#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৩+১৪ |
আজ শনিবার। প্রোগ্রামের দিন। অন্যান্য দিনেই মতোই আজও গরমের উত্তাপ বেশি। সূর্য পশ্চিমে হেলে পরেছে ঘন্টাখানেক হলো। রথি মাগরিবের নামাজ শেষ করে রেডি হতে লাগলো। লং নীল জামা, কানে ঝুমকা, হাতে নীল চুড়ি। সিল্কি চুলগুলো পিঠে ছেড়ে দিয়েছে। রথির আবার বড় চুলের সখ নেই তাই তার চুলগুলো কোমড় অবধিই সীমাবদ্ধ। সাজগোজ বলতে কিছুই করলো না। শুধু মাশকারা আর গালে হালকা করে লাল আভা ফুটালো, আইশেড দিয়ে। এই ব্লাশিংটা রথির বেশ পছন্দ। তার উজ্জ্বল ফর্সা গাল দুটোতে একটু বেশিই স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। এবার লাস্ট ঠোঁটে মেরিল দিয়ে ওড়নাটি গায়ে জড়িয়ে নেয়। একদম পারফেক্ট লাগছে রথিকে। রথি মোবাইলের টাইম দেখে বুঝলো বড্ড দেরী করে ফেলেছে সে। জলদি ব্যাগে ফোন ঢুকিয়ে মাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পরে।
আবির তখনই সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসছিলো কিন্তু রথির এমন ছুটে যাওয়া দেখে কৌতুহলবশত সেও রথির পিছু নেয়৷ নিচে গিয়ে দেখলো এক গাড়ি ওদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আর সেটা থেকেই শাড়ি পরিহিত নাফিসা বেরিয়ে আসছে। নাফিসাকে দেখে আবির পূর্বের ন্যায় আবারও হিতাহিত জ্ঞান হারানোর অবস্থা। সে রথিকে পিছু ডাকলো। রথি থেমে ভ্রু কুচকে পিছে ফিরলো। আবির লম্বা লম্বা পা ফেলে অস্ফুট সুরে বলে,
-‘কোথায় যাচ্ছেন?’
-‘ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে সেখানে!’
বলেই রথি এগোতে শুরু করলো। আবির কী যেন একটা ভেবে সেও রথির পিছে ছুটতে ছুটতে জোরে বলে উঠে,
-‘দাঁড়ান আমিও যাবো।’
নাশিদ ড্রাইভিং সিটে বিসে অপেক্ষা করছে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য। স্টেয়ারিং এ আঙুল চালাতে চালাতে ঘাড় বাঁকিয়ে গেটের দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি থমকে গেলো। ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলোতে এই কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে একটু বেশিই অপরূপ লাগছে। চিকন গোলাপী ঠোঁটের হাসিটা যেন আরও স্নিগ্ধ! নাশিদ কাঁচের ভেতর দিয়ে হা করে রথিকে দেখছে। নীলে বুঝি কাউকে এতটা সুন্দর লাগে? জানা নেই নাশিদের।
যেই ছেলে কখনো কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকায়নি পর্যন্ত সেই ছেলের মাথায় একটি মেয়েকে দেখার জন্য এতটা জঘন্য বেহায়াপনা জম্মেছে কে জানতো? নাশিদের যখনই এই বিষয়টি মাথায় আসলো সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। কোণা চোখে আরেকবার তাকাতেই পেছনে আবিরকে দেখলো যার ফলে সে আবারও রেগে গেলো।
-‘ইউ আর লুকিং সো প্রিটি, নাফিসা!’
রথির সঙ্গে নাফিসা কথা বলছিলো। হুট করে আবিরের কন্ঠস্বর শুনে নাফিসা কিছুটা চমকে আবিরের দিকে তাকালো। অতঃপর নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করে বললো,
-‘ধ.. ধন্যবাদ।’
নাশিদ এবার তাড়া দিয়ে বললো,’আর কতক্ষণ লাগবে নাফিসা? দেরী হচ্ছে তো?’
রথি থতমত খেয়ে ড্রাইভিং সিটে তাকালো। এ যে পুলিশম্যান! ব্যাপার কী, ইদানীং থানায় না গিয়ে বোনেএ পিছে ঘুরছে? রথি ফিসফিস করে নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তোর ভাইও যাবে নাকি?’
-‘হ্যাঁ! মা আমায় একা ছাড়ার মানুষ নয়!’
রথি মুখ বাঁকালো। এবার নাফিসা আড়চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই বান্দা এখানে কেন? যাচ্ছে না কেন চোখের সামনে থেকে?’
-‘আমাদের সঙ্গে যাবে! তুই এক কাজ কর, তুই গাড়ি করে যা আমি আবিরের সাথে ভার্সিটি যাচ্ছি!’
রথির মুখে ‘আবির’ নামটা শুনে নাশিদ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। নাশিদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-‘নাফিসা! ওকে বলে দে, কষ্ট করে এসেছি তার এসব ফুটন্ত বাণী শোনার জন্যে নয়। আসলে আসতে বল নয়তো বাসায় গিয়ে ঘুমাতে বল!’
রথি চোখ গরম করে তাকালেও সে এবার ইচ্ছে করেই পেছনের সিটের দিকে যেতে লাগলো। নাফিসা রথির উদ্দেশ্যে বললো,
-‘আরে সামনের সিটে…!’
রথি থামিয়ে দিলো এবং হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলতে নিতেই নাশিদ গাড়ি থেকে নেমে পেছন সিটের দরজা লাগিয়ে দেয়। রথি নাশিদের দিকে না তাকিয়ে আবারও খুলতে গেলে সে ব্যর্থ হয়। রথি নাশিদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বললো,
-‘সমস্যা কী আপনার?’
-‘সামনে বসো!’
-‘নাফিসাকে বলুন না, আমার পিছে কেন পরেছেন?’
এবার আবির যেন নড়েচড়ে দাঁড়ায় এবং রথির উদ্দেশ্যে বললো, ‘ভাইয়া যেহেতু এতো করে বলছেন, সামনে বসে পরুন। দেরী হচ্ছে তো!’
রথি যখন বুঝলো আর কোনো উপায় নেই সে নাশিদকে চোখ রাঙানি দিয়ে ধপ ধপ পা ফেলে সামনের দরজা খুলে চলে গেলো। রথির চোখের কোণ ভিঁজে আছে। নাশিদ উঠে বসার আগেই রথি চোখের পানি মুছে ফেললো। নাশিদের এই ব্যবহারটা রথি কেন যেন মানতে পারছে না। তার ওই শান্ত-শিষ্ট নাশিদকে প্রয়োজন।
এদিকে নাফিসা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসলো, সাথে আবিরও। আবির তো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। আবির উঠে বসতেই নাশিদ ড্রাইভিং সিটে বসে একপলক রথির দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। রথি যে রাগ করে আছে বেশ ভালো করেই বুঝলো। হুহ, এতোই যেহেতু রাগ তাহলে ওই ছেলেকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি কিসের? ভাবতে ভাবতেই ড্রাইভিং এ মন দিলো। রথি আড়চোখে একবার পাশের মানুষটিকে দেখে নিলো।
নাশিদকে পাঞ্জাবিতে সবে খেয়াল করলো সে। কালো পাঞ্জাবিতে বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে। কিন্তু লোকটার রাগ যেন দিনদিন বেড়েই চলেছে। না জানি কোন অপরাধীর রাগ রথির উপর দিয়ে ফলাচ্ছে। লোকে হয়তো ঠিকই বলে, সুন্দর মানুষের রাগ আজীবন নাকের ডগায় থাকে। যখন তখন মাথা চড়ে বসে। বিরক্তিকর রোগ!
রথি গোল গোল চোখে যে নাশিদকেই দেখছে তা নাশিদ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তবে এখন কিছু বললো না সে, সঠিক সময়ের অপেক্ষায় রইলো।
পিছে আরেক কাপলের দিকে ওদের খেয়াল নেই। আবির মুগ্ধ নয়নে নাফিসাকে দেখতে ব্যস্ত আর নাফিসা বাইরের শহরটা দেখতে ব্যস্ত। নাফিসার বড্ড অস্বস্তি লাগছে এই আবির নামক ছেলেটিকে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছে না। তবে সে এতটুকু বুঝতে পেরেছে আবির আর যাই হোক রথিকে পছন্দ করে না। দ্যাট মিন তার ভাইয়ের কাঁধ থেকে এক বোঝা নামলেও সেই বোঝাটা ডিরেক্ট তার ঘাড়ে আক্রমণ করেছে। নাফিসা তপ্তশ্বাস ফেললো।
আধঘন্টার মধ্যে ওরা প্রোগ্রামে এসে পৌঁছালো। বেশ হৈ-হুল্লোড় হচ্ছে যা বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছে। গেটে ওদের নামিয়ে নাশিদ গাড়ি নিয়ে পার্কিংলটে চলে গেলো। তিনজন একসাথে প্রবেশ করলেও দারুণ ভীড়ে ২জন একদিকে আর রথি আরেকদিকে চলে গেলো। রথি পাশে তাকিয়ে দেখে নাফিসা আর আবির নেই। সে এক্সকিউজ মি বলে বলে এদিক সেদিক যেতে নিতেই হাতে কারো ঠান্ডা স্পর্শ টের পেলো যার ফলে রথি খানিক কেঁপে উঠলো। কম্পিত ঠোঁটজোড়া ভিঁজিয়ে পিছে ফিরতেই দেখলো নাশিদ তার হাত ধরে তারই পানে তাকিয়ে রয়। রথি চোখ নামিয়ে ফেলে। নাশিদের এই দৃষ্টি তাকে মুহূর্তের মাঝে ছাড়খাড় করে দিতে সক্ষম। রথির ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে নাশিদ বললো,
-‘ভালো স্থানে না গিয়ে এই ভীড়ে কী করছো? আমার সাথে এসো!’
বলেই হাত ধরে ভীড় থেকে বের করে নিয়ে আসলো আমায়। ভীড় থেকে বের হতেই রথি আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। রথির কান্ডে নাশিদ রথির দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বললো,
-‘খারাপ উদ্দেশ্য নেই আমার। জাস্ট ভীড়ের মাঝে যেন হারিয়ে না যাও সেজন্য ধরেছি!’
-‘বুঝেছি।’
বলেই অদূরের স্টেজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভার্সিটির এক প্রফেসর হোস্টিং করে এক স্টুডেন্টকে গান গাওয়ার উদ্দেশ্যে স্টেজে যেতে বলছে। নাশিদ কোথা থেকে চেয়ার জোগার করে আনলো। আমাকে একটি চেয়ার দিয়ে বললো,
-‘বসে উপভোগ করো!’ বলতে বলতেই নিজের চেয়ারে বসে পরলো। রথি বলে উঠলো,
-‘বসলে দেখতে পাবো না।’
নাশিদ রথির হাত ধরে বসিয়ে বামপাশে ইশারা করলো। সেখানে বড় একটি পর্দায় স্টেজ সরাসরি দেখা যাচ্ছে। যাক, স্যারদের সুবুদ্ধি হয়েছে। আমি আয়েশ করে বসে ওই পর্দাতেই তাকিয়ে রইলাম। তবে সেখানে তেমন একটা মনোযোগ যাচ্ছে না। তার মনোযোগ যে পাশের মানুষটির উপর। বিশ্বাস হচ্ছে না তারা পাশাপাশি বসে আছে। গাড়িতে সামান্য দূরত্ব থাকলেও এখানে নেই। দুটো চেয়ারই পাশাপাশি।
-‘আই নো আমি সুন্দর! এভাবে চোখ গিয়ে গিলে খাচ্ছো কেন? লুক এট দ্য স্ক্রিন!’
রথি চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জায় ইচ্ছে করছে মাটির সাথে মিশে যেতে। এমন একটা সময়ে নাশিদ এভাবে এরকম লজ্জাজনক একটা কথা বলবে রথি ভাবতেও পারেনি। তবে রথি এটা বেশ বুঝেছে, নাশিদ গম্ভীর হলেও হুটহাট লাগামছাড়া কথা বলে ফেলে। এই নাশিদের বহুরূপী রূপ মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো।
রথি সেই ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে প্রোগ্রাম দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। হুট করে তার নাফিসার কথা মনে পরলো। নাফিসা আর আবির কোথায় হারিয়ে গেলো?
রথি উপায় না পেয়ে নাশিদকে বললো,
-‘নাফিসা আর আবির কোথায়? ভীড়ের মাঝে যে হারিয়ে গেলো খবর নেই!’
নাশিদ এক পায়ে আরেক পা উঠিয়ে চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে এক হাতে ফোন দেখছিলো। রথির প্রশ্নে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই বললো,
-‘আছে আশেপাশে। চিন্তা করিও না!’
রথি এবার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে নাশিদের দিকে তাকালো। আশেপাশে চোখ দিতেই দেখলো অনেক মেয়েরা নাশিদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাচ্ছে। এই চাহনির ভাষা রথির অজানা নয়। সে মুখ বাঁকিয়ে পর্দায় মন দিলো। আধঘন্টা বাদেই নাফিসা নাশিদকে কল করলো স্টেজের দিকে যাওয়ার জন্য। নাশিদ আবারও রথির হাত ধরে সাইডের উঁচু নিচু ইট-পাথরের পথ দিয়ে যেতে লাগলো। এই পথে মানুষজন কম। রথির কেমন অস্বস্তি লাগছে নাশিদের হাতের স্পর্শটা। তাই সে নাশিদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়েই হাঁটতে লাগে। কিন্তু এখানেই ঘটে যায় বিপত্তি। রথি পা মচকে পথে পরে গেলো। রথির আর্তনাদ শুনে নাশিদ চটজলদি পিছে ফিরে দেখলো রথি পায়ে হাত দিয়ে বসে আছে। নাশিদ একপ্রকার ছুটে রথির কাছে আসলো। রথির পায়ে হাত দিতেই রথি আবারও চিৎকার করে উঠলো।
-‘ঘটলো তো অঘটন? হাত ছেড়ে এতো টইটই করো কেন তুমি? তোমার হাত কী আমি খেয়ে ফেলবো?’
ধমকের সুরে বললো নাশিদ। ব্যথার মাঝে রথি ঠোঁট উল্টে বসে আছে সে। কই এডভাইস দিবে তা না ধমকাচ্ছে। হিটলার একটা। রথিকে চুপ করে থাকতে দেখে নাশিদ এবার থমথমে গলায় বললো,
-‘পায়ে কীরূপ ব্যথা পাইসো সেটা আগে বলো?’
-‘মচকে গেছে!’
-‘ওহ গড!’ বলেই নাশিদ উঠে দাঁড়ালো। এক হাত কোমড়ে, আরেক হাত তার কপালে। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট! রথি আগের মতোই গোমড়ামুখো হয়ে বসে আছে। নাশিদ মাথা নিচু করে রথির দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘উঠছো না কেন? সারারাত দিন কী এভাবেই বসে থাকবা?’
-‘উঠতেই তো পারছি না আমি।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো। নাশিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নাফিসাকে কল করে ওদের লোকেশন জানালো।
কিছুক্ষণ বাদে ওরা আসতেই রথির পা মচকানো সম্পর্কে নাশিদ সবটা খুলে বললো। নাফিসা মুখে হাত দিয়ে বলে,
-‘এখন বাসায় যাবি কী করে? এদিকে তো রাতও হয়ে যাচ্ছে!’
রথি নিশ্চুপ হয়ে মাথা নত করে বসে রইলো। যখনই কোনকিছু নিয়ে উত্তেজনা থাকে তখনই কিছু না কিছু বিপত্তি ঘটে। কেন তার সাথেই এমন হয়? হুট করে রথির ভাবনার মাঝেই নাশিদ রথিকে কোলে তুলে নিলো। রথি আচমকা ঘাবড়ে নাশিদের পাঞ্জাবির কলার খামচে ধরলো। চোখ যেন তার বেরিয়ে আসার উপক্রম। নাফিসা এবং আবিরও অবাকের শেষ পর্যায়। আশেপাশের অনেকেই হা করে এদিকেই তাকিয়ে আছে। রথি যেন স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রথি বললো,
-‘ক..কী করছেন? আশেপাশে মা…’
-‘তো কী এখানে বসিয়ে রাখবো? কোনো ওয়ে নেই, বাসায় যেতে হবে!’
বলেই নাশিদ রথিকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। তার দৃষ্টি শান্ত। রথি তখনো হা করে নাশিদকে দেখছে৷ আনএক্সেপ্টেড কিছু ঘটলে সেই ঘোর যে এতো সহজে কাটে না।
রথিকে গাড়িতে বসিয়ে নাশিদ নিজেই সিটবেল্ট বেঁধে দেয় এবং থমথমে গলায় বললো,
-‘সিটবেল্টটা তোমার গলায় লাগায় না যে তোমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এসব রং ঢং বাদ দেও।’
বলেই দরজা লাগিয়ে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। তখনো রথির ঘোর কাটেনি। নাশিদ উঠে বসতে বসতে নাফিসা এবং আবিরও উঠে বসলো। রথির বাসায় সামনে আসতেই ওরা নেমে যায়। ওরা নামতেই নাশিদ রথির পা টেনে নিজের হাঁটুর উপর রাখলো। রথি অস্ফুট সুরে বললো,
-‘কী করছেন কী?’
রথির কথায় নাশিদ কোনরকম পতিক্রিয়া না করে রথি পা উল্টো করে মচকে দেয়। রথি আবারও চিৎকার করে উঠে ব্যথায়। নাশিদ পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘এবার ঠিক আছে। এখন আমার কোলে করে দিয়ে আসা লাগবে না!’
রথি চোখ গরম করে বললো, ‘আমি বুঝি বসে আছি আপনার কোলে ওঠার জন্য? যত্তোসব। নাফিসা, আমায় হেল্প কর বাসায় দিয়ে আসতে!’
রথির কথামতোন নাফিসা ওকে ধরে বের করলো। রথি নাফিসার কাঁধে এক হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে চলতে লাগলো। রথিকে নাফিসা বাসা অবধি পৌঁছে দিতেই মার্জান জানালার পর্দার আড়াল থেকে নিচে দাঁড়ানো নাশিদকে আবছা দেখে নিলো। এটা কী রথির ঘনিষ্ঠ কেউ নাকি ওর বান্ধুবির কেউ? এই প্রশ্নটিই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।
হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৪ |
আবির’রা চলে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। ওরা চলে যেতেই মার্জান এবং রথির মধ্যে ভয়ানক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ভয়ানক বলতে মাত্রাতিরিক্ত ভয়াবহ। তাতানকেও হোস্টেল পাঠানো হয়েছে। এই দ্বন্দ্বের কারণ বাড়িতে থাকা নিয়ে। রথির মা রথিকে অনেক বুঝিয়েছে সে ওখানে চলে যাবে কিন্তু রথি অমত জানায়। সে বারংবার তার মাকে এটাই বলে,
-‘কেন মা? এই বাড়ি তোমার, আমি জানি! এই ভাবী জাস্ট নকল কাগজ দেখাচ্ছে তোমাকে। বিশ্বাস না হলে আমি এটা খুব শীঘ্রই প্রমাণ করবো!’
বলেই রথি হনহন করে বেরিয়ে যায়। এদিকে রথির মা এসব সহ্য করতে পারেন না, তার রক্তচাপ বেড়ে যায়। সাইফ তখনই বাড়ি ফিরে৷ মাকে পরে যেতে দেখে সাইফ দ্রুত এগিয়ে যায় মায়ের দিকে। মার্জান রথির মাকে ধরতে গেলে সাইফ চোখ গরম করে থামিয়ে দেয়। থমথমে গলায় বলে,
-‘খবরদার তুমি আমার মাকে ছুঁবে না! আজ যদি আমার মায়ের কিছু হয়, তোমার বাপ-চাচা, তাতান কিছুই মানবো না!’
বলেই আমেনার সাহায্যে মাকে ভেতরের রুমে নিয়ে গেলো। এদিকে মার্জান বারংবার ঘেমে একাকার হচ্ছে। নাহ জলদি কিছু একটা করতে হবে নয়তো সে সব খুইয়ে ফেলবে সব!
রাত নয়টা। বাইরে তীব্র বাতাস চারপাশে ধুলোময় করে ফেলেছে। মানুষের চোখ-মুখে ধুলো-বালি ঢিকে যা তা অবস্থা। এই অবস্থা দেখে নাশিদের বুঝতে বাকি রইলো না ঝড়-বৃষ্টি হবে। তাই সে তার হাতের ফাইলটি রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার দিকে যেতেই দেখলো বাইরে ঠিক তার জানালার পাশে রথি দাঁড়িয়ে। তার মাথা নিচু এবং হাতদুটোও মুঠ করে রেখেছে। রথিকে দেখে নাশিদ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। মৃদু সুরে রথিকে ডাকলো। কিন্তু রথি ভাবলেশহীন, এক চুলও নড়লো না। নাশিদ আবারও ডাকলো। আবারও। কিন্তু রথির কানে ডাকটি প্রবেশ করলো না। নাশিদ উপায় না পেয়ে থানা থেকে বেরিয়ে রথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘কী হলো, এতবার ডাকছি শুনতে পাও না!’
রথি এবার খানিক নাক টানলো। সেই শব্দে নাশিদের বুঝতে বাকি রইলো না রথি কাঁদছে। নাশিদ খানিকটা বিচলিত হয়ে পরলো। এদিকে ঝড় আসবে আসবে ভাব হলেও এখন পরিবেশ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
নাশিদ কিছু বলতে নিবে তার আগেই রথি দু পা এগিয়ে নাশিদের ডান বাহুতে আলতো মাথা ঠেকিয়ে
ভাঙ্গা গলায় বললো,
-‘একান্ত সময় চাই!’
রথির এরূপ আবদার নাশিদকে বিষম খাওয়ালো। তবে নাশিদ রথির আবদার ফেলতে পারলো না। নাশিদ রথির উদ্দেশ্যে বলে,
-‘এখানে থাকবে নাকি অন্য কোথাও যেতে চাও!’
-‘** হোস্টেল যেতে চাই। আমার তাতানের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন নাশিদ সাহেব?’
নাশিদ এ মুহূর্তে বুঝলো না এই তাতান কে? তবে রথি যেই হোস্টেলের কথা বললো ওটার ৮০% ই বাচ্চারা। এর মানে কী কোনো বাচ্চা? তবে নাশিদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো না। সে রথির উদ্দেশ্যে বললো,
-‘ঠিক আছে, তুমি অপেক্ষা করো। আমি আসছি!’
বলেই নাশিদ রথিকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এতক্ষণে রথিও চোখ মুখে ফেললো। নাশিদ আসতেই রথিকে গাড়িতে উঠতে বললে রথি নাশিদকে থামিয়ে বলে,
-‘আমি রিক্সা করে যাবো৷ এই গাড়ি টাড়িতে বিরক্ত হয়ে গেছি।’
এবারও নাশিদ রথির কথার অমত করলো না। কেন যেন রথির এই আবদার গুলো সে ফেলতে পারছে না। এর কারণ কী? কারণটার উত্তর নাশিদের জানা নেই। নাশিদ কথা না বাড়িয়ে রথির সঙ্গে যেতে লাগলো কিন্তু আফসোস কোনো রিকশা নেই। নাশিদের মাথায় এই ঢুকছে না রথি কেন রাত করে বাসা থেকে বেরিয়ে তারই থানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো? নাশিদ রথিকে প্রশ্ন করবে তখনই রথি বললো,
-‘নাশিদ সাহেব, ওইযে রিকশা!’
নাশিদ আর প্রশ্ন করতে পারলো না। রিকশা ডেকে দুজনেই উঠে বসলো। নাশিদ আজ ইউনিফর্ম পরেনি, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।
রথি এবং নাশিদ পাশাপাশি একই রিকশায় বসা। এই অনুভূতি যেন প্রকাশ করার মতো নয়। রথি মনোযোগ দিয়ে এই মুহূর্তটি উপভোগ করছে আর নাশিদ নিজেকে বিভিন্ন প্রশ্নে গুলিয়ে ফেলছে। এই মানুষটা তার পাশে থাকলে রথি যেন চোখ বুজে সব ধরণের বিপদ অতিক্রম করতে পারে। হ্যাঁ এতোটাই জায়গা করে নিয়েছে সে রথির মনগহ্বরে। রিকশায় তাদের নিরবতাই চললো, কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহসটা জোগাতে পারলো না।
নাশিদ ভাড়া মেটাতে গেলে রথি তাকে থামালো। অতঃপর থমথমে গলায় বললো,
-‘ভাড়া দুজন মিলিয়ে ঝিলিয়ে দেয়াটাই ঠিক মনে করি!’
নাশিদ এবার রথির কথায় পাত্তা দিলো না। একপ্রকার জোর করে নিজেই ভাড়া দিলো যার কারণে খানিক মন খারাপ হলো। অতঃপর নাশিদ দারোয়ানকে বলে ভেতরে ঢুকলো। রিসিপশনে গিয়ে মেয়েটাকে তাতানের নাম, ক্লাস বলতেই মেয়েটি তাতানকে এখানে আনার ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে তাতান আসলো। নাশিদ রিসিপশনের মেয়েটিকে বলে তাতানকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে আসলো।
রথি তো তাতানকে নিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তার সবকিছু এখন মরিচিকার মতো লাগছে। ভেতরটায় কেমন তুফান হচ্ছে। নাশিদ স্থির দৃষ্টিতে রথির কান্না দেখছে। তার সহ্য হচ্ছে না রথির চোখের জল, তাই সে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ালো।
—————————–
-‘আপনার ননদ তো ভালোই বড়লোকী পোলার লগে ঘুরে বেড়ায়! আমি যখন বললাম আমার হাতে ওরে তুলে দিতে তখন কেন দিলেন না?’
মার্জান খানিক আতকে উঠলো শামুনের জোড়ালো কন্ঠস্বরে। মার্জান কখনোই এই শামুনের হাতে রথিকে তুলে দেবে না। শামুন মারাত্মক খারাপ যা মার্জানের অজানা নয়। হয়তো মার্জান ওদের সহ্য করতে পারে না তাই বলে এই না যে সে রথির খারাপ চায়। মার্জান ভাবনা ছেড়ে থমথমে বলায় বললো,
-‘যা সম্ভব না, তা নিয়ে কথা বলতে আসবে না। নিষেধ করিনি?’
শামুন চোখ গরম করে মার্জানের দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করতে বলে,
-‘আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করছি এখন তবে! (কিছুটা থেমে) রথিকে না পেলে আমি সব তছনছ করে দিবো, এমনকি আপনাকেও!’
বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। এখন মার্জানের মাথায় হাত। সে কী করবে এখন? নাহ কোনো না কোনো সলিউশন তাকে বের করতেই হবে।
রথি কোচিং থেকে ফেরার সময় থানায় উঁকি দিতে দিতেই যাচ্ছিলো তখনই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খায়। রথি মাথা উঁচু করে সামনে তাকাতেই আঁতকে উঠলো কারণ তার সামনে নাশিদ ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে। নাশিদকে দেখে রথি একটি শুকনো ঢোঁক গিললো। এর মানে কী সে ধরা পরে গেলো? নাশিদ একইভাবে ভ্রু কুচকে বললো,
-‘যেভাবে আজ উঁকি দিতে দিতে যাচ্ছিলে, এই উঁকি দেয়া কী রোজ চলে?’
নাশিদের এরূপ কথায় রথি লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হতে শুরু করলো। এরকম কিছু হবে কে জানতো? কী লজ্জা, কী লজ্জা!
নাশিদ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রথির কান্ড দেখছে। রথি এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারলো না। সে নাশিদকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত দৌড়ে চলে গেলো। নাশিদের এই দৃষ্টি রথির সহ্য করার ক্ষমতা নেই, একদমই নেই। নাশিদ পিছে ঘুরে রথির ছুটে যাওয়া দেখছে৷ কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে আপনমনে হেসে উঠলো। থানার সামনে নাশিদকে একা একা হাসতে দেখে নয়ন ভ্রু কুচকালো। সে নাশিদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-‘কী ব্যাপার স্যার, এভাবে হাসছেন কেন?’
-‘কিছু না, মিশনে চলো৷ দেরী হচ্ছে!’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে থানায় ঢুকে একটা ব্যাগ এনে নাশিদের সঙ্গে তাদের মিশনে রওনা হলো। আজকের মিশনটা কিছু মহিলাকে কয়েকটি বেআইনি হোটেল থেকে উদ্ধার করা।
রথি ছুটে বাসায় আসতেই চমকে উঠে। মার্জান এবং তার মা হেসে হেসে কথা বলছে। রথিকে মার্জান দেখতেই মুচকি হেসে রথির মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তাহলে আমি রথিকে নিয়ে কালই গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। কী বলেন মা? বিকালে সাইফকে দিয়ে তাতানকেও নিয়ে আসবো, একবারের জন্য।’
মা যেন অনেকটা খুশি হলেন। আর রথি? সে তো মার্জানের কথার আগা-মুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজ লেখার মানসিকতা একদমই ছিলো না, তাও আপনাদের এতো এতো অনুরোধে বাধ্য হলাম। জানি না খাপছাড়া হয়েছে কি না তাও আপনাদের কাছে গঠনমূলক মন্তব্য চাইছি। আজ অনেকটা ঝামেলা নিয়ে লিখেছি তাই আশা করছি আমায় নিরাশ করবেন না। আসসালামু আলাইকুম।