার কড়া শাসনে এত স্বাধীনতা পায়নি। মামার বাড়িতে এসেই যেন সব স্বাধীনতা পেলো সে। পাত্রী দেখার দিন শেহরিম একটা কথাও বলেনি তাশুতির সাথে। তাশুতি প্রয়োজন বোধ না করলেও পরে নাম্বার নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। বিয়েটা একমাস পরপরই হলো। ধুমধাম আয়োজনে। তাশুতি সেদিন খুব খুশি ছিলো। খুশিতে অসুস্থ বাবার কথা ভুলেই বসেছিলো সে। বিয়ের দিন আনোশী আসতে পারেনি। সেদিন আনোশীর বাবা অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। আনোশী এবং আনোশীর চাচা’রা মিলে সব সামলিয়েছে। আনোশী-ই কাউকে এ খবর জানায়নি। তাশুতি তার জীবনের সেরা দিনে কষ্ট পাক সেটাও চায়নি।

সেদিন তাশুতি এবং শেহরিমের বাসর রাত ছিলো। শেহরিম রুমে এসে তাশুতির হাতে উপহার ধরিয়ে দিয়ে বেশ থমথমে সুরে বলেছিলো,
–“যতদিন আমাদের পড়াশোনা শেষ না হবে ততদিন অবধি আমাদের একসাথে না থাকাই মঙ্গল। আশা রাখছি আপনি সন্তুষ্ট হবেন আমার সিদ্ধান্তে।”

বলেই শেহরিম খাটের নিচ থেকে অতিরিক্ত তোষক, বালিশ, কাঁথা বের করলো। অতঃপর তোষক বিছিয়ে ফ্লোরেই শুয়ে পরলো সে। আগে থেকেই এই তোষকের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো সে। মায়ের জন্যে যে আর কী কী করতে হবে সেটা উপরওয়ালাই ভালো জানেন। তাশুতি সেদিন থমকে বসে দেখছিলো শেহরিমের কর্মকান্ড। চোখের পলক ফেলতেই কী কী হলো ঠিক বুঝতে পারে না। সে তো ভেবেছিলো বিয়ের পর তার পড়াশোনা করতে হবে না। শেহরিমের সাথে সংসার করবে, সময় কাটাবে, প্রেম করবে। কিন্তু সব তার ভাবনার উলটো ঘটছে কেন? সেদিন তাশুতি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পরলো। বাসর রাত নিয়ে তার কতশত স্বপ্ন। সব স্বপ্নে এভাবে শেহরিম পানি ঢেলে দিবে তা তাশুতি ভাবতেই পারেনি।

এভাবে সময় কাটতে লাগলো। শেহরিমের সাথে তাশুতি অনেক বেশি মিশতে চাইতো কিন্তু শেহরিম পড়াশোনার কথা ছাড়া সেভাবে কিছুই বলতো না। স্পর্শ করা তো দূর। তাশুতি এজন্যে শেহরিমের কাছ ঘেঁষে ঘেঁষে দাঁড়াতো। এতে শেহরিম প্রত্যেকবার এক কথাই বলতো,
–“আমার সময় লাগবে তাশুতি। বিয়েটা আমার মতামতের বাহিরে ছিলো। তাই যেদিন মনে হবে আমি তোমায় ভালোবাসি সেদিন আমি নিজেই তোমার কাছে আসবো!”

পড়াশোনার ব্যাপারে শেহরিম বরাবরই সিরিয়াস। এজন্যে তাশুতির প্রতি সেরকম কোনো অনুভূতি আসতো না। তাশুতির দিকে তাকালেও সেই অনুভূতি মনে নাড়া দিতো না। কেন, সে জানে না। তাশুতিকে যেন তার হৃদয় পছন্দ করতো না। ভাবলো সময়ে গড়ালে হয়তো তাশুতিকে ভালো লাগবে, ভালোবাসতে শুরু করবে। এখনই এত তাড়া কিসের? পুরো জীবন তো পড়ে আছে। এই সময়টায় নাহয় পড়াশোনাকেই গুরুত্ব দিক।

মাস কয়েক পেরোতেই তাশুতির বান্ধুবীরা তাকে ভীষণ খোঁচাতো। কেনাকাটা নিয়ে। তাশুতির শপিং লিস্টের কয়টা জিনিস তার বর কিনে দিয়েছে, এ পর্যন্ত কী কিনেছে এরকম নানান খোঁচায় তার কান ঝালাপালা করে দিত। এ নিয়ে তাশুতিরও অভিযোগের শেষ ছিলো না। তার বর তো আসলেই বিয়ের পরপর কিচ্ছু কিনে দেয়নি, উপহারও দেয়নি। বাবা, ভাইয়েরা এত টাকা ইনকাম করে অথচ শেহরিম এত কৃপণতা করে। এসব ভাবলেই তাশুতির গা জ্বলে যায়।

শেহরিম আত্মনির্ভরশীল মানুষ। বাবার কাছে পড়াশোনার খরচ ছাড়া অতিরিক্ত খরচ সে নেয় না। লজ্জাবোধ করে। তার ফোনটা সেই দুই মাস আগে হাত ফসকে পরে ভেঙে গিয়েছিলো, সেই ফাটা গ্লাসের মোবাইল নিয়ে দিব্যি চলাফেরা করছে সে। এর মাঝে তাশুতির এত এত অভিযোগ। শেহরিম কোনো উপহার দেয় না, তাকে স্পর্শ করে না আরও নানান কথাবার্তা। এতে করে তাশুতিকে পছন্দ করার বদলে পছন্দ শব্দটাই যেন পালাতো। তবে সে এই ভেবে কষ্ট পেত তার স্ত্রীকে সে খুশি রাখতে পারছে না, সাথে তাশুতি তাকে বোঝারও চেষ্টা করে না। কিন্তু শেহরিমের এই স্বভাব বদলানো অসম্ভব। বাপের টাকা দিয়ে নিজের বউকে উপহার দিবে, সেটা কেমন দেখায় না?

এজন্যে শেহরিম মেডিক্যালে যাওয়ার পাশাপাশি দুটো টিউশনি নিলো। সপ্তাহে তিন দিন করে। একটু কষ্ট হলেও টিউশনি করিয়ে তাশুতির জন্যে টুকটাক কেনাকাটা করে দিতো। কিন্তু কথায় আছে না, মানুষের চাওয়া বেশি? তাশুতিরও কেমন লোভ বাড়তে লাগলো। তার আরও চাই। এ নিয়েই তাদের মাঝে অশান্তি লেগে থাকতো। ঝগড়া তাদের রুমের মধ্যে হলেও বাইরে সেই শব্দ যেত।

শেহরিমের মা ভেবেছিলেন হয়তো কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হলো তার বিপরীত। দিন কে দিন ভয়ংকর অশান্তি হতে লাগলো। তাশুতি কথায় কথায় শেহরিমের বেকারত্ব নিয়ে খোঁচাতো সাথে শাহেদের চাকরি নিয়েও কথা তুলতো। রোজকার এই ঝামেলা শেহরিম সইতে না পারলেও তাকে সইতে হতো। সে চাইতো না স্বামী-স্ত্রীর ভেতরকার খবর বাইরের কেউ জানুক। সে যতই গুরুতর হোক না কেন?

তাশুতি শেহরিমের পুরুষত্বের উপরও আঙুল তুলেছিলো যার কারণে শেহরিম সেদিন-ই প্রথম মারাত্মক রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিলো। প্রথম বারের মতো সেদিন-ই তাশুতির প্রতি ঘৃ* জমেছিলো শেহরিমের। বুঝতে পেরেছিলো তাশুতির জন্যে রক্ত ঝড়ালেও তাশুতি তাকে বুঝবে না। বরং রক্ত কেন ঝড়িয়েছে তারও নেতিবাচক যুক্তি বের করবে।

সেদিনের পর দুই দিন বাড়ি ফিরেনি শেহরিম। ফোন-টোন সব বন্ধ। শেহরিমের মায়ের তো যা-তা অবস্থা। শেহরিমের বেরিয়ে যাওয়ার একদিনের মাথায় তাশুতি তার লাগেজ নিয়ে মামার বাড়ি চলে এলো। শেহরিম বাড়ি ফিরতেই দেখলো মায়ের অবস্থা। ছেলেকে পেয়ে শেহরিমের মা সেদিন হাউমাউ করে কেঁদে ছেলের কাছে মাফ চেয়েছিলো। তার স্বপ্ন সে নিজেই বাস্তবায়ন করবে সে বুঝতে পারেনি। নিজের জেদের বশে কী বড়ো ভুল করেছিলেন সেটা তিনি শুধে-আসলে টের পেয়েছিলেন। তার শান্ত স্বভাবের ছেলেটা এতটা অত্যাচারের মধ্যে গেলো। সে যে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না।

শেহরিম ফেরার ঠিক দু’দিন পর তাশুতি ডিভোর্স পেপার পাঠায়। শেহরিম সময় ব্যয় না করেই সাইন করে দেয়। শেহরিমের গায়ে তালাকের তকমা লেগেছে ভাবতেই শেহরিমের মা প্রচন্ডরকম অসুস্থ হয়ে পরেন। হার্ট এট্যাক করেন তিনি। যার কারণে হসপিটালে কিছুদিন ভর্তিও ছিলেন। এত ঝামেলার মাঝেও শেহরিম তার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে পাড়ি জমালো বিদেশে। উদ্দেশ্য তার মাটিচাপা দেওয়া স্বপ্নকে পুণরায় জাগ্রত করা। এতেই তার সুখ মিলবে।

শেহরিমের পরিবার থেকেও কেউ বাঁধা দেয়নি। অনেক তো ছেলের উপর সিদ্ধান্ত চাপানো হলো। এবার নাহয় ছেলে নিজের মতো করে বাঁচুক।

———————
সব চোখের সামনে ভেসে উঠলে তা মুহূর্তে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো শেহরিম। তার বন্ধু লিমনের উদ্দেশ্যে বললো,
–“সি*রেটের প্যাকেটটা দিয়ে যাইস। সাথে কাল আরও কয়েক প্যাকেট কিনে দিস। কখনো কিনি নাই তো, অদ্ভুত লাগে!”

লিমন বন্ধুর দিকে করুণ নজরে চেয়ে বললো,
–“কী হয়েছে বল না। কৌতুহলে আমার পেটের নাড়ি-ভুড়ি সব বেরিয়ে আসছে। তোর দুইটা পায়ে পরি। এই অস্বাভাবিক ব্যবহারের কারণ বল।”

শেহরিম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
–“কিছু মানুষ জম্মায়, ভুল করার জন্যে এবং ভুল মানুষকে ভালোবাসার জন্যে। এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে আমিও একজন বন্ধু। চিনে রাখ আমার মুখটাকে। আমি হলাম ভুল পথের পথিক।”

মাথার উপর দিয়ে গেলো সব লিমনের। অবাল সুরে বললো,
–“কাকে ভালোবাসলি আবার? আমি তাও জানতাম তোর কোনো পছন্দ নেই।”

–“আনোশী। আমার প্রাক্তন স্ত্রীর বোন। যাকে পাওয়া এই ইহকালেও আমার পক্ষে সম্ভব না। তাকে পাওয়ার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র রাস্তাও বন্ধ। কারণ একটাই, আমি নিষিদ্ধতেই বারংবার আটকে পরি।”

————————
~[ক্রমশ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here