#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#পর্ব_০৬
#মোহনা_হক
-‘আমার বিয়ে নিয়ে ইদানিং খুব মাতামাতি চলছে। এই বাড়ির যে দুই মেয়ে এখন আছে। অবিবাহিত। আমি চাই তাদের আগে বিয়ে দেওয়া হোক। ইনিমারটা পরে হলেও চলবে। আমারটা আরো কয়েক বছর পর। আপাতত রুয়াত আর নিমি কে বিয়ে দেওয়া হোক।’
বাড়ির সকল মানুষের সামনে আয়াজ কথাটি নির্দ্বিধায় বলে দিলো। রুয়াতের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিমি বড়সড় ঢোক গিলে। চোখ ঘুরিয়ে জেবা আর মাহের চৌধুরী কে দেখে নিলো একবার। ফজলুল চৌধুরী খুব মনোযোগ দিয়ে তাকায় আয়াজের দিকে। রাহীম চৌধুরী বড় নাতির কথা শুনে কিছুটা চমকালেন। মায়া চৌধুরী একবার রুয়াতের দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। খুব মজা পাচ্ছেন তিনি। তবে আয়াজ যে একেবারে সবার সামনে এসব বলবে সেটা অজানা ছিলো। মেহরুবা ভ্রু কুচকালেন। রুয়াত কে একবার দেখে আয়াজ কে প্রশ্ন করলো-
-‘কিসব বলছিস বাবা?’
আয়াজ ঘাড় বাঁকিয়ে একবার প্রেয়সীর পানে চায়। পরক্ষণেই কেউ বুঝে ওঠার আগেই আবারও সোজা হয়।
-‘তোমার আদরের বড় মেয়ে রুয়াত। আমি কাকে বিয়ে করবো না করবো সেটা নিয়ে মাথা ব্যাথা তার। এগুলো একপ্রকার রোগের মধ্যে পড়ে। আমি সেদিন দাদাভাইয়ের সামনে বলেছিলাম বিয়ে নিয়ে। এখন তারা গোয়েন্দা বাহিনী লাগিয়েছে। এই মেয়ে কে বেশিদিন রাখতে পারবে না ছোট মা। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দাও।’
রুয়াত লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। ইশ কার আশকারায় এমন কাজ করেছে? এই নিমির জন্য প্রত্যেক পদে পদে অপমানিত হওয়া লাগে। রুয়াত ঘাড় উঁচিয়ে নিমির দিকে তাকায়। ভয়ে জড়সড় অবস্থা তার। এই মুহুর্তে নিমির নাম বলে দিলে নিশ্চয়ই ফেঁসে যাবে। আবারও রুয়াত মাথা নিচু করে ফেললো। লজ্জা দেওয়ার ব্যাপারে আয়াজ খুব পটু। মনে পড়তেই রাগ হচ্ছে রুয়াতের। বিরক্তিকর লোক একদম। অসহ্য। তার বিয়ে নিয়ে দু’টো কথা বলেছে তাই বলে কি এভাবে সবার সামনে অপমান করবে? আয়েশা চৌধুরী সব বুঝে আঁচলে মুখ বুজে হাসছেন। নিমির সামনে বরাবর আয়াজ দাঁড়িয়ে বলে-
-‘এই যে আরেকজন। সে এসবের মাস্টার। আর ওইটা এসিস্ট্যান্ট। পরীক্ষা তো দিলে মান সম্মত ফলাফল আনতে পারবে? সারাদিন এগুলো নিয়ে পড়ে থাকলে পড়াশোনা বুঝি ঘোড়ার গাড়ি মতো দৌড়াবে তাইনা!’
মেহরুবা নিশ্চুপ হয়ে আছে। যা বুঝেছে নিমির আশকারা পেয়ে এমন করেছে। কিন্তু এইতো কয়েকদিন আগেই তো থা’প্প’ড় মেরেছিলো। এই মেয়ে এখন’ই ভুলে গিয়েছে? মানুষ হলো না আর। মেহরুবার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। শুধু চুপচাপ শুনে নিলো সবকিছু। তবে ব’দ হজমের ব্যাপারটা আছে না সেটা হচ্ছে আজ কিছু কথা বলাই লাগবে রুয়াত কে। নাহয় এখন তো মানুষ হয় নি পরে আরও হতে পারবে না। যাকে বলে বিবেকবুদ্ধিহীন মানুষ। জেবা তেড়ে গেলো নিমির দিকে। সব দিক দিয়েই অভদ্রতা এই মেয়ের। মা হয়ে সহ্য করতে পারছে না। অন্য মানুষ কিভাবে করবে? জেবা মুখ খুলেছে কিছু বলবে তার আগেই আয়াজ চোখে ইশারা করে চুপ থাকার জন্য। আস্তে করে মুখটা জেবার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে-
-‘বকা দিও না মেজো মা। আমি তো বলেছি। আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে। আর নাহলে আয়াজ আছে। তুমি এখন কিছু বলো না।’
জেবার আয়াজের কথায় ভরসা পায়। সরে আসে সেখান থেকে। নিমির পাশাপাশি বরাবর সোজা হয়ে দাঁড়ায় আয়াজ। ফজলুল চৌধুরী আর পাত্তা দিলেন না এসবে। রূহান তার বোনের হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে। স্পষ্ট মুখে ভাস্যমান ভীষণ লজ্জা প্লাস কষ্ট পেয়েছে। নিমির চোখ দিয়ে সবার অগোচরে দু চোখ দিয়ে পানি পড়ে গিয়েছে। চোখ থেকে পড়তেই তাড়াতাড়ি করে আবার মুছে নিয়েছে। সবার চোখ ফাঁকি দিলেও আয়াজের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। নিমি আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে।
-‘কেঁদো না।’
আয়াজের নিচুস্তরের কন্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে যায় নিমি। তার চোখের পানি নিমিষেই উধাও। সে কি আদোও কানে শুনেছে ঠিক মতো। সিরিয়াসলি আয়াজ এটা বলেছে! শ্রবণ করতে কষ্ট হচ্ছে। নিমি ভয়ে সরে দাঁড়ায়। আয়াজ হেঁটে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ফজলুল চৌধুরীর পাশে বসে। তার সোজাসুজি রুয়াত বসে আছে অপর সোফায়। রুয়াত উঠে চলে আসে সেখান থেকে। একদম তার রুমে চলে যায়। মেহরুবা ও পিছন পিছন যায়। আয়াজ একদম ঠিক ধরেছে এখন মেহরুবা গিয়ে ইচ্ছেমতো বলবে রুয়াত কে। নিমি কে তো ঠিকই বাঁচিয়ে দিলো এখন তার প্রেয়সীকে বাঁচাবে কে? কিছু একটা ভেবে আয়াজ উচ্চস্বরে মেহরুবার উদ্দেশ্যে বলে-
-‘ছোট মা যেও না। কথা আছে তোমার সাথে। এখানে আসো।’
মেহরুবা থেমে যায়। আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়ায়। নিমি দৌড় দিয়ে চলে গিয়েছে উপরে। মাহের চৌধুরী সেদিক একবার তাকিয়ে বলে উঠে
-‘ভাই কি কারণে আমাদের এতো তাড়াহুড়ো করে নিচে নামতে বললে? কোনো বিশেষ কিছু কি?’
ফজলুল চৌধুরী সোফায় হেলান দেয়। চশমাটা একটু ঠিক ঠাক করে বসে। কাল তার ছোট ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুর যন্ত্রণা একদিনে পায় নি তার ছোট ভাই। ধিরে ধিরে অসুখে পোকার মতো শরীর নষ্ট করে ফেলে। প্রতি বছর হান্নান চৌধুরীর জন্য বড় করে মিলাদ পড়ানো হয়। এবারও ইচ্ছে আছে সেরকমটাই করার। থমথমে স্বরে ফজলুল চৌধুরী বলে-
-‘আমি হান্নানের মৃত্যুবার্ষিকী তে প্রতিবার যেটা করি সেটাই করবো এবার। আমার সব ভাবা হয়ে গিয়েছে। কাল সকালেই যাবতীয় জিনিসপত্র বাসায় চলে আসবে আর রইলো মানুষের দাওয়াত। সেটাও দিয়ে এসেছি। আজ আমি আর অফিস যাইনি। এই কাজেই বেরিয়েছিলাম। আয়াজ ও ছিলো আমার সাথে। যাই হোক। এখন আমার সবার সাহায্যের প্রয়োজন। আশাকরি তোমরা আমাকে এসব কাজে সাহায্য করবে। আর মেহরুবা তোমার বাপের বাড়ি থেকে কাউকে আসতে বলো।’
আয়েশা চৌধুরী নিরবে চোখের পানি মুছে নেয়। তার ছেলের মৃত্যু যেনো এখনো চোখের সামনে ভাসে। মায়ের আগে ছেলেই চলে গেলো। বলা আছে পৃথিবীতে আসার হিসেবে আছে যাওয়ার নেই৷ আয়েশা চৌধুরী ও তার ছেলে হান্নান চৌধুরী তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। মেহরুবা কেঁদে চলছে। অনেকেই এখন স্বান্তনা দিতে আসবে। রাহীম চৌধুরী তার স্ত্রী কে সামলাচ্ছে। মেহরুবা কে সামলাবে? যিনি ছিলো তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে দূরে পাড়ি জমিয়েছে। আয়াজ মন শক্ত করে। উঠে মেহরুবার পাশে দাঁড়ায়। জড়িয়ে ধরে কান্নারত মেহরুবা কে। মেয়ের মানুষের কান্না সহ্য হয় না। আর সেখানে কিভাবে বসে বসে মেহরুবার কান্না সহ্য করে নিবে? আয়াজ মেহরুবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মায়া চৌধুরী নানান কথা বলে স্বান্তনা দিচ্ছে। ফজলুল চৌধুরী উঠে চলে গেলো। এগুলো সহ্য করার ক্ষমতা নেই এখন আর। শরীর ও সয় না এতো কিছু। মাহের চৌধুরী দ্রুত তার চোখ থেকে আসা নোনাপানি মুছে নিলো।
-‘ছোট মা তুমি কাঁদলে আমার একটুও ভালো লাগে না। কেনো কাঁদছো বলো তো? কোনো লাভ আছে এভাবে কেঁদে। তুমি শুধু দোয়া করো। সেটাই ভালো হবে।’
আয়াজের কথা শুনে মেহরুবা বলে-
-‘আমি রুয়াত আর রূহান কে এতোদিন কিভাবে সামলিয়েছি আমি জানি শুধু। দিনের পর দিন রুয়াতের সামনে নিজেকে শক্ত করে রেখেছি। রূহান তো অবুঝ। কিন্তু রুয়াত সে তো সব বুঝে। আজও বাবার শূন্যতা মেয়েটা কে পুড়িয়ে মারছে। আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করি বল।’
-‘আমি আছি ছোট মা। কিছু হবে না। তুমি শুধু কেঁদো না তাহলেই হবে।’
মায়া চৌধুরী একবার তার ছেলের দিকে তাকায়। তার ছেলের বলা এমন কথা শুনে ভালো লাগছে। ছেলে কে যে মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছে এটাতেই তিনি খুশি। হাত উঁচিয়ে আয়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
.
নিমি দু গালে হাত দিয়ে ভর দিয়ে রুয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। রুয়াত কে একের পর এক কথা জিগ্যেস করছে কিন্তু রুয়াত চুপ করে আছে। অপমান শুনে এখন কোমায় চলে গিয়েছে বোধহয়। নিমি তার কন্ঠস্বর উঁচু করে বললো,
-‘কিরে রুয়াত তুই কি বাংলাদেশে আছিস? নাকি হারিয়ে গিয়েছিস কোঁথাও? আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস আদোও?’
নিমির কথায় রুয়াত বিরক্তিকর শব্দ করে৷ একে তো এসেছে তার উপর বকবক করেই চলেছে। এই মেয়ে কখনো শোধরাবার নয়। আর সেটার চেষ্টা ও করে না। প্রতিবার তার জন্য রুয়াত ফাঁসবে। আর সে এসে বক বক শুরু করে দিবে।
-‘তোকে যে এখন আমার এই রুমে ঢুকতে দিয়েছি সেটার তোর দশ কপালের ভাগ্য। যদি আর একটাও কথা বলিস তাহলে কিন্তু আমি বের করে দিবো রুম থেকে। তুই আমার সাথে কথা বলিস না এটাই ভালো হবে।’
নিমি মুখ ভেঙচি দিলো। সে আরও বেশি বেশি করে কথা বলবে রুয়াতের সাথে। রুয়াতের সাথে কথা না বললে ভাত হজম হবে না। দরকার নেই বরং কথা বলেই ভাত হজম করবে। তবে রুয়াতের এমন কথা শুনে মুখটা ভেঙচি না দিয়ে পারলো না। কিছু একটা মনে করতেই লাফিয়ে গিয়ে বসে রুয়াতের পাশে। হাত চেপে ধরে বলে-
-‘ওহ্হো একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি আয়াজ ভাই না আমায় তখন সে মধুমিশ্রিত স্বরে বলেছেন ‘কেঁদো না’। তুই কি ভাবছিস আমি মিথ্যে বলেছি? একটুও মিথ্যে বলিনি। সত্যি ওনি আমায় এটা বলেছেন। আমি তো হতবাক। ভাই রে কে এটা বলেছে।’
রুয়াত করূণ দৃষ্টিতে তাকায় নিমির দিকে। কথাটি বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট সাধ্যকর। কারণ আয়াজ এটা বলবে মানতেই পারছে না। আবার মনে পড়লো আয়াজ তাকেও একদিন সরি বলেছে। সেটার কাছে এ কথাটি তেমন কিছুই না। তবে এমন ব্যবহার সত্যি আশ্চর্যজনক।
-‘আমি বুঝিনা প্রথমে অপমান করে এরপর আবার সরিও বলে। যাই হোক বাদ দে তুই আর তোর সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে আমায় টানবি না। এই শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। যদি ও তুই আমার কাছে ক্ষমা চাসনি। বিশেষ করে আয়াজ ভাইয়ার বিষয়ে। কথাগুলো মনে রাখবি।’
নিমি হেসে মাথা দুলায়। রুয়াত কে অবশ্যই আবারও তার এসব কাজে নিয়ে যাবে। মুলত রুয়াত ছাড়া সে অচল। মিটমিট করে হাসছে নিমি। গালে হাত রেখে রুয়াত অন্যমনষ্ক হয়ে তাকিয়ে আছে।
(*)
সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে মিলাদের। শহরের তিনটা এতিমখানা তে বাচ্চারা আসবে। এইটুকুই শুধু। মায়া চৌধুরী আর জেবা ঘরের দিকটা সামলাচ্ছেন। মেহরুবা কে ডাকা হয়নি। বাহিরের দিকটা ফজলুল চৌধুরী, মাহের চৌধুরী, আয়াজ মিলে সবটা সামলে নিয়েছে। মেহরুবা আজ নিজের রুম থেকে বের হয়নি। রুয়াত কে সকালে নিমি খাইয়ে দিয়েছিলো। খেতে চায়নি। সেই শেষ রাতে ঘুম ভেঙেচে আর ঘুম আসেনি তার। তীব্র মাথার যন্ত্রণায় সবকিছু বিরক্ত লাগছে। তারউপর তার বাবার জন্য সে যে কতক্ষণ ধরে কাঁদা শুরু করেছে। শেষ করার আর নাম গন্ধ নেই। রূহান তার মায়ের কাছে না গিয়ে বোনের কাছে রয়েছে। নিমির কোলে শুয়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে রুয়াত। হঠাৎ জেবার ডাক পরে বাহিরে। নিমি দ্রুত পায়ে বের হয় রুম থেকে।
-‘মা ডেকেছিলে?’
জেবা ঘাড় ঘুরিয়ে নিমি কে দেখে একবার। শরবত বানাচ্ছেন ঠান্ডা পানি দিয়ে।
-‘হ্যাঁ। রুয়াত কি করছে এখন?’
-‘ও কাঁদছে। আমি কতবার মানা করেছি কাঁদতে না তাও শোনেনি।’
জেবা নিমির হাতে শরবত গুলো দেয়।
-‘আচ্ছা। তুই ওর সাথে থাকিস। আর এগুলো তোর বাবা কে, বড় বাবা কে, আর আয়াজ কে দিয়ে আয়। যে গরম পড়েছে। এই গরমের মধ্যেও তারা বাহিরে।’
মাথা নাড়িয়ে নিমি বের হয়ে আসে। মাঝপথে আরহামের সাথে ধাক্কা খায়। এই আবুল কে একটু পছন্দ না নিমির। রাগে কটমট করে আরহামের দিকে তাকায়।
-‘ভাইয়া তুই কি চোখে দেখতে পাসনি? তোর এই মোটা শরীরের সাথে লেগে যে শরবতগুলো একটু একটু পরে গেলো। এখন কি হবে? মা বকবে না এখন আমাকে? আবার এখনো দাঁড়িয়ে আছিস সামনে। সর এখান থেকে।’
-‘বড় ভাইকে সম্মান করতে জানিস না তো। তাই তোর থেকে এসব আশাও করি না। তুই কি চোখ হাতে নিয়ে হেঁটেছিলি?’
-‘উফ সর তো। আমার কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। পরে ঝগড়া করবো। এখন মুড নেই।’
আরহাম মুখ বাঁকালো।
-‘তোর সাথে ও আমার ঝগড়ার করার মুড নেই।’
নিমি কথাটি শুনলো না। সোজা বাহিরে চলে গেলো। একের পর এক ফজলুল চৌধুরী কে আর মাহের চৌধুরী কে শরবত দিয়ে আসলো। চারপাশ ঘুরেও খুঁজে পেলো না আয়াজ কে। হঠাৎ নজর যায় বাগানের শেষ প্রান্তে আয়াজ দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছে। নিমি দ্রুত পায়ে সেখানটায় চলে গেলো। আয়াজের সামনে দাঁড়াতেই কান থেকে মোবাইল নামিয়ে ফেললো।
-‘কি?’
নিমি আয়াজ কে শরবত দিলো।
-‘মা বানিয়েছে। বলেছে দিতে আপনাদের।’
-‘খাবো না আমি। নিয়ে যাও।’
-‘না ভাইয়া নিন। মা পরে আমাকে বলবে আমি ইচ্ছে করে আপনাকে দিই নাই।’
আয়াজ একটু খেয়ে আবার নিমির হাতে দিয়ে দিলো। এতো রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখমুখ লাল হয়ে আছে আয়াজের। ভ্রু কুচকানো। কপালের আশেপাশে ঘাম ঝরছে।
-‘তোমার সাথের জন কোঁথায়?’
-‘ও রুমে।’
-‘খেয়েছে কিছু?’
-‘খেতে চায়নি। পরে আমি জোর করে খাইয়ে দিয়েছি।’
-‘কাঁদছে?’
-‘জ্বী ভাইয়া।’
অধর কামড়ে ধরে আয়াজ কিছু একটা ভাবলো।
-‘রুমে আপাতত কেউ আছে?’
নিমি মাথা উঁচু করে আয়াজের দিকে তাকালো।
-‘রূহান আছে। আসার সময় দেখেছি।’
হাঁটা শুরু করলো আয়াজ। নিমির উদ্দেশ্যে বললো,
-‘চলো আমি যাবো।’
রুমের মধ্যিখানে হাঁটু গুঁজে সেথায় মাথা দিয়ে চুপচাপ বসে আছে রুয়াত। রূহান ওয়াশরুমে গিয়েছে। আয়াজ রুমে আসে। রুয়াত কে এভাবে দেখে বুকটা ধুকধুক করে ওঠে। হাস্যজ্জ্বল মেয়েটি কিভাবে মন খারাপ করে বসে আছে। কঠিক শক্তপোক্ত স্বরে বলে-
-‘কি হয়েছে? এভাবে বসে আছো কেনো? উঠো বাহিরে আসবে।’
রুয়াত আয়াজের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। এমন মানুষের দিকে তাকানোর ইচ্ছে নেই। যে কিনা কথায় কথায় অপমান করে। আয়াজের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মোটেও ইচ্ছে নেই। নিমি তাড়াতাড়ি শরবতের গ্লাস রেখে চলে এসেছে উপরে। নিরব দর্শকের মতো শুধু চেয়ে আছে।
-‘কথা বলেছি শুনোনি? নাকি আমার কথাটা কে গুরুত্ব দিচ্ছো না। কোনটা?’
চোখ বন্ধ করে রুয়াত বলে-
-‘আমি বাহিরে যাবো না।’
মেজাজ খারাপ হয় আয়াজের। এতো অবাধ্য রুয়াত কে কখনো দেখেনি। হাঁটু গেড়ে আয়াজ রুয়াতের সামনে বসে। নিমির চোখ বড় বড় হয়ে এসেছে। একবার মাথা নিচু করে আয়াজ বড়সড় নিঃশ্বাস টানে। রুয়াত থতমত খেয়ে যায়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে দূরে সরে যায়।
-‘শুনো যিনি চলে গিয়েছেন তার জন্য হাজার কষ্ট তিনি পেলেও ফিরে আসবে না। তার থেকে ব্যাটার তুমি দোয়া করো। এখন উঠো। বাহিরে চলো।’
রুয়াত হালকা উচ্চস্বরে বলে-
-‘আপনারা তো শুধু স্বান্তনাই দিতে পারবেন। কষ্ট অনুভব করতে পারেন? আসলে যার শরীর তার ব্যাথা। তেমনটি আমার বাবা নেই আর যার বাবা নেই সেই একমাত্র বুঝে। দয়া করে আপনি এখন রুম থেকে চলে যান।’
আয়াজ চুপ হয়ে যায়। উঠে দাঁড়ায়। মায়া চৌধুরী কে নিয়ে আসে। নিমি দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এই এক নতুন রূপ দেখছে আয়াজের। মায়া চৌধুরী রুয়াত কে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে আসে আয়াজের। এভাবে প্রেয়সী কে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না। মনে মনে বলে-
-‘নারী সত্যিই ভয়ংকর। যেখানে হেসেই একটা পুরুষ মানুষের হৃদয় শান্ত করে দিতে পারে। আবার কেঁদেও সেই পুরুষের হৃদয়ে উত্তাল ঢেউয়ের সৃষ্টি করে দিতে পারে। প্রেয়সীর কান্না সহ্য করা যাচ্ছে না। বুকের বাঁ পাশটায় ভীষণ ভাবে জ্বলছে। এই হৃদয়কে কয়লার মতো পোড়াচ্ছে।’
#চলবে….
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]