হৃদয়ে মেঘগলি পর্ব ৭

0
626

#হৃদয়ে_মেঘগলি
|০৭|
লাবিবা ওয়াহিদ

মামী কেঁদে কেঁদে বিড়বিড় করে বিলাপ করতে ব্যস্ত। মামা সোফায় হেলান দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। রিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েকে কোলে নিয়ে। বেশ কয়েকদিন বাবাকে না পেয়ে নোরাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিলো। অবশেষে বাবাকে পেয়ে তাঁর ছোট্ট হৃদয়টা আনন্দে ভরে উঠেছে।

রিয়াদকে ঘন্টাখানেক আগেই মামা কল করে আসতে বলেছে। এজন্য রিয়াদ হুট করেই এই সকালবেলা এসেছে। তাশুতি তো বেশ আনন্দ সহকারে মামীর কান্নারত মুখখানা দেখছে। এই মুখেই কত তেজ ফুটে ছিলো। এখন এক চুটকিতেই কেমন চেহারার রঙ বদলে গেছে।

কারো মুখে কোনো কথা নেই। বৈঠকঘরে পিনপতন নীরবতা। এমন সময় আনোশী রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। কাঁধের ব্যাগে ফোন ঢুকাতে ঢুকাতে দ্রুত পায়ে বের হচ্ছে সে। যাওয়ার সময় ব্যস্ত স্বরে মামীর উদ্দেশ্যে বললো,
–“মামী, আজকে খাওয়ার সময় নেই তাই আমি দ্রুত স্কুলে চলে যাচ্ছি। তুমি চিন্তা করো না, আমি বাইরে থেকে কিছু খেয়ে নিবো!!”

আনোশীর এরূপ কথাবার্তা মামীর গায়ে জ্বালাপোড়া অনুভূতি জাগালো। সে কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে,
–“এই দাঁড়া। এদিকে তোর বিয়ে ভেঙে গেলো আর তুই কী না স্কুলের তাড়া দেখাচ্ছিস? বিয়ের ভাঙার পরও দেখছি তোর তিড়িংবিড়িং কমছে না!”

বিয়ে ভাঙার কথা শুনে আনোশীর পা জোড়া দমে গেলো। আনোশী ঘাড় বাঁকিয়ে মামীর দিকে তাকালো। কথাটা অবিশ্বাস্য লাগলো আনোশীর। আনোশী ভ্রু কুচকে বললো,
–“বিয়ে ভেঙেছে?”

তাশুতি এবা হাসি চেলে বলে,
–“হ্যাঁ। বিয়ে ভেঙে দিয়েছে ওরা। সকাল সকাল শেহরিমের ভাবী কল করে বিষয়টি জানিয়েছে। শেহরিমের বাবা বিয়ে মানেনি, তাই উনি-ই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছেন!”

আনোশী শুধু মাথা নাড়ালো। তার মধ্যে শোকের লক্ষণ দেখা গেলো না। আবার আনন্দের লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সে বরাবরের মতোই স্বাভাবিক। রিয়াদ তো ভেবেছিলো আনোশী কিছুটা হলেও খুশি হবে। তার মুখশ্রীতে খুশির ঝলকানি ফুটে ওঠবে। কিন্তু সেরকম কিছুই দেখা গেলো না। এতে রিয়াদ ভারী অবাক হলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। আনোশী বরাবর-ই অদ্ভুত স্বভাবের।

আনোশী এবার মামার উদ্দেশ্যে বললো,
–“খবর জানা শেষ। এবার আসি মামা?”

মামী রাগে ফেটে পরতে চাইলো কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো রিয়াদ উপস্থিত থাকায়। মামী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“একটা মেয়ের বিয়ে ভাঙলে তার মধ্যে কিছুটা হলেও শোক থাকতে হয়। কিন্তু তুই কোন ধাতু দিয়ে তৈরি আনোশী।”

আনোশী বের হতে গিয়ে আবার থেমে গিয়ে সহজ স্বীকারোক্তি দিয়ে বললো,
–“বিয়েটা যারা ভেঙেছে তাদের শোক পালন করতে দাও। কিন্তু তুমি যেভাবে কাঁদছ মনে হচ্ছে বিয়ে আমার নয় তোমার ভেঙেছে!”

আনোশী বেরিয়ে গেলো। মামী চেঁচিয়ে ডাকলো আনোশীকে। অতঃপর বলতে লাগলো,
–“যার জন্যে করি চুরি সেই বলছে চোর। মানুষের ভালো চাওয়া মনে হচ্ছে “কাল” হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

————————
নীল চেয়ার নিয়ে আনোশীর পাশে বসে বললো,
–“আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছো মনে হচ্ছে?”

আনোশী চমকে চাইলো নীলের দিকে। নীল যে পাশে এসে বসেছে তা আনোশী বুঝতে পারেনি। নীল আবার জিজ্ঞেস করলো,
–“কী হলো? উত্তর দাও!”

আনোশী অধর কিছুটা প্রসারিত করে হাতের মার্ক করা টেস্টের খাতাগুলো নীলের দিকে বাড়িয়ে দিলো। নীল আনোশীর ইশারা বুঝতে পেরে খাতাগুলো দেখতে লাগলো। ভালো রেজাল্ট দেখে নীল বেশ অবাক হলো। নীল অবাক স্বরে বলে,
–“সত্যি তোমার প্রসংশা করতে হয় আনোশী। মেয়ে হয়ে গণিতের প্যাচ মাথায় রেখে এত উন্নত রেজাল্ট! আ’ম শিওর প্রিন্সিপাল খুব প্রসংশা করবে।”

আনোশীর চেহারা ঝলমল করে ওঠে নীলের কথায়। আনোশী নিজেকে সামলে বললো,
–“আমি কোনোরকম আশা ছাড়াই পরিশ্রম শুরু করেছি। ভাবিনি এতটা উন্নতি আনতে পারব। এই শিক্ষকতায় আমি দুটো জিনিস পেয়েছি জানেন? এক শিক্ষিকা হিসেবে সম্মান এবং এই নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোর হাসি। ওদের হাসিতে আমি প্রশান্তি খুঁজে পাই।”

নীল হেসে বলে,
–“কংগ্রেচুলেশন আনোশী। এখন আমি ট্রীট চাই। আপনি চা খাওয়াবেন আর আমি টাকা দিবো।”

আনোশী হালকা হেসে বললো,
–“আপনিও না। টাকা আপনি দিলে ট্রীটটা তো আপনি-ই দিয়ে দিলেন।”

–“তাহলে আমার তরফ থেকেই ট্রীট হোক। যেদিন আমি সফল হবো সেদিন তুমি আমাকে ট্রীট দিবে। ঠিকাছে?”

আনোশী ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বলে, “ঠিকাছে।”

আনোশী এবং নীল দু’জন পাশাপাশি বসে চা খাচ্ছে। চা পেয়ে নিজেকে আরও বেশি ফুরফুরে লাগছে আনোশীর। আজ যেন কাঁধের উপর থেকে অনেক বড়ো বোঝা নেমে গেছে। এতদিন চিন্তায় সে নিজেও অস্বাভাবিক ছিলো। নয়তো শেহরিমের সাথে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারটা তার নিকট দুঃস্বপ্ন ব্যতীত কিছুই লাগতো না। নীল চায়ে চুমুক দিয়ে বলতে লাগে,

–“এত অন্যমনস্ক কেন তুমি আনোশী?”

আনোশী চমকে নীলের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
–“এমনি।”
–“কিছু হয়েছে?”
–“না। পারিবারিক সমস্যা।”
–“ওহ। তোমার বাবা-মা ঘটিত?”

আনোশী চা শেষ না করেই চা পাশের গাছে ফেলে দিয়ে থমথমে স্বরে বললো,
–“নাহ। আমি তো এতিম!”
নীল ব্যথিত স্বরে বললো,
–“স্যরি। আমি সত্যি জানতাম না। ভুল করে বলে ফেলেছি। তুমি চা কেন ফেলে দিলে?”

আনোশী হেসে বলে,
–“খেতে ইচ্ছে করলো না। তাই। আর ব্যস্ত হবেন না। আমি কিছু মনে করিনি।”

—————————-
শেহরিম তার বন্ধু লিমনকে ডেকে আনলো। লিমন দ্রুত ছুটতে ছুটতে এসেছে শেহরিমের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–“এতদিন খবর নেও নাই মিয়া এখন আবার এত জরুরি তলব? মতলব কী রে তোর?”

লিমন আরও কিছু বলার পূর্বেই শেহরিম তার কথায় ফোড়ন কেটে বললো,
–“সিগারেট হবে?”

লিমন হতভম্ভ নজরে চেয়ে রইলো বন্ধুর দিকে। শেহরিমের নজর তার দিকে নেই। বরং সে শূণ্য নজরে অদূরে চেয়ে আছে। লিমন অস্ফুট স্বরে বললো,
–“কী বলছিস? কী করবি?”
–“দে। লাইটার থাকলে ওটাও দে।”

লিমন পকেটে হাত ঢুকাতেও ভুলে গেলো। এটা কী সেই শেহরিম যে সিগারেটের গন্ধও সহ্য করতে পারতো না? লিমনের কোনো হেলদোল না দেখে শেহরিম ধমকালো।
–“কী হলো? কানে ঢুকেনি কথা?”

লিমন বাস্তবে ফিরে এসে ভয়ে ভয়ে পকেটে হাত ঢুকালো। আমতা আমতা করে বললো,
–“কিন্তু দোস্ত, তুই তো স্মোক করিস না।”

শেহরিম লিমনের হাত থেকে সি*রেটের বক্সটি কেড়ে নিয়ে বললো,
–“এখন থেকে করবো। কোনো সমস্যা আছে?”

বলেই লিমনের চোখের পলকে শেহরিম সি*গারেট জ্বালিয়ে ফুঁক দিলো। লিমন হতবুদ্ধি হারিয়ে শেহরিমের দিকে তাকিয়ে আছে। এ যেন আলাদা শেহরিম তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লিমন বললো,

–“কী এমন হলো যে তুই এসবে হাত লাগালি?”

শেহরিম কিছু বললো না। নির্লিপ্ত চোখে অদূরে চেয়ে শূণ্যে ধোঁয়া ওঠাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। তাঁর চোখের সামনে ভাসতে লাগলো সেই বিভৎস অতীত। যার জন্যে আজও তাঁর জীবন এতটা এলোমেলো।

“তখন শেহরিম এমবিবিএস এর চতুর্থ ইয়ারে ছিলো। তার মায়ের তখন খুব দুঃখ, বড়ো ছেলেকে নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারলো না। সেই শোকে তিনি দিন-রাত কোনো এক চিন্তায় বিভোর থাকতেন। একদিন দুঃস্বপ্ন দেখলেন তার ছোট ছেলেও একই কাজ করেছে এবং এর কারণে তার সুন্দর সংসার টানা-হেঁচড়ায় রয়েছে। এজন্যে বেশ ভয়ে জর্জরিত শেহরিমের মা সিদ্ধান্ত নিলেন শেহরিমকে এই বয়সেই বিয়ে দিবেন। যদি শেহরিমের কাউকে পছন্দ হয়ে যায়? আর তাঁর স্বপ্নটাও সত্যি হয়ে যায়?

এজন্যে গোপনে তিনি মেয়ে দেখা শুরু করলেন। তার স্বামী, সন্তানদের অগোচরে। এভাবে মেয়ে দেখতে দেখতে একদিন রাস্তায় সে তাশুতিকে দেখতে পায়। তাশুতি রূপে-গুণে অমায়িক ছিলো। তার রূপ যে কারোই চোখে লাগার মতো। শেহরিমের মাও এর ব্যতিক্রম নয়।

যাকে দিয়ে বিয়ের ঘটকালি করাচ্ছে সেও শেহরিমের মায়ের সঙ্গে ছিলো। তাশুতিকে প্রথম দেখায় তার ভীষণ পছন্দ হলো। এজন্যে ঘটককে তাশুতিকে দেখিয়ে সব-রকম খোঁজ – খবর লাগাতে বললো। ওরা চলে যেতেই তাশুতির সাথে একটি ছেলে দেখা করতে আসলো। তাশুতি হেসে হেসে সেই ছেলেটির বাহু জড়িয়ে কোথাও চলে গেলো।”

~[ক্রমশ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here