হৃদপিন্ড_২ (পর্ব ১৪)

0
537

#হৃদপিন্ড_২
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পার্ট_১৪

ইমনের জ্বর যতটা কমেছিলো সায়রীর উপস্থিতি তে তাঁর থেকেও দ্বিগুণ বেড়ে গেলো যেনো। মুসকানের থেকে সরে গিয়ে পাশেই পুরো শরীর ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। মুসকান মুখটা কাচুমাচু করে ওঠে বসলো৷ ইমন বিরবির করে বললো,

—- আগে যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতাম তুই এতোটা নিচে নামবি তাহলে দিহানের সাথে তোর বিয়ে কেনো প্রেমের সম্পর্কও ঘটতে দিতাম না।

—- ঐ ঐ কি বললি? মনে হয় তোর দয়ায় আমি দিহানকে পেয়েছি? বলেই তেড়ে এলো সায়রী।

—- নিজের বাড়ি কি ভিটেতে কি পানি ওঠেছে? ওখানে মরার জায়গা পাসনি এখানে মরতে এসেছিস কেনো?

—- শয়তান ছেলে! সেধে এসেছিলাম বাঁচাতে গায়ে লাগলো না। আমার কি একটু পরেই বোনের খোঁজে ভাই হাজির হবেইনি। বলেই সায়রী বেরিয়ে যেতে নিলো।

মুসকান আপু বলেই বিছানা থেকে ওঠতে যাবে তখনি ইমন হাত টেনে ধরলো। মায়াভরা চোখ,মুখে চেয়ে বললো,

—- আরেকটু বোস না?

ইমনের অমন আবদারে কান্না চলে এলো মুসকানের। ইমন চোখ টেনে টেনে চেয়ে আছে। জ্বরে পুরো চোখ,মুখ লালচে হয়ে গেছে তাঁর। সায়রী ওদের অবস্থা দেখে কাছে এসে বললো,

—- ইমন আমি মুরাদকে ফোন করে বলেছি স্কুল আগে ছুটি হয়েছে তাই মুসুকে চলে এসেছি বাড়িতে আমিই পৌঁছে দেবো। এখন যদি লেট হয় প্রবলেম হয়ে যাবে।

—- নিয়ে যাবি ওকে? আহত গলায় প্রশ্ন করলো ইমন।

মুসকান প্রায় কেঁদেই দেবে৷ সায়রী বললো,

—- এছাড়া কোন অপশন নেই। মুরাদ আমাকে বিশ্বাস করে ওর সে বিশ্বাস আমি ভাঙতে পারবো না।

ইমন বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তাঁর। তবুও মুসকানের দিকে এগিয়ে সায়রীর সামনেই কপালে আলতো করে চুমু খেলো। মুখে মলিন হাসির রেখা টেনে গাল টিপে দিয়ে বললো,

—- একদম মন খারাপ করবিনা। খুব তারাতাড়ি দেখা হবে আমাদের৷ ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করবি,পড়াশোনা করবি যাহ বাড়ি যা৷
.
সেদিনের পর প্রায় দুমাস কেটে যায়। এ দুমাসে প্রায় দিনই টিফিন পিরিয়ডে ইমন মুসকানের সাথে দেখা করে যায়। মাঝে মাঝে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়েও অনেকটা সময় কাটায়। মুরাদ লক্ষ করলো শুরুর দিকে মুসকান কান্নাকাটি করতো। ঠিক ভাবে খাওয়া-দাওয়া করতো না। পড়াশোনা করতো না। কিন্তু এখন সেসবের কিছুই চোখে পড়ছে না৷ তাঁর মানে মুসকানের আবেগটা কেটে গেছে। সে ভুল নয়, মুসকানের অল্প বয়স তাই আবেগে পড়ে এসবে মনোযোগ দিয়েছিলো। ভাই হিসেবে সঠিক কাজটাই তাহলে সে করেছে। এবার ইমনের সাথে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে হবে। ইমনকে বোঝাতে হবে মুসকান ছোট আবেগ ছিলো ওর যা অল্প সময়েই কেটে গেছে। বন্ধু হিসেবে সে যেমন ইমনের ভালো চায় বোন হিসেবে মুসকানেরও ক্ষতি চায় না সে। দু বন্ধুর মধ্যে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে এটাকে দীর্ঘ করা যাবে না। ইমন তাঁর বেষ্ট ফ্রেন্ড কলিজার দোস্ত। ইমনের সাথে কালই দেখা করতে হবে ভেবেই এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মুরাদ৷

রাতের খাবারের পার্ট চুকিয়ে রুমে আসে রিমি। মুরাদ রিমিকে দেখে মৃদু হেসে বলে,

—- ইমনের জন্য একটা ভালো মেয়ে দেখতে হবে রিমি। যতো তারাতাড়ি সম্ভব বিয়ের বন্দবস্ত করবো ওর৷

—- তোমাদের মধ্যে সব ঝামেলা মিটে গেছে?

—- না তবে মিটিয়ে নেবো। মুসুতো ইমনকে ভুলেই গেছে এবার ইমনকেও বুঝতে হবে এটা জাষ্ট আবেগ ছিলো।

রিমি চমকে গেলো। মুসু ইমনকে ভুলে গেছে নাকি ওদের সম্পর্ক আগের থেকেও গভীর হয়েছে তা যদি মুরাদ জানতো তাহলে কি আর এ কথা বলতো? রিমিকে অন্যমনস্ক দেখে কাছে টেনে নিলো মুরাদ। কোমড় জরিয়ে বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে বললো,

—- কি ভাবছো?

—- সত্যি মুসু সব ভুলেছে তো?

—- কেনো ভুলেনি? তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে জিগ্যেস করলো মুরাদ।

রিমি ভয়ে এক ঢোক গিললো৷ আমতা আমতা করে বললো,

—- আমি তো জানিনা, না মানে মুসুতো ঠিক আছে স্বাভাবিক আছে।

মুরাদ তবুও তাঁর দৃষ্টি সরালো না। সন্দেহ চোখে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো রিমিকে। রিমি কথা ঘোরানোর মুরাদের থেকে সরে বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়লো। মুরাদের সন্দেহ আরো বেড়ে গেলো। প্রচন্ড শক্ত করে হাত চেপে ধরলো রিমির। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললো,

—- যদি বুঝতে পারি আমার থেকে কিছু লুকিয়েছিস খুন করে ফেলবো।

—- ভাইয়ের রূপে ফিরে এলে মন্দ লাগেনা বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠলো রিমি।

—- আর যখন স্বামীর রূপে থাকি তখন কেমন লাগে? বলেই গা থেকে ওড়না সড়িয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো।
__________________
বেলা এগারোটার দিকেই ইমন গাড়ি নিয়ে পৌঁছায় মুসকানের স্কুলের সামনে। সায়রী দ্রুত মুসকানকে গেট থেকে বের করে ইমনের গাড়িতে ওঠিয়ে দিয়ে আবার দ্রুত স্কুলের ভিতর চলে যায়।

আজ ইমনের জন্মদিন৷ তাই ক্লাস মিস দিয়েই মুসকানকে নিজের বাড়ি নিয়ে এলো ইমন। ইরাবতী আর কাজের মেয়ে পারুল মিলে বহুপদের রান্না বসিয়েছে৷ মুসকানকে নিয়ে ইমন বাড়ি আসতেই ইরাবতী ইমনকে বললো তাঁর রুমে বিছানার ওপর লাল রঙের শাড়ি বের করা আছে। মুসকানকে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে শাড়িটা পড়ে ফেলতে বল। পরোক্ষনেই ইরাবতী জ্বিব কেটে বললেন,

—- ওকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বল আমি গিয়ে শাড়ি পড়িয়ে দিব।

ইরাবতীর রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো মুসকান। বিছানায় শাড়ির সাথে ব্লাউজ পেটিকোটও রয়েছে। সেই কোন ছোট বেলায় মা,রমা আর রিমি আপু তাঁকে শাড়ি পড়িয়ে দিতো। বড়বেলা আর শাড়ি পড়া হয়নি তাঁর। বান্ধবী দের সাথে কথা হয়েছে এস এস সি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে বিদায় অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়বে সবাই মিলে। ভাবতেও পারেনি তাঁর শাড়ি পড়ার সময় এতো দ্রুত চলে আসবে। শাড়ি দেখে লজ্জা পেলো ভীষণ তখনি রুমে এলো ইমন। বললো,

—- কাহিনী কি এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেনো?

ইমনকে দেখে লজ্জাটা আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। মুখে কুলু পেতে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ইমন ব্লাউজ,পেটিকোট হাতে নিয়ে মুসকানের সামনে ধরলো। বললো এগুলো পড়ার আগেই লজ্জা পাচ্ছিস পড়ার পর কি করবি? নে ধর। মুসকানের হাতে কাপড়গুলো গুজে দিয়ে দরজার দিকে এগুতে লাগলো৷ হাঁটা পা থামিয়ে আড় চোখে চেয়ে ওর লজ্জা দেখে বললো,

—- এতো লজ্জা পেতে হবে না। এগুলো পড়ে ডাকবি আমায় আমি দরজার বাইরেই আছি।

ইমন চলে যেতেই মুসকান দুরুদুরু বুকে ব্লাউজপেটিকোট পড়ে নেয়। কিন্তু পিছনের ফিতা লাগাতে পারেনা। শাড়িটা গায়ে জরিয়ে দরজার দিকে ওকি দিতেই ইমন ভূবন ভুলানো এক হাসি দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে শাড়িটা ছিনিয়ে নেওয়ার মতো করে নিজের হাতে নেয়। মুসকান হাত দিয়ে টেনে ধরে বলে,

—- পুরোটা নিও না৷

—- আরে আজব পুরোটা না নিলে শাড়ি পড়াবো কি করে? ভয় নেই তোর ঐ কইঞ্চার মতো শরীরে নজর দেবো না আমি। নজর কাড়া ফিগার আছে নাকি তোর যে এতো ভয় পাচ্ছিস?

মুখটা গোমড়া করে ফেললো মুসকান৷ ইমন নিজের মতো করে শাড়ি পড়াতে শুরু করলো। পুরো শাড়ি পড়িয়ে আঁচল দিতে গিয়ে কি যেনো মনে করে পুরো শাড়িটা আবার খুলে ফেললো। মুসকান চমকে তাকালো ইমনের দিকে। আর ইমন তাঁকে এপাশ-ওপাশ করে ঘোরাতে শুরু করলো৷ কি যেনো খুঁজছে সে। মুসকান অস্থির হয়ে বললো,

—- কি হয়েছে?

—- তিল খুঁজছি।

—- কিসের তিল?

—- দু’টো পেয়েছি আরেকটা কোথায় সেটাই খুঁজছি। বলেই পিছন দিক ঘুরিয়ে পিঠ চেক দিলো। তারপর সামনে ঘুরিয়ে যেই চেক দিতে যাবে মুসকান আঁতকে ওঠে পিছিয়ে যায়। ইমন স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মুসকানের দিকে। তারপর নিজেই লজ্জিত হয়ে যায় ভীষণ। ইদানীং বড্ড বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে সে। মুসকানকে সামনে পেলে মাথা ঠিক থাকেনা তাঁর। হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে সরি বলে আবারো শাড়ি পড়িয়ে দেয়। আঁচল তুলে দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে স্থির হয়ে চেয়ে থাকে সে। কে বলে এই মেয়েটা বাচ্চা? এই তো কতো বড় বড় লাগছে। মুগ্ধ হয়ে অপলক ভাবে চেয়ে শান্ত গলায় বলে ওঠে ‘মুগ্ধময়ী’।

মুসকান লজ্জা পেয়ে চোখ সড়িয়ে নেয়। ইমন তাঁর কপালে শীতল স্পর্শ একে দিয়ে হাত চেপে ধরে ধীরে ধীরে নিয়ে যায় নিচে। সিঁড়ি বেয়ে নামছে মুসকান আর ইমন। ইমনের একহাতে মুসকানের হাত ধরা আরেক হাতে মুসকানের কাঁধ ধরা। নিচ থেকে ইরাবতী এ দৃশ্য দেখে বলেন,

—-‘মাশাল্লাহ খুব সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে’।

শেষ সিঁড়ি তে পা রাখার সাথে সাথে কানে ভেসে এলো,

—– মুসু???

ইমন মুসকান দুজনই চমকে তাকালো সামনের দিকে। মুরাদকে দেখে মুসকান ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। আর ইমন এক ঢোক গিলে খুব শক্ত করে চেপে ধরলো মুসকানের হাত। ছাড়লেই মুসকানকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে ভাবটা এমন।
.
আজ ইমনের জন্মদিন প্রিয় বন্ধুর জন্মদিন অথচ মুরাদ তাঁকে উইশ করবে না তা কখনো হয়? স্কুল থেকে টিফিন পিরিয়ডে বেরিয়েছে প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা করবে বলে। কিন্তু এসে এমন কিছুর সম্মুখীন হবে ভাবতেও পারেনি। রাগ যতোটা পড়ে গেছিলো তাঁর থেকেও হাজারগুন বেড়ে গেলো। তাঁর অগোচরে কলিজার বোন, কলিজার বন্ধু এতো বড় কাজ করছে? এভাবে বার বার ঠকাচ্ছে ইমন তাঁকে? বন্ধু দিচ্ছে না বন্ধুত্বের মূল্য, বোন দিচ্ছে না ভাইয়ের মূল্য। ফিকে হয়ে যাচ্ছে ভাইবোনের মধুর সম্পর্ক। ফিকে হয়ে যাচ্ছে এতো বছরের বন্ধুত্ব। আর কিছু ভাবতে পারছে না মুরাদ। দুহাত মুঠ করে বললো,

—- বাড়ি চল।

কথাটা শোনামাএই ইমন আরো শক্ত করে চেপে ধরলো মুসকানের হাত। ইরাবতী দ্রুত মুরাদের কাছে গিয়ে মুরাদের কাঁধে ধরে বললো,

—- বাবা মাথা গরম করো না। শান্ত হয়ে বসো সব বুঝিয়ে বলছি। আজ ইমনের জন্মদিন তাই,,,

—- বাড়ি চল মুসু।

মুসকান ইমনের থেকে হাত সরাতে নিতেই ইমন কঠিন চোখে তাকালো মুসকানের দিকে। মুসকান ভয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। ইমন বললো,

—- আজ না তুই যাবি না মুসু যাবে একটা বিহিত করেই আজ তোরা ভাই বোন বাড়ি যাবি।

—- আমার কসম মুসু তুই আমার সাথে বাড়ি চল। আজ আমি দেখতে চাই তোর কাছে কে বড় আমি না ইমন? বলেই ইরাবতীর হাত সড়িয়ে দিয়ে মুসকানের দিকে এগিয়ে যায় মুরাদ।

ইমনের হাত থেকে খুব জোর খাটিয়ে মুসকানের হাত সরাতে নেয়৷ কিন্তু পারে না৷ মুসকানের চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তেই থাকে। মুরাদ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় ইমনের দিকে। ইমনও রক্তিম চোখে চেয়ে রয়। ছাড়তে না চাইতেই মুরাদের চেষ্টা দেখে ছেড়ে দেয় ইমন। বন্ধুর চেষ্টা বৃথা যেতে দেয় না। শুধু শান্ত গলায় বলে,

—- মা রান্না করেছে দুজন খেয়ে যা।

মুরাদ তাচ্ছিল্যের চাহনী চেয়ে মুসকানকে হির হির করে টানতে টানতে নিয়ে যায়। দু হাত মুঠ করে রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে দেখে মুসকানের চলে যাওয়া। মুসকানের অবিরত কান্না বিধ্বস্ত মুখ দেখে চোখ বুজে ফেলে সে। মুসকান সদর দরজা অবদি গিয়ে ইমনের দিকে ঘুরে তাকায় একবার। তাঁর সে চাহনী দেখে হাটুগেড়ে বসে পড়ে ইমন৷ দুহাত দুদিকে দিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,

—- ও কেনো বুঝতে চাইছে না? কেনো বুঝতে পারছেনা ও আমি ওর বোনকে ভালোবাসি, পাগলের মতো ভালোবাসি আমি ওর বোনকে। কেমন ভাই ও? কেমন বন্ধু ও? একসাথে বন্ধু আর বোনকে আঘাত করতে ওর বুক কাঁপে না? আজ যদি ওর জায়গায় অন্য কেউ হতো মেরে পুঁতে দিতাম আমি। বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here