#হৃদয়ে_মেঘগলি
|০৪|
লাবিবা ওয়াহিদ
তাহানকে স্কুল দিয়ে আসার সময় আনোশীকে দেখতে পায়নি শেহরিম। যার কারণে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখে একরাশ তৃষ্ণা নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাইক চালাতে চালাতে ভাবতে লাগলো সেদিনের কথা। যেদিন আনোশীকে প্রথম দেখেছিলো শেহরিম।
তাহানকে একদিন রাইমা স্কুলে দিয়ে আসতে পারেনি বিধায় শেহরিম-ই তাকে ড্রপ করে দেয়। ড্রপ করতে গিয়ে সেদিন-ই ভালোভাবে লক্ষ্য করে আনোশীকে।
প্রথম দিন আনোশীকে দেখে সে ভীষণ মুগ্ধ হয়। অবশ্য চেনা চেনাও লাগতো। কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারতো না। হয়তো রাস্তা-ঘাটে চলাচলের সময় নজরে পরেছিলো। শেহরিমের বিয়েটা একপ্রকার তাঁর অমতে হয়েছিলো। যার কারণে সে আনোশীকে সেভাবে খেয়াল করেনি। এছাড়া আনোশীও বিয়েতে উপস্থিত ছিলো না।
বিয়ের পর এক দু’বার দেখেছিলো তাও সেরকম ভাবে লক্ষ্য করেনি। আনোশীরও সেরকম কথা বলার স্বভাব ছিলো না। তখন আনোশী ছিলো ছোট। হয়তো ১৭-১৮ বয়স ছিলো। ছয়-সাত বছরে আনোশীকে প্রায় ভুলে গিয়েছিলো সে। নাম-চেহারা কিছুই তাঁর মনে ছিলো না। এভাবে প্রায়-ই আনোশীকে দেখতো সে। এক সময় কীভাবে পছন্দ করে বসলো তা শেহরিমের নিজেরও জানা নেই।
চিন্তা করলো বিয়ের প্রস্তাব দিবে। প্রেমের বয়স তাঁর অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। আনোশীর ব্যাপারে খোঁজ-খবর লাগিয়ে দিন-রাত এক করে আনোশীকে নিয়ে ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো সে। বাসাতেও জানিয়ে দিলো সে এক মেয়েকে পছন্দ করে যে একদম শেহরিমের মনের মতো।
শেহরিমের বরাবর-ই আত্মনির্ভরশীল মেয়ে পছন্দ। সেটা কখনো প্রকাশ করতে না পারলেও তাঁর এই পছন্দ এখনো সচল। বাড়ির সবাই-ও ভীষণ খুশি এই ভেবে যে বাড়ির ছোট ছেলের জীবনে নতুন কেউ আসবে, যাকে শেহরিম নিজে পছন্দ করেছে। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো শেহরিমের মা। তাঁর জন্যে খবরটি যেমন অবিশ্বাস্য ছিলো তেমন-ই আনন্দের ছিলো।
দু’দিন পর খবর আসলে জানতে পারে মেয়েটি আর কেউ নয় তাশুতির ছোট বোন। এই খবরের শোক কাটাতে শেহরিমের বেশ সময় লেগেছিলো। কাউকেই জানায়নি এই খবর। বেশ কয়েকদিন এ নিয়ে গভীর চিন্তা করলো। কিন্তু আফসোস, অনেকটা দেরী করে ফেলেছে। আনোশীর সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে মিশে গেছে শেহরিম। চাইলেও ভুলতে পারেনি সে। এজন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো, আনোশীকেই সে বিয়ে করবে। তাকে ছাড়া শেহরিমের একদম চলবে না। তাশুতির বোনের কথা শুনে শেহরিমের মা রেগে-মেগে নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছিলো। যার কারণে শেহরিম বাধ্য হয়েই ভাবী এবং ফুপিকে সাথে নিয়ে আনোশীদের বাসায় আসে।
মামাও না করতে পারেনি। আগেরবার শেহরিম ছিলো ছাত্র কিন্তু এখন সফল চিকিৎসক। শেহরিমকে সে যতটুকু চিনেছে তাতে শেহরিম বেশ ভালো পাত্র। যদি তাশুতি শেহরিমের কদর করতে জানতো তাহলে আজকে সবচেয়ে সুখী মানুষ হতো এই জেদী তাশুতি-ই। কিন্তু তাশুতি তাঁর জেদ এবং ধৈর্যহারা স্বভাবের কারণে নিজের কপালে নিজেই চা*টি মে*ছে।
আনোশী আবার স্বভাবে তাশুতির সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। দুই বোন চার বছরের ছোট-বড়ো।
অন্যমনস্ক হওয়ার ফলে শেহরিম একটুর জন্যে দুর্ঘটনার কবলে পরেনি। শেহরিম দ্রুত বাইকের ব্রেক কষলো। তাঁর সামনের প্রাইভেট কারের ড্রাইভার শেহরিমকে খুব বকাঝকা করতে লাগলো। শেহরিম ছোট করে “স্যরি” বলে গাড়ির পাশ কেটে চলে গেলো।
————————–
গতকালকের মতোই আনোশী ক্লাস সেরে তাঁর নির্ধারিত চেয়ারে বসলো। নীল কিছুটা দূরে চাপা স্বরে ফোনে কথা বলছে। অফিস রুমের নিয়ম-ই এরকম। কেউ উঁচু শব্দে কথা বলতে পারবে না। যা বলার সব ধীরে বলতে হবে। নয়তো পরিবেশ নষ্ট হবে বলে হেড মাস্টারের ধারণা।
আনোশী বোতলের ছিপি খুলে তিন ঢোঁক পানি খেয়ে বোতল আটকে নিলো। অতঃপর বোতলটা ব্যাগে ভরতে ভরতে আড়চোখে চাইলো নীলের দিকে। নীল পকেটে ফোন পুরতে পুরতে আনোশীর দিকেই এগিয়ে আসছে। নীলকে তাঁর দিকে আসতে দেখে আনোশী নড়েচড়ে বসলো। নীল নিত্যদিনের মতোই চেয়ার টেনে আনোশীর সামনে বসে চাপা স্বরে বললো,
–“মাথা ব্যথা করছে। চলো চা খেয়ে আসি!”
–“মাথা ব্যথা আপনার, আমার নয়। আমি গিয়ে কী করবো?”
–“আরে আসো না। দু’জনে গেলে ভালো লাগবে!”
–“গতকাল না প্রমিস করলেন চা খাওয়ার জন্যে কোনো অফার করবেন না!”
নীল কিছুটা চিন্তায় ভ্রু কুচকে ফেললো। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বললো,
–“বলেছিলাম বুঝি? আমার তো মনে পরছে না।”
আনোশী হালকা হেসে ফেললো নীলের কান্ড দেখে। নীলও আলতো হেসে বললো,
–“হাসলে তোমাকে সুন্দর লাগে আনোশী!”
নীলের এই কথা শুনে আনোশী হাসি বন্ধ করে আবার নিজের আগের রূপে ফিরে এলো। মুখটা থমথমে করে বললো,
–“চলুন!”
চা খাওয়া শেষ হলে নীল যখন টাকা দিতে যাবে ওমনি টঙের লোকটি দাঁত কেলিয়ে বলে ওঠে,
–“মেডাম আগেই টাকা দিয়ে দিছে!”
নীল টাকা হাতে নিয়ে আনোশীর দিকে চাইলো। আনোশী তখনো চায়ে চুমুক দিচ্ছে। নীল ভ্রু কুচকে বললো,
–“এটা কিন্তু ঠিক হলো না!”
আনোশী শূণ্য চায়ের কাপ লোকটির হাতে দিয়ে বলে,
–“গতকাল আপনি টাকা দিতে দেননি। বলেছেন অন্যদিন টাকা দিতে। সুযোগ বুঝে আজ দিয়ে দিলাম!”
নীল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাসলো। বললো,
–“তোমার যুক্তির সাথে আমি পারবো না!”
–“পারার দরকার আছে?”
নীল মাথা চুলকে বলল,
–“একটু একটু!”
আনোশী আবার হাসলো। নীল ছেলেটা সত্যি-ই অদ্ভুত এবং চঞ্চল। আনোশী ইদানীং খেয়াল করেছে, নীলের সাথে সময় কাটালে তাঁর হালকা অনুভব হয়। নীলের সাথে মিশলে পারিবারিক কোনো চিন্তা মাথায় আসে না। কেমন ফুরফুরে মেজাজ থাকে। আচ্ছা এই অনুভূতি কী নীলের মাঝেও আসে?
—————
তাশুতি এবং রাইমা একটি ক্যাফেতে বসে আছে। তাশুতি চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
–“এবার বলবো?”
রাইমা বললো,
–“সময় হাতে বেশি নেই। যা বলার বলে ফেলো!”
–“তোমাকে আমি অনুরোধ করছি রাইমা আপু, প্লিজ তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও। মামা, মামীর মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। তাই আমি বলছি, বিয়েটা যেভাবে পারো ভাঙো। শেহরিমের সাথে আমার বোন সুখে থাকবে না।আমার মতোই অসুখে ভুগবে আমার বোন। আমি চাই না আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত হোক!”
রাইমা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
–“ও আচ্ছা তাই? আমার দেবর তোমার গায়ে হাত তুলেছে? নাকি তোমার কোনো চাওয়া অপূর্ণ করেছে? সমস্যা ছিলো সে তখন ছাত্র ছিলো, তোমার অধিক চাওয়া সে পূরণ করতে পারেনি আর তুমিও এ নিয়ে ভীষণ বিরক্ত ছিলে। ডিভোর্সও তুমি দিলে, কিন্তু তোমার বাড়ীতে গল্প এমন ভাবে সাজালে যে তোমার উপর অত্যা*র করেছে আমার দেবর। তোমায় অবহেলা করতো, কষ্ট দিতো। আচ্ছা সব বুঝলাম, ডিভোর্সের পরপর তুমি আমার হাসবেন্ডের উপর নজর দিয়েছিলে সেটা বলেছিলে তোমার পরিবারকে? তোমার ওই বোনকে?”
রাইমার কথা শুনে তাশুতি বেশ ঘাবড়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললো,
–“মা..মানে? ক..কী বলতে চাইছো তুমি আপু?”
রাইমা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
–“কেন? ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাবো? শাহেদ আর আমার প্রেম ছিলো অনেক আগে থেকেই। এটা আমাদের পরিবারের মাঝে জানা-জানি ছিলো। এজন্য আমার বাবা বলেছিলো আমার অনার্স শেষ হলেই শাহেদের সাথে আমার বিয়ে হবে। যার কারণে শাহেদের আগে শেহরিমের বিয়ে হয়ে যায়। মা-ই জেদ করে বিয়ে দেয় ওকে। তোমার ডিভোর্সের সময় শাহেদ ভালো পোস্টে জব করতো। আমি তখনো অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আটকে ছিলাম। সেখানে তুমি আমার হবু হাসবেন্ডের সাথে লাইন মা*তে গিয়েছো। তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছো। এটা কীরকম গোল মেলে হিসাব হয়ে গেলো না? শোকর করো যে শেহরিম এখনো এসব কিছু জানে না। জানলে কী হবে একবার ভাবো তো?”
তাশুতির কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়তে লাগলো। সে আটকে গলায় বললো,
–“ত..তুমি মিথ্যা বলছো। এসব ক..কিছুই না!!”
হাসলো রাইমা। হেসে বললো,
–“ঠিকাছে। তোমার কথাই মানলাম। তবে চিন্তা করো না, তোমার ছায়া আমার পরিবারে দ্বিতীয়বার পরতে দিবো না। এমনকি শেহরিমের জীবনেও না। তোমার বোন মানে তোমার-ই প্রতিচ্ছবি। যে করেই হোক, আমি এই বিয়ে ভাঙবো!”
———————–
–“বাব্বাহ। ডাক্তারের সাথে বিয়ে দিবেন আনোশীকে? তা আনোশীর বয়স কী তাঁরা জানে?”
মামী প্রতিবেশীর কথায় চুপসে গেলো। পরক্ষণে আলতো হেসে বললো,
–“জানবে না কেন? অবশ্যই জানে। তাঁরাই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ঘটকালির কোনো হাত নেই এবার।”
–“তাও ভাবী, বুঝে – শুনে যা করার করবেন। আপনাদের মেয়ের আবার যা ভাব! ভাবে তো মনে হয় মাটিতে পাও পরে না।”
মামীর শরীর জ্বালানোর জন্যে এই কথা যথেষ্ট ছিলো। তাও মামী জোরপূর্বক হেসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এটা ভাব না ভাবী। আমাদের মেয়ে বড়োই লক্ষী স্বভাবের। কথা কম বলে। নইলে বেশি কথা বললে তো আবার মানুষ বলবে, “এই বয়সেও মেয়ে উড়াউড়ি করে!”
মহিলা মামীর খোঁচা ভালোভাবেই বুঝলো। তাও চাপা হেসে বলে,
–“হু, তাইতো! আজ নাহয় আসি ভাবী। ম্যালা কাজ পরে আছে!”
বলেই মহিলা চলে গেলো। মামী মিনমিন করে কতক্ষণ মহিলাকে গাল-মন্দ করে চেঁচিয়ে ছেলে-মেয়েকে ডাকলো। অতঃপর তাদের শাসিয়ে বললো,
–“খবরদার যদি এই মহিলার ছেলের সাথে তোদের খেলতে দেখেছি! দেখলে দুটোর পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে দিবো!”
তাশুতি বোরকার উপরের হিজাব খুলতে খুলতে বৈঠকঘরে প্রবেশ করতে করতে বলে,
–“সকাল সকাল ওদের বকছ্ কেন মামী?”
মামীর আগুনে ঘি ঢালার মতো লাগলো তাশুতির বলা বাক্য। তিনি তাশুতির দিকে না তাকিয়ে ছেলে-মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“কী? এখনো দাঁড়িয়ে কেন? ঘরে যাও!”
তাশুতি হিজাব-বোরকা খুলে হাসতে হাসতে সোফায় বসলো। এবং বললো,
–“আমায় এড়িয়ে যাচ্ছো?”
–“এড়িয়ে যাব কেন? আমার আর কোনো কাজ নেই?”
তাশুতি প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলে,
–“কাজ তো তোমার ওই এক বিয়ে নিয়ে চিন্তা করা। করো করো, যত ইচ্ছে চিন্তা করো, কিন্তু ফলাফল দেখবে শূণ্য!”
মামী বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
–“মেলা করে কই গেছিলি মেয়েকে রেখে? আর শ্বশুরবাড়ী যাবি কবে?”
তাশুতি হেসে বললো,
–“আরে এত তাড়া কিসের? বোনের বিয়ে ভাঙতে যাচ্ছে, তোমার করুণ মুখ না দেখে তো যেতে পারবো না। যত হোক, তুমি আমার আদরের মামী বলে কথা!”
তাশুতির দিকে সন্দিহান নজরে চাইলো মামী। কী বলতে চাইছে এই মেয়ে? হঠাৎ চেহারার এত পরিবর্তন হলো কী করে? এসব নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতেই মামী বসা ছেড়ে উঠে চলে গেলো। তাশুতি পেছনে হেলান দিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে রইলো। অধরে তাঁর প্রশান্তির হাসি।
~[ক্রমশ]