#হারানো_সুর- শেষ পর্ব
©শাহরিয়ার
— তিন জন বসে বসে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে আসলো। হৃদয় বলে উঠলো সন্ধ্যার সময় নাকি পুকুর ঘাটে ভুত প্রেত ঘুরাফেরা করে।
রিমি:- হাসতে হাসতে জিজু আপনার পাশেই দু’জন ভুতনি বসে আছে আর কোন ভুত প্রেত আসবে না এখানে।
— রিমির কথা শুনে হাসতে শুরু করলো হৃদয়।
প্রেমা:- চারিদিক নিরব আর অন্ধকার হয়ে আসছে আমারও মনে হয় এখন এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার।
রিমি:- প্রেমার দিকে বড় বড় চোখ করে আপু তুই কবে থেকে ভুত প্রেত বিশ্বাস করতে শুরু করলি?
প্রেমা:- হাসতে হাসতে ভুত প্রেত নারে, বাড়িতে না ঢুকলে সবাই একটু পর খুঁজতে বের হবে। আর মিহি অনেক সময় ধরে একা বাড়ির ভিতর।
রিমি:- হ্যাঁ ঠিক বলছো চলো।
— তিনজন ঘাট থেকে উঠে হাঁটা শুরু করলো বাড়ির দিকে। বাড়িতে এসে রিমি নিজের রুমে আর হৃদয়, প্রেমা তাদের রুমে চলে আসলো। ফ্রেস হয়ে বের হতেই প্রেমা বললো আপনি রেস্ট নিন আমি আপনার জন্য চা নিয়ে আসছি।
হৃদয়:- থাক লাগবে না তুমি আমার পাশে বসে থাকো তাহলেই হবে।
প্রেমা:- এক বিকেল পুরোটাইতো আপনার সাথো ছিলাম, একটু পরে চা নিয়ে না হয় আবার আসবো এখন আপনি যেয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ান আমি চা নিয়ে আসছি।
— কথাটা বলে প্রেমা উঠে রওনা দিবে অমনি হৃদয় প্রেমার হাত ধরে টান দিতেই খাটের উপর পরে যায় প্রেমা। হৃদয় প্রেমাকে বলে এক মুহুর্তও তোমাকে ছাড়া এখন একা একা থাকবো না।
প্রেমা:- ইস কি বলে বাড়িতে এতো লোক জন কি মনে করবে?
হৃদয়:- কেউ কিছু মনে করবে না। সবাই জানে বুঝে নতুন বিয়ে হলে স্বামীও স্ত্রী একে অপরের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করে।
— প্রেমা কিছু বলে না অপলক চেয়ে রয় হৃদয়ের দিকে এই মানুষটার কথায়, চোখে এক অদ্ভুদ মায়া আর ঘোর আছে যেখান থেকে কোন ভাবেই বের হয়ে আসতে পারে না প্রেমা। এতো মোহ কি করে একটা মানুষের প্রতি জন্মাতে পারে প্রেমা তা বুঝে উঠতে পারে না।
হৃদয়:- অমন করে কি দেখছো?
প্রেমা:- আপনাকে,
হৃদয়:- হেসে আমাকে কি আগে কখনো দেখোনি নাকি?
প্রেমা:- যতই দেখছি ততই নিজেকে হারিয়ে ফেলছি আপনার মাঝে।
— হৃদয় কোন কথা না বলে শক্ত করে প্রেমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো করে চুমু দিলো, এমন সময় দরজায় টোকা দিয়ে রিমি প্রেমাকে ডাক দিলো। প্রেমা তাড়াতাড়ি উঠে শাড়ির আঁচল ঠিক করে যেয়ে দরজা খুলতেই রিমি চায়ের মগ নিয়ে রুমের ভিতর ঢুকে পরলো। ততক্ষণে হৃদয় যেয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছে। প্রেমা আর রিমি দু’জনেই যেয়ে ব্যালকনিতে হৃদয়ের পাশে দাঁড়ালো, চায়ের সাথে তিনজনের গল্প আবারও জমে উঠলো। এদিকে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো। তিনজনেই চলে গেলো ডাইনিং এ রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। সকলে এক সাথে মিলে রাতের খাবার খাওয়া শেষ করলো। রিমি মিহিকে নিয়ে তার রুমে চলে গেলো প্রেমা আর হৃদয় নিজেদের রুমে। প্রেমা বিছানা ঠিক করছে হৃদয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি উপভোগ করছে আর সিগারেট টানছে। ততক্ষণে প্রেমার বিছানা গোছানো শেষ হয়ে গেছে। প্রেমা পেছন থেকে এসে হৃদয়কে জড়িয়ে ধরলো।
হৃদয়:- উল্টা দিকে থাকা অবস্থাতেই হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে কি হলো বাহিরে আসলে কেন বৃষ্টি হচ্ছেতো।
প্রেমা:- হুম সেতো দেখতে পাচ্ছি।
— হৃদয় ঘুরে প্রেমার মুখোমুখি হয়ে প্রেমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। প্রেমাও হৃদয়ের দিকে চেয়ে রইলো। দু’জনই নিরব প্রকৃতিও বুঝে দু’জন ভালোবাসার মানুষকে কি করে এক করতে হয়, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস শুরু হলো। বাতাসের কারণে বৃষ্টির পানি ব্যালকনিতে চলে আসছে, হৃদয় প্রেমাকে পাজা কোলে রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। প্রেমা শক্ত করে হৃদয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো।
— দেখতে দেখতে গ্রামে বেশ আনন্দের সাথেই তিনটা দিন কেটে গেলে, এবার শহরে নিজের বাড়িতে ফেরার পালা। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেলো নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার আগে আগেই ঢাকায় চলে আসলো ওরা। রিমি আরও দু’দিন এ বাড়িতে থেকে চলে গেলো তার নিজের বাড়িতে। হৃদয়ের বাবা মা নিজের সন্তানের এমন পরিবর্তনে অনেক খুশি। দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেলো। হৃদয় নিয়মিত অফিস করছে। বেশ লাগছে, বাবা অফিসের সব দায়িত্ব হৃদয়ের কাঁধে তুলে দিলো।
— দুপুরে খাবার টেবিলে বাবা প্রেমাকে বলতে শুরু করলো, মা সত্যিই তুই অনেক লক্ষী মন মরা হয়ে থাকা ছেলেটাকে একদম চাঙ্গা করে দিয়েছিস।
প্রেমা:- সবই আপনাদের দোয়া বাবা, আপনারা দোয়া করবেন যেন উনি সব সময় এমন থাকেন।
— দেখতে দেখতে আর চার মাস চলে গেলো প্রেমা নিজের মাঝে অন্য আরেক জনের অস্থিত্ব বুঝতে পারলো। প্রেমা অনেক আনন্দিত হলো। রাতে হৃদয় বাসায় আসতেই হৃদয়কে জানালে হৃদয় আনন্দে প্রেমাকে জড়িয়ে ধরলো।
হৃদয়:- সত্যি বলছো?
প্রেমা:- হ্যাঁ সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি।
হৃদয়:- আজ এই আনন্দে তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিবো চলো।
প্রেমা:- কোথায়?
হৃদয়:- আমার সাথে আগে যাবেতো।
প্রেমা:- আচ্ছা যাবো, তার আগেতো আপনি ফ্রেস হয়ে নিন।
হৃদয়:- আরে ফ্রেস হবো সমস্যা নেই আগে আমার সাথে চলো।
— প্রেমা আর কথা না বাড়িয়ে হৃদয়ের সাথে হাঁটা শুরু করলো। প্রেমা জানে হৃদয় যখন যা বলবে তাই করবে। হাঁটতে হাঁটতে দু’জন সেই রুমটার সামনে আসলো যে রুম ভর্তি শুধুই রোদেলার ছবি। প্রেমার অন্তরটা কেঁপে উঠলো। যে রুমে শুধুই রোদেলার ছবি সে রুমে কি এমন সারপ্রাইজ তার জন্য অপেক্ষা করছে? ভাবতে ভাবতে হৃদয় রুমেে দরজা খুলে ফেললো। দু’জন এক সাথে রুমের ভিতর প্রবেশ করলো। হৃদয় প্রেমাকে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াতে বললো, প্রেমা ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। হৃদয় সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা ক্যানভাসটা উনমুক্ত করে দিয়ে প্রেমাকে চোখ মেলে তাকাতে বললো। প্রেমা তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। সেখানে প্রেমা আর হৃদয়ের এক সাথে একটা ছবি, সেদিন নৌকায় করে ঘুরার সময় ছবিটা হৃদয় তুলেছিলো। সে ছবি হৃদয় নিজের হাতে আর্ট করেছে। প্রেমা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছে। হৃদয় কাছে এসে প্রেমাকে জড়িয়ে ধরে পছন্দ হয়েছে।
প্রেমা:- চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে অনেক পছন্দ হয়েছে।
হৃদয়:- একি কাঁদছো কেন?
প্রেমা:- ওহ কিছু না খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছে বলে চোখ মুছে নিলো।
— হৃদয় প্রেমাকে জড়িয়ে ধরলো। দু’জন হাসতে হাসতে সে রুম থেকে বের হয়ে আসলো। আস্তে আস্তে বাড়ির সকলে জেনে গেলো প্রেমা মা হতে চলেছেন। সে খবর পৌঁছে গেলো প্রেমাদের বাড়িতেও। আরও দুই মাস পার হতেই রিমি চলে আসলো বোনের বাড়িতে বোনের দেখাশোনা করার জন্য। বাড়িতে আনন্দের যেন শেষ নেই। দেখতে দেখতে চলে আসলো সে দিন যে দিনটার জন্য সকলে অপেক্ষা করছিলো।
— হাসপাতালের বারান্দায় সকলে হাঁটাহাটি করছে। কখন ডাক্তার এসে খুশির খবর দিবে। হৃদয়ের যেন আর তর সইছিলো না। মিহিকে কোলে তুলে নিয়ে এদিক সেদিক হাঁটছে আবার একটু পর দরজার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে হঠাৎ করেই সকলের কানে ভেসে আসলো কান্নার শব্দ। সকলে খুশি হলো ভিতর থেকে নার্স বের হয়ে বললো মিষ্টি নিয়ে আসুন ছেলে হয়েছে। সকলে এক সাথে বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ। হৃদয় নার্সের দিকে তাকিয়ে বললো আমার স্ত্রী কেমন আছে। নার্স হেসে বললো উনিও সুস্থ আছেন। হৃদয় বললো আমি কি যেতে পারি। নার্স বললো হ্যাঁ অবশ্যই।
হৃদয় আর দেরী না করে ছুটে গেলো প্রেমার কাছে। একজন নার্স বাচ্চাকে কোলে তুলে দিলে। হৃদয় তাকে প্রেমার কাছে দিলো প্রেমা বুকে নিয়ে বাচ্চার কপালে চুমু খেলো। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে দিলো হৃদয়ের দিকে হৃদয় সে হাত ধরে এগিয়ে যেয়ে প্রেমার কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিলো। জীবনে যেন নতুন করে সব সুর সব আনন্দ খুঁজে পেলো হৃদয়। একে একে ততক্ষণে সকলে দেখতে চলে আসলো ছোট শিশুটিকে। রিমি কোলে তুলে নিয়ে বলতে শুরু করলো ঠিক জিজুর মত হয়েছে দেখতে। রিমির কথায় সকলে এক সাথে হেসে দিলো। মিহি বলে উঠলো ভাইয়াকে আমার কোলে দাও। বিছানায় মায়ের পাশে বসে মিহি কোলে তুলে নিলো তার ভাইকে। হৃদয় আর প্রেমা জড়িয়ে ধরলো ওদের কে। হৃদয় প্রেমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো ভালোবাসার কোন বয়স লাগে না। প্রেমা হেসে বললো আমাদের পরিবারটা আজ পরিপূর্ণ।
সমাপ্ত।