হারানো_সুর-২য় পর্ব ©শাহরিয়ার

0
7797

#হারানো_সুর-২য় পর্ব
©শাহরিয়ার

— প্রেমার পেটে আর সে খাবার ঢুকলো না, আস্তে আস্তে বাড়ি ভর্তি মেহমান খালি হয়ে গেলো। প্রেমা তাড়াতাড়ি সকলের চোখের আড়ালে নিজের রুমে এসে শাড়িটা চেঞ্জ করে নিতেই। মিহি ঘরের ভিতর ঢুকলো। প্রেমাকে জড়িয়ে ধরে মামুনি কি করছো?

প্রেমা:- মিহির মুখ হাত বুলিয়ে দিয়ে এইতো মামুনি জামা চেঞ্জ করলাম।

মিহি:- মামুনি আমার খুব খুদা লেগেছে চলো আমাকে খায়িয়ে দিবে।

প্রেমা:- আমি যখন ছিলাম না তখন তোমাকে কে খায়িয়ে দিতো?

মিহি:- বাবা আর দাদী, আমি বলতাম মায়ের হাতে খাবো কিন্তু তুমিতো আসতে না।

— মিহির মুখে এমন কথা শুনে প্রেমার হৃদয়টা কেঁপে উঠে, মা মরা মেয়ে সে কি করে জানবে মাকে ডাকলেইতো আর মা ফিরে আসে না। মিহিকে কোলে নিয়ে প্রেমা ডাইনিং এসে বসলো প্লেটে খাবার নিয়ে মিহিকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। মিহি বাধ্য মেয়ের মত খাবার খাচ্ছে। প্রেমার দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে, এতো মিষ্টি একটা মেয়ে অথচ ভাগ্যটা কি খারাপ। ভাবতেই প্রেমার চোখের কোনে জল চলে আসলো। নিজেকে সামলে প্রেমা মেয়েকে খায়িয়ে যাচ্ছে। খাওয়ানোর এক পর্যায় মিহির দাদী এসে টেবিলে বসলো। প্রেমার দিকে তাকিয়ে উনি প্রশ্ন করলেন কেমন লাগছে আমাদের এখানে।

প্রেমা:- এমন প্রশ্ন শুনে যেন হৃদয়ের ভিতর বিছাল শূন্যতার কথা মনে পরলো, সে যা কোন দিনও চায়নি তেমনি হয়েছে তার সাথে, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে শাশুরির দিকে তাকিয়ে ভালো লাগছে মা।

শাশুড়ি মা:- মিহি কি তোমাকে জ্বালাতন করে?

প্রেমা:- মিহির কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে মিহি খুবি মিষ্টি মেয়ে, ও কাউকে জ্বালাতন করতেই পারে না। আপনাকে ভাত দিবো মা?

মা:- তুমি কি খেয়েছো? তুমিওতো মনে হয় খাওনি আর হৃদয় কোথায় ওকেও তো সেই দুপুর থেকে দেখতে পাচ্ছি না।

— প্রেমা এতো সময় মিহির সাথে গল্প করায় ব্যস্ত থাকায় হৃদয়ে কথা মনেই ছিলো না। হঠাৎ শ্বাশুরির এমন প্রশ্নে প্রেমা মাথা নিচু করে রইলো, মিসেস আহমেদের বুঝতে বাকি রইলো না যে ছেলে কোথায় তা বৌমার জানা নেই, তাই সে চিৎকার করে কাজের মেয়েটিকে ডাক দিলো। তিনচার বার ডাক দিতেই মেয়েটি দৌঁড়ে ছুটে আসলো ডাইনিং টেবিলের সামনে।

মনি:- হাঁপাতে হাঁপাতে খালাম্মা আমাকে ডাকতেছেন ক্যান?

মা:- তোর ভাইজান কোথায় সে কি দুপুরের খাবার খেয়েছে?

মনি:- মাথা নিচু করে জ্বি না খালাম্মা ভাইজান খাই নাই, হেরেতো মুই হেই কর্ণারের রুমের দিকে যাইতে দেখছি তখন আর বাহির হয়নাই।

মা:- তোর খালুজান কখন বের হইছে?

মনি:- কিছুক্ষণ আগেই খেয়ে বের হইছে।

মা:- আচ্ছা তুই যা।

— মনি চলে যেতেই মেসেস আহমেদ প্রেমার দিকে তাকিয়ে মারে আজ চার বছর হলো, রোদেলা মারা গেছে, ছেলেটা আজও তার স্মৃতি নিয়ে পরে আছে। এখনো পাগলের মত সেই তাকেই ভালোবাসে। কিন্তু চাই সে ভালোবাসার সমস্তটা এখন শুধুই তোর জন্য হবে। যে অতীত সে অতীতেই থাকুক আমি চাই বর্তমান নিয়েই আমার সন্তান সুখি হউক। আমি চাই তুমি তুই তোর সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আমার সন্তানকে তার অতীত বুলিয়ে দিবি। নতুন করে তোকে ভালোবাসতে বাধ্য করবি। তোর অধিকার তুই আদায় করে নিবি। পারবি না মা বল তুই আমাকে তুই পারবি।

— যে মানুষটাকে দু’চোখে দেখতে ইচ্ছে করে না সে মানুষটা কে ভালোবাসতে হবে? কথাটা ভাবতেই প্রেমার হৃদয়টা ভয়ে কেঁপে উঠলো। ভালোবাসা এতোই সহজ যাকে তাকে মন দিয়ে দেয়া যায় নাকি বললেই? আমার চেয়ে বয়সে কত বড় লোকটা। কথা গুলো ভাবছে আর মিহিকে খায়িয়ে দিচ্ছে প্রেমা। এমন সময় মিহি বলে উঠলো মা পানি খাবো। ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে প্রেমা তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো মিহির দিকে। মিহি পানি খাচ্ছে প্রেমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। ওকে দেখলেই যেন হৃদয়টা জুড়িয়ে যায়। শাশুড়ি মা আমি জানি তুই পারবি এমনি করে সারা জীবন আমার এই নাতনীটার মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে। তাইতো তোকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লাগে আর বিশ্বাস জাগে তাইতো কোন কিছু চিন্তা না করে সোজা তোকে এ বাড়ির বউ বানিয়ে নিয়ে আসি। বল তুই পারবি না তোর যে দায়িত্ব তা পালন করতে?

প্রেমা:- মাথা নাড়িয়ে জ্বি মা আমার জন্য দোয়া করবেন।

মা:- আনন্দে খুশি মনে অবশ্যই তোর জন্য আল্লাহর দরবারে আমি সব সময় দোয়া করবো। এবার ভাত দে আজ পেট ভরে ভাত খাবো।

— শাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে প্রেমার খুব আনন্দ লাগে। প্রেমা প্লেটে খাবার বেড়ে উনার সামনে এগিয়ে দিতেই মিসেস আহমেদ নিজের আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে প্রেমার হাতে দিয়ে, এই নে তোর দায়িত্ব আজ থেকে তুই এ বাড়ির মালকিন। সবাই তোর কথায় চলবে, প্রেমা কিছুটা ভয় পেয়ে যেয়ে মা কি বলছেন এটা আপনার কাছেই রাখুন এতো বড় দায়িত্ব আমি কি সামলে নিতে পারবো?

মা:- প্রেমার হাতের উপর হাত রেখে ভয় পাস কেন আমিতো আছি তাই না? আমি তোর শাশুড়ি না মনে রাখবি আমি তোর মা। এ বাড়ির সকলের তুই পূর্ণ সাপোর্ট পাবি। তাই তোর ভয়ের কোন কারণ নেই। তার সব চেয়ে বড় দায়িত্ব হৃদয়ের মনের ভিতর জায়গা করে নেয়া তার অতীত জীবনকে ভুলেয়ে দেয়া। যেন সব ভুলে ও শুধু তোকেই ভালোবাসে।

— মায়ের মুখের এমন কথায় প্রেমার মুখ থেকে বের হয়ে আসলো আমার জন্য দোয়া করবেন মা। আমি যেন সব কিছু সামলে নিতে পারি। প্রেমার কাছে মনে হতে থাকলো জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটাই তার সামনে দাঁড়িয়ে। যে মানুষটাকে সহ্য হয়না সেই মানুষটাকে ভালোবেসে আপন করে নিতে হবে। অথচ সেই মানুষটার মনের মাঝে অন্যকারো বসবাস। সেখানে লড়াই করে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করে নিতে হবে। প্রেমা বুঝতে পারছে লড়াইটা খুব সহজ হবে না। তবে তাকে লড়ে যেতে হবে ছোট মিহির দিকে তাকাতেই মায়া আর মমতায় সত্যিই নিজেও একজন মা হয়ে যায় প্রেমা। শাশুড়ির ভালোবাসা আর বিশ্বাস কোন ভাবেই সে ভাঙতে পারবে না। তাই হয়তো সারা জীবন তাকে লড়াই করে যেতে হবে। নিজের বিরুদ্ধে যে মানুষটাকে এখনো ঠিকমত চিনে না সে মানুষটাকে ভালোবাসার জন্য লড়াই করে যেতে হবে। কথা গুলো যখন ভাবছিলো তখনি শাশুড়ি বলে উঠলেন হৃদয় দক্ষিনের শেষ ঘরটায় আছে মিহিকে খায়িয়ে আমার কাছে রেখে তুমি যেয়ে ওর সাথে দেখা করে আসো। এখনো ছেলেটা দুপুরের খাবার খায়নি যদি পারো তবে নিয়ে এসে এক সাথে খেও।

প্রেমা:- মিহিকে খাওয়ানো শেষ করে শাশুড়িকে বললো জ্বি মা।

— মিহিকে শাশুড়ির সাথে উপরে পাঠিয়ে দিয়ে টেবিলের উপর থাকা সব খাবার সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে। নিজের শাড়ির আঁচলে চাবির গোছাটা শক্ত করে বেঁধে হাতে চায়ের মগ নিয়ে এক’পা, দু’পা করে এগিয়ে চললো প্রেমা হৃদয় যে রুমে আছে সে রুমের দিকে। হাত পা ভয়ে কাঁপছে যদি মানুষটা হিংস্র রূপ ধারণ করে। কিংবা তার উপর ঝাপিয়ে পরে তার অধিকার আদায়ে তখন কি করবে প্রেমা। আবার নিজেই নিজেকে বলছে আচ্ছা আমি এতো কিছু কেন ভাবছি? সে এমনটা করলে আর আগেই করতে পারতো। নানান জলপনা কল্পনা করতে করতে ঘরের দরজায় হাত রাখতেই দরজাটা একা একা খুলে গেলো। দরজাটা খুলতেই অবাক হয়ে গেলো প্রেমা। পুরো ঘরের দেয়াল ভর্তি একটা মেয়ের নানান রকম ছবি দিয়ে। আর সব গুলো ছবিই হাতে পেন্টিং করা। প্রেমার বুঝতে বাকি রইলো না এই ছবি গুলো কার। প্রেমা দরজা ঠেঁলে ঘরের ভিতর ঢুকে পরলো।

হৃদয়:- আমি জানতাম তুমি এখানে আসবে।

প্রেমা:- ছবি গুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে আপনি কি করে জানতেন?

হৃদয়:- খুবি সাধারণ প্রশ্ন, শ্বশুড় শাশুড়ি যখন তার ছেলের বউকে প্রশ্ন করবে তোমার বর কই তখন সে না জানলে, তখন শ্বশুড় শাশুড়ি তাকে জানিয়ে দিবে সে কোথায় আছে। বাবা যেহেতু বাড়িতে নেই মা নিশ্চই বলেছে আমি এখানে আছি।

প্রেমা:- হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। চায়ের মগটা হৃদয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে নেন।

হৃদয়:- চায়ের মগ হাতে নিয়ে এটা ভালো কাজ করছো, খুব ক্লান্ত লাগছিলো।

প্রেমা:- একটা একটা ছবি ঘুরে দেখছে আর বলছে দুপুরের খাবার খেতে আসেন নাই কেন?

হৃদয়:- খেতে ইচ্ছে করছিলো না, চা প্রয়োজন ছিলো নিয়ে এসেছো এতেই হবে।

প্রেমা:- চায়ে কি পেট ভরবে?

হৃদয়:- না তবে কিছু জিনিস পেট ভরার জন্য মানুষ খায় না মনের তৃপ্তি মেটাতে খায়।

— একটা ছবির উপর হাত রেখে প্রেমা বলতে শুরু করলো রোদেলা আপু অনেক সুন্দর ছিলো। অনেক ভালোবাসতেন তাই না আপুকে?

— প্রেমার এমন প্রশ্নে হৃদয়ের দু’চোখের কোনে জল চলে আসলো। নিজেকে সামলে প্রেমার দিকে এক দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইলো হৃদয়। কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হয়না। তবে দৃষ্টি আর মন দিয়েই বুঝে নিতে হয়। হয়তো প্রেমা তা জানে বুঝে

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here