হঠাৎ মেঘে বৃষ্টি পর্ব ১

0
2294

“কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলে৷ আমায় এভাবে ঠকাবে আমি কোনদিন ভাবতে পারিনি৷ কোন মুখে আমার কাছে ক্ষমা চাও?”

ইরা ভেজা গলায় রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল সাব্বিরকে৷ এক মুহুর্তও সাব্বিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না৷ দীর্ঘদিনের সম্পর্ক মুহুর্তের মাঝে ভেঙে দিল৷ সাব্বির নম্রতার সহিত বলল,

“আমার জীবনে নিহা ছিল প্রথম ভালোবাসার মানুষ। আমাদের মাঝে সামান্য ভুল বুঝাবুঝির জন্য সম্পর্কের ইতি টানতে হয়েছে৷ আমার জীবনে নিহা ফিরে এসেছে৷ কিছুতেই আমার জীবনে তোমাকে জড়াতে পারব না৷”

ইরা মাথায় রক্ত উঠে পড়ল৷ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। হৃদয় ভাঙার বেদনা মেনে নিতে পারছে না৷ সাব্বিরের শার্টের কলার ধরে ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“এতদিন আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করলে কেন? আমি তোমাকে মন উজাড় করে ভালোবেসেছি৷ তোমার প্রতিটি কথার সঙ্গ দিয়েছি৷ আমার প্রতি তোমার একটুও অনূভুতি জন্মায় নি৷”

সাব্বির মলিন ভেজা গলায় জবাব দিল,

“নিহা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমি খুব ভেঙে পড়ছিলাম৷ তোমার সাথে যতক্ষণ সময় সঙ্গ দিতাম ততক্ষণ নিহার কষ্ট ভুলে যেতেম৷ দিনশেষে আমাকে ইরার কষ্ট জর্জরিত করেছে৷ প্রতিটি রাত তাকে নিয়েই ভেবেছি৷ আমাকে ক্ষমা করে দাও৷ ভালো একজনকে বিয়ে করে নিও৷”

ইরা বাকশক্তি হীন৷ ভালোবাসার মানুষকে এভাবে হারাতে হবে ভাবতে পারিনি৷ ভালোবাসার থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রনা খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে৷ ঘৃণায় সাব্বিরের দিকে পলক ফেলতে ইচ্ছা করছে না৷ নিহার হাত ধরে ভেজা গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলল,

“অভিনন্দন। সাব্বিরের খেয়াল রাখবে৷ তুমি খুবই ভাগ্যবতী৷ সাব্বিরের মতো একজন ভালো মনের মানুষকে পেয়েছো। তাকে হাত ছাড়া করবে না৷ কখনও কষ্ট দিবে না৷ অল্প ভালোবাসাতে তুষ্ট।”

ইরা দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না৷ দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল৷ একটু দূর যেতেই রিক্সা পায়৷ নেত্রদ্বয়ের উষ্ণ জল বাঁধা মানছে না৷ বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে৷ রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ছে না৷ বাতাসে বইছে বিষাদময় গল্পের গন্ধ৷ ভালোবাসা মানুষকে এত কষ্ট দেয় কেন? কি দোষ ছিল আমার? আমার ভালোবাসায় কোন কমতি ছিল না৷ আমার এলোমেলো জীবনে কেন আসল সাব্বির৷ আমার মনে রঙিন প্রজাপতির বাসা বেঁধে কেন চলে গেল দূরে৷

ইরা বাসায় এসে সাব্বিরের দেওয়া সমস্ত কাঁচের চুড়ি ভাঙতে থাকে৷ কাঁচের টুকরোয় ছিদ্র হয়ে হস্তখানা৷ সেদিকে ভূক্ষেপ নেই। মনের ব্যথার কাছে সবাই তুচ্ছ মনে হচ্ছে৷ সাব্বিরের দেওয়া সাদা, কালো, নীল শাড়ি আলমারি থেকে বের করে৷ বুকে ঝাপটিয়ে কান্না করতে থাকে৷ রাখবে না তার কোন স্মৃতি। টুকরো টুকরো করে ফেলে শাড়ীগুলো৷ চৌকাঠের বাহির থেকে ইরা ধ্বনি ভেসে আসছে৷ সাড়া দিচ্ছে না৷ নিজেকে একাকিত্ব মনে করছে ইরা৷
ইরা ভাঙা কাঁচের টুকরো, শাড়ীর টুকরো নিয়ে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে৷
__________

ইরা চলে যেতেই সাব্বির ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে৷ এতটা নির্দয়, এতটা পাষাণ মনের অধিকারী সাব্বির নয়৷ ইরার ভালোবাসার তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। সাব্বিরের অনিশ্চিত জীবনে ইরাকে জড়াতে চায়না৷ সাব্বিরের জন্য পৃথিবীর আলো সাময়িক। কিছুদিন পরেই সকলের মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুর পথযাত্রী হবে৷ ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিয়ে হলেও বাঁচিয়ে রাখার একটু প্রচেষ্টা। নিহা সাব্বিরের কাঁধে হাত রাখতেই সাব্বির বাচ্চার মতো কান্না করে দিল৷
কষ্ট ভরা মন দিয়ে বলল,

“আমার কি করার ছিল? আমার আয়ুষ্কাল খুব অল্প৷ আমার জীবনে কিভাবে ইরাকে নিয়ে আসব? আমার বাস যে ইরাময়৷ তার সনেই বেঁধেছি আমি ঘর৷ আমি ইরাকে খুব ভালোবাসি৷ আমি ইরাকে খুব ভালোবাসি।”

সাব্বিরের কান্না দেখে নিহার চোখ থেকে উষ্ণ জলের ফোঁটা মেঘের ন্যায় বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে৷ এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে৷ বুঝতে পারে ভালোবাসা কতটা অমূল্য সম্পদ৷ যার জন্য মানুষ সবকিছু ত্যাগ করে৷ ভালোবাসার মানুষকে সবাই খুশি দেখতে চাই৷ এক ফালি সূর্যের ঝিলিক যেন লেগে থাকে ঠোঁটের কোণে৷ সাব্বির ইরার ভালোবাসা দেখে বুঝতে পারে৷ ইরার ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় সাব্বিরকে। নিহা ভেজা গলায় বলল,

“তুই ইরাকে মিথ্যা কথা না বললেও পার’তি। তুই তোর সমস্যার কথা বলতে পার’তি৷ তুই যে লিউকিমিয়া রক্ত রোগে আক্রান্ত বললে ইরা তোকে কখনও ভুল বুঝতো না৷”

লিউকিমিয়া রক্ত যার বাংলা অর্থ হলো অস্থিমজ্জায় ক্যান্সার৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য হলো রক্ত কনিকার সংখ্যা৷ সাধারণত অস্বাভাবিকভাবে শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বেড়ে যায়৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ এ চিকিৎসা বিরল৷ চিকিৎসার মাধমে কাউকে সর্বোচ্চ ছয় মাস বাঁচিয়ে রাখা যায়৷ প্রাথমিক অবস্থায় কাশির সাথে রক্ত ক্ষরণ হয়৷ উত্তেজিত হলেই নাকে মুখে রক্ত আসে৷ সাব্বির নিহার হাত ধরে করুণ স্বরে বলল,

“প্লিজ তুই এ কথা কাউকে বলবি না৷ আমি চাইনা আমার বন্ধু মহল আমার জন্যে কষ্ট জর্জরিত হোক৷ তাদের মুখে আমি সব সময় হাসি দেখতে চাই৷ আমি মা-রা গেলে তারা কষ্ট না পায়৷ আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দে৷”

নিহা কিছু বলল না৷ বলেও কোন লাভ নেই৷ সম্পর্কটা বর্তমানে অনেক দূর চলে গেছে। ইরার আগে বন্ধু মহলে পড়ে গেছিল হইচই। সবার সাথে খারাপ ব্যবহার৷ সাবাইকে দোষারোপ করা। কেউ মেনে নিতে পারছে না সাব্বিরকে৷ আমরা মানুষের উপরের চেহারা টা দেখি৷ ভিতরে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা দেখতে পারিনি৷ লুকিয়ে রাখার ভালোবাসা দেখার শক্তি মহান আল্লাহ তালায়া আমাদের দেননি৷ সাব্বির সবথেকে বেশি কষ্ট পেয়েছে ইরার সাথে নাটক করে৷ ইরাকে সে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে৷ শরতের কাশফুল, বসন্তের বাহারী রঙের ফুলে উঠা ফুল, স্বচ্ছ আকাশের মেঘগুলো সাক্ষী তাদের ভালোবাসা। তবুও সেই ভালোবাসার বিচ্ছেদ। সৃষ্টিকর্তা চাননি চারটি হাত এক করতে৷ নিষ্ঠুরতম পৃথিবীতে তাদের হলো না মিল৷ সাব্বির হাশরের ময়দানে পাবে কি ইরার দেখা?
_______________

রাত যত গভীর হচ্ছে না পাওয়ার কষ্ট তীব্র হচ্ছে৷ জানান দিচ্ছে হারানোর কষ্ট। ইরা নিজে কিছুতেই এ বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারছে না৷ কাঁপা হাতে ফোন দিল সাব্বিরকে৷ সাব্বির যেন ইরার ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিল৷ ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসল৷ নিরবে নিভৃতে কাঁদে যাচ্ছে ইরা, বাকরুদ্ধ হয়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে৷ নেই কোন কথা সাব্বিরের কণ্ঠে। ইরা নিরবতা ভাঙে ভেজা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

“আমার ধম বন্ধ হয়ে আসছে সাব্বির৷ আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্তও কল্পনা করতে পারছি না৷ প্লিজ আমাকে তুমি মুক্তি দাও৷”

সাব্বিরের চোখ থেকে বয়ে যাচ্ছে উষ্ণ অশ্রুর স্রোতের ধারা৷ অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,

“নিজেকে শান্ত করো ইরা৷ তোমাকে ভেঙে পড়লে হবে না৷ অন্য কাউকে ভালোবেসে সুখী হও৷”

“আদৌও কাউকে ভালোবাসতে পারব! সব জায়গা থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে৷ দ্বিতীয় কাউকে আমার জীবনে আনতে পারব না। সে তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকতা হবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই৷”

“পারবে না কেন? আমি নিজের জীবনে এগিয়ে যেতে পারলে তুমি কেন পারবে না? মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখো? তুমি কি রক্ত মাংসে গড়া মানুষ নও?”

“আমি মানুষ৷ আমার রক্তে বিশ্বাসঘাতকতা নেই৷ কাউকে ঠকিয়ে জাহান্নামে পাঠাতে৷ আমি কারো মন নিয়ে খেলতে পারি না৷ বিশ্বাস উঠে গেছে মানুষের উপর৷ শুধু তোমার জন্য। তোমার মতো আমি নিখুঁত খেলোয়াড় নই৷ প্লিজ সাব্বির তোমায় ছাড়া আমার ধম বন্ধ হয়ে আসছে৷ ফিরে আসো না আমার কাছে৷”

“তুমি পাশে থাকলে আমার ধম বন্ধ হয়ে আসে৷ তোমায় দেখতে মনে পড়ে আমি নিহাকে ঠাকাচ্ছি৷ পারব না তাকে ছাড়া থাকতে৷ আমাদের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হচ্ছে৷ তবুও ভালো কোন ছেলে দেখে বিয়ে করে নাও৷ জীবনে সুখী হও৷”

সাব্বিরের কথাগুলো বিষাক্ত তীরের ন্যায় ইরার মনে বিঁধছে। চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে হৃদয়খানা৷ ইরা একটু অভিমান করলে সাব্বির ইরার অভিমান ভাঙাতে কত কিছু করত! ছিল না ছিঁড়ে ফুটাও ছলনা৷ সখ্যতা ভালোই ছিল দু’জনের মাঝে৷ এইতো সেদিন সাব্বির আসতে পাঁচ মিনিট দেরি করছিল তার জন্য কতভাবে ইরার কাছে ক্ষমা চেয়েছে৷

গুটি গুটি বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে ধরনী৷ গাছের কিশলয় চিকচিক করছে৷ সবুজ ঘাসের উপর বৃষ্টির ফোঁটা মুক্তার দানার মতো পড়ছে৷ ইরা অধীর আগ্রহে বসে টিএসসিতে বসে আছে। কখন ভালোবাসার মানুষের দেখা মিলবে৷ কখন আসবে সাব্বির৷ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সাব্বির চলে আলস৷ কাক ভেজা হয়ে ইরার সামনে বসে৷ ইরা কিছু না বলতেই বলল,

“অনেকক্ষণ থেকে বসে আসো৷ তোমাকে খুব কষ্ট করতে হলো৷”

ইরা মুচকি হেঁসে জবাব দিল,

বৃষ্টির মাঝে একটু দেরি হতেই পারে৷ তুমি তো পুরো ভিজে গেছো৷ ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভিজে গেলে। ছাতা নিয়ে আসার দরকার কি ছিল?

“হালকা ঝড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টি হচ্ছে। সেজন্য ভিজে গেছি৷ দু’জন এক সাথে ভিজলে ভালোই লাগবে৷ একসাথে ভিজবে!”

ইরা তেমন কোন উত্তর দিল না৷ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল৷ ভিজলে সাথে নিয়ে আসা ফোন ব্যাগ কোথায় রাখবে৷ চিন্তায় পড়ে গেল ইরা৷ সাব্বির পরিচিত এক দোকানদারের কাছে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে বৃষ্টিতে নেমে পড়ে৷ পিচঠালা রাস্তায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়েই মুক্তার ফুলকির সৃষ্টির হচ্ছে৷ হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন। অল্পতেই তুষ্ট তারা৷ মুখে তৃপ্তির হাসি বিরাজ করছে৷

চলবে….. ইনশাল্লাহ

#হঠাৎ_মেঘে_বৃষ্টি
#পর্ব_০১
#নুর_নবী_হাসান_অধির

আসসালামু আলাইকুম। নিয়ে আসলাম নতুন গল্প। আপনাদের রেসস্পন্সের উপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাব৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here