#স্বপ্নছায়া
#৫ম_পর্ব
অভ্রকে দাঁড়িয়েয়া থাকতে দেখে ঐন্দ্রিলা বলল,
– ঘরের বাহিরেই থাকবেন নাকি? আসুন৷
অভ্র ভদ্র বাচ্চার মতো ঐন্দ্রিলাকে অনুসরণ করে ভেতরে গেলো৷ মিনিট বিশেক পর ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলো সে। খাবারের মাঝেই ঐন্দ্রিলা বলে উঠলো,
– কাল আমাদের বাসায় যেতে হবে।
– হ্যা যাও, আমি কি মানা করেছি।
– আমি তো একা যাবো না, আপনি সাথে যাবেন।
কথাটা শোনামাত্র বিষম খেলো অভ্র। মেয়েটি এতো আত্নবিশ্বাসের সাথে কথাটা বলছে যেনো এটা অনুরোধ নয় সরাসরি হুকুম। অভ্রের দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– পানিটা খান, বিষম চলে যাবে। তো কাল কখন বের হচ্ছি আমরা?
অভ্র পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেলো৷ এরপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– আমরা না তুমি, আমি যেতে পারবো না। আমার কাল কাজ আছে। তুমি চাইলে গাড়ি পাঠিয়ে দিবো।
– কাজ থাকতেই পারে, আপনি আপনার কাজ শেষ করে আমাকে ফোন দিয়েন। আমি এবং দিশান রেডি থাকবো। আপনি বাসায় আসার পর ই আমরা যাবো। আমার তাতে আপত্তি নেই
– আমি কি কথাটা হিব্রু ভাষায় বলেছি? বাংলা চলিত ভাষায় ই তো বলেছি। তবুও কেনো একটা কথা কেনো বুঝতে পারছো না তুমি বুঝলাম না! আমি যাবো না, জিদ করো না ঐন্দ্রিলা।
– আমি ও হয়তো বাংলায় ই কথাগুলো বলেছি। আপনি যাবেন মানে যাবেন। বিয়ের পর দ্বিরাগমণে কখনোই মেয়ে একা যায় না। আর আমার বাবা অপেক্ষারত রয়েছেন তার জামাইকে আপ্পায়ন করার জন্য। গতরাতে আপনি ই বলেছেন আমাদের বিয়েটা একটা ডিল, যেখানে আমরা দুটো পার্টি। আজ নিজের কথা থেকে ঘুরে যাচ্ছেন? আমি তো আপনাকে একবার ও প্রশ্ন করি নি, “কেনো আমাদের বৌভাতের অনুষ্ঠানটি ভেস্তে দিয়েছেন?” তবে আমার আবদারটুকু রাখতে এতোটা কষ্ট হচ্ছে কেনো আপনার। আমাদের ডিলে উভয় পক্ষের সমান অধিকার এবং হস্তক্ষেপ থাকা উচিত। আপনার রুলস যেমন চলবে, তেমন আমার রুলস ও চলব। আমি এমন আহামরি কোনো আবদার করি নি, সুতরাং আগামীকাল আপনি আমাকে এবং দিশানকে ও বাড়িতে নিয়ে যাবেন। এটা ফাইনাল।
ঐন্দ্রিলার নির্লিপ্ত কথাগুলো অভ্রের অহমিকার দ্বারে গিয়ে কড়া নাড়লো। মূহুর্তেই অভ্রের চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে আসলো। মেয়েটার সাহসের প্রশংসা না করে সে পারছে না, শুধু সাহস নয় তার বুদ্ধিমত্তা ও প্রখর। অভ্রের নিজের জালে তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। অভ্র চাইলেও উচ্চবাচ্য করতে পারছে না। ঐন্দ্রিলা আড় চোখে অভ্রকে দেখছে। লোকটা হাসফাস করছে কিছু বলার জন্য। কিন্তু দাবার ঘোড়ার আড়াই চালের মতো হুট করেই যে ঐন্দ্রিলা তাকে কিস্তিমাত করে ফেলবে, এই ঘটনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। ঐন্দ্রিলার মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। নিজের পিঠে নিজেই চাপড় মেরে বলতে ইচ্ছে করছে
“সাবাস, বাঘের বাচ্চা। সাবাস”
কিন্তু তা আর বলা হয়ে উঠলো না। আহত বাঘের মতো রাগে গজগজ করছে অভ্র। রাগ না সামলাতে পেরে গ্লাসের পানিটা প্লেটে ঢেলে দিলো সে। অভ্রের এমন আচারণে ঐন্দ্রি অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
– একি এটা কি করলেন? খাবারে পানি ঢেলে দিলেন যে? এখন খাবেন কি?
– আমার ক্ষুধা মরে গেছে৷
বলেই হন হন করতে করতে নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা কিছুক্ষণ বেকুবের মতো অভ্রের যাবার দিকে চেয়ে রইলো। লোকটার মাথার ঠিক কটা তার ছেঁড়া সেটা অনুমান করার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাজারো চিন্তা করেও ফলাফল শূন্য। ভাতের প্লেটে এখনো পানিতে ভাসা অর্ধেকটা মাছ এবং এটো ভাত রয়েছে। খাবারের অপচয় দেখলে মাথাটা মূহুর্তেই গরম হয়ে যায় ঐন্দ্রির। এমন অনেকে রয়েছে যারা দুমুঠো ভাতের জন্য শরীরের রক্ত বেঁচতেও দুবার ভাবে না। অথচ সেই অন্ন নষ্ট করে অভ্র বাবু তার রাগ জাহির করছে। ঠোঁটের কোনে মলিন হাসি একে প্লেটের পানিটা ফেলে খাবারটুকু খেয়ে নিলো সে। মন্দ লাগছে না তার। খাবার খাওয়া শেষ হলে সব গুছিয়ে ফেললো ঐন্দ্রিলা। মাঝে মাঝে রাতের মধ্যপ্রহরে একাকীত্বে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ভালো লাগে ঐন্দ্রিলার। অভ্রের রুমে যেতে ভালো লাগছে না। কিন্তু যেতে হবে, নয়তো অহেতুক কথার পিঠে কথা বাড়বে। রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো অভ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ঐন্দ্রিলার রাগটা সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়াচ্ছে। ঐন্দ্রিলা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়৷ অভ্রকে নিয়ে অহেতুক চিন্তা করতে তার ভালো লাগছে না। রাতের গভীরতার সাথে নিস্তব্ধতা ও বেড়েই চলেছে। ঐন্দ্রিলা গভীর ঘুমে মগ্ন। বারান্দা থেকে ঘরের দিকে তাকালে বিছানা চুল খুলে দেওয়া, নীল শাড়ি পরিহিতা রমনীর পিঠটুকু দেখা যাচ্ছে কেবল। একজোড়া চোখে ঘুম নেই, সে তার আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটের ধোঁয়া সেবনের সাথে সাথে নারীটিকে গভীর নয়নে দেখে যাচ্ছে। রমনীটি রুপবতী কিনা তার জানা নেই। কিন্তু রাতের স্তব্ধ জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোতে রমনীটিকে কোনো মৎস্যকণ্যার চেয়ে কম লাগছে না। তবে কি আবারো কোনো নারীর মোহে পড়তে যাচ্ছে সে! কথাটা ভাবতে চোখজোড়া সরিয়ে নিয়ে রাতের কালো আকাশের তাকিয়ে নিকোটিনের জ্বলন্ত ধোঁয়া সেবনে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো সে___________
৪.
শরীফ সাহেব অধীর আগ্রহে মেয়ে জামাইয়ের জন্য বসে আছেন৷ রান্নাঘরে আসমা বেগম, দিশা এবং পিউ
রান্নাবান্নায় ব্যাস্ত। জামাই আসবে বলে কথা, শ্বশুরবাড়ি খাতির যত্ন করবেন না তা কি সম্ভব! ঐন্দ্রিলাদের আসতে আসতে আটটা বেজে গেছে। শরীফ সাহেব অভ্রকে দেখে জড়িয়ে ধরেন। অভ্র মানুষটা বরাবর ই চুপচাপ। এতো ঘটা করে আপ্পায়ন তাকে খানিকটা অস্বস্তির মাঝেই ফেলে দেয়। ঐন্দ্রিকে কাছে পেয়ে শরীফ সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠে। দিশান সবার এরুপ আচারণে ঐন্দ্রিলার শাড়ির আঁচল ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শরীফ সাহেব দিশানের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলেন,
– নানাভাই আপনি কেমন আছেন?
দিশান নতুন মানুষ দেখলেই খানিকটা চুপ হয়ে যায়। ঐন্দ্রিলা তাকে বলে,
– আব্বু, উনি তোমার নানাভাই। উনি আমার আব্বু। দাদানের মতো নানাভাই ও তোমাকে অনেক ভালোবাসে৷ নানাভাই এর কাছে যাও।
ঐন্দ্রিলার কথায় দিশান শরীফ সাহেবের কাছে যায়। শরীফ সাহেব তাকে কোলে তুলে নেয়। গোলগোল চোখ দিয়ে সে শরীফ সাহেবকে দেখে যাচ্ছে। অভ্র খানিকটা অবাক হলো। ঐন্দ্রিলার সাথে মাত্র দুদিনেই দিশান এতোটা মিশে গেছে যে মনেই হচ্ছে না সে তার মা নয়। মেয়েটা কে যেনো প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কার করছে অভ্র।
খাওয়ার টেবিলে শরীফ সাহেবের পাশে বসে অভ্র। এখনো অবধি শ্বশুর জামাই এর তেমন কোনো কথোপকথন হয় নি। দুজনের মাঝেই খানিকটা অস্বস্তিবোধ, জড়তা কাজ করছে। শরীফ সাহেব ধীর গলায় বলেন,
– কাজ কেমন চলছে?
– জ্বী আংকেল, আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– তুমি এতো ব্যাস্ততার মাঝেও যে এখানে এসেছো ভালো লাগলো।
অভ্র কথাটির উত্তরে শুধু বিনয়ের সাথে হাসি দিলো। এর মাঝেই পিউ ঐন্দ্রিকে টেনে রান্নাঘরে নিয়ে আসে। তার মনে হাজারো প্রশ্ন। ঐন্দ্রি অবাক কন্ঠে বললো,
– এখানে টেনে আনলি কেনো? খাবার বেড়ে দিতে হবে তো!
– তুই হ্যাপি তো? মানে অভ্র ভাইয়া তোর সাথে ভালো ব্যাবহার তো করে?
পিউ অধীর উৎকন্ঠায় ঐন্দ্রির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। ঐন্দ্রিলা মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
– হ্যা বাবা, উনি আমাকে যথেষ্ট সম্মান করেন। নয়তো আজ এখানে আসতেন না।
পিউ ফোস করে নিঃশ্বাসটা ছাড়লো। তার যেনো চিন্তার অবসান ঘটলো এতোক্ষণ পর। ঐন্দ্রিলার মুখে এখনো হাসি লেগে আছে। সত্যের মাঝে মিথ্যে জড়িয়ে বলাটা হয়তো পুরোপুরি মিথ্যের কাতারে পড়ে না, পড়ে কি!
খাওয়ার মাঝেই কলিংবেলটা বেজে উঠে, পিউ উঠে দরজাটা খুলে। দরজাটা খুলতেই দরজার ওপারে ব্যাগ কাধে নীলাদ্রিকে দেখতে পায় সে। বৃষ্টিতে তার শার্টের এক পাশ খানিকটা ভিজে গেছে। চুলগুলো হাত দিয়ে ঝাড়ছে সে। শ্যামলা কপালে পানিবিন্দু লেপ্টে রয়েছে। টাইটা অর্ধেক খোলা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে রীতিমতো বিধ্বস্ত। জুন মাসের এই এক সমস্যা, বিনা নোটিসেই এক পশলা বৃষ্টি এসে আপনাকে গোসল করিয়ে দিবে। নীলাদ্রির ক্ষেত্রেও এই ঘটনাটাই ঘটেছে৷ অফিস থেকে বাসে উঠার জন্য অপেক্ষা করছিলো তখনই ঝুম বৃষ্টি এসে রীতিমতো তাকে ভিজিয়ে দিয়েছে। নীলাদ্রি পিউকে দেখেই ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
– আমাকে একটা গামছা দে তো। পুরো ভিজে গেছি।
– আপনি গোসল করে আসুন৷ ঐন্দ্রিরা এসেছে। এক সাথে খাওয়া যাবে।
পিউ এর কথা শুনে ভেতরে তাকায় নীলাদ্রি। খাওয়ার টেবিলে অভ্রকে দেখে মেজাজটা আরোও বিগড়ে গেলো তার। হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলো সে। যাবার সময় পিউ কে কড়া কন্ঠে বললো,
– আমার খাবারটা আমার রুমে দিয়ে যা।
নীলাদ্রির রাগের কারণটা ঐন্দ্রিলার বুঝতে বাকি রইলো না। এই বিয়েতে তার ভাই মোটেই খুশি নয়। তাই তো এই দুদিনে একটা ফোন ও করে নি সে৷ বাবার সাথেও রাগ দেখিয়েছে সে। ঐন্দ্রিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিশানকে খাওয়িয়ে দিতে লাগলো। সুযোগ বুঝে ভাইয়ের সাথে কথাটা তার বলতে হবে।
রাত ১২টা,
পানি পিপাসা লাগায় অভ্রের ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে। পাশ ফিরে দেখে দিশান ঘুমাচ্ছে। ঐন্দ্রিলা নেই, অর্থাৎ সে এখনো পিউ এবং দিশার সাথে গল্পে মশগুল। ঐন্দ্রিলা যাবার আগে অভ্রকে বলে গিয়েছিলো। পাশের ছোট সাইড টেবিলে হাতড়ে পানিশুন্য জগ ব্যাতীত কিছুই পেলো না অভ্র। তাই বাধ্য হয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগুলো সে। ডাইনিং রুমে যেতেই তার মুখোমুখি হলো নীলাদ্রির সাথে। তাদের মাঝে বয়সের খুব একটা পার্থক্য নেই। কিন্তু শালাবাবুর সাথে অভ্রের এখনো কথা হয় নি। খাওয়ার টেবিলে নীলাদ্রির আচারণ দেখেই অভ্র বুঝেছিলো মানুষটি তাকে চূড়ান্ত পর্যায়ের অপছন্দ করে৷ নীলাদ্রির সাথে চোখাচোখি হতেই সে হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে টেবিলের কাছে হাটা দেয়। তখন নীলাদ্রি ঝাঝাঁলো কন্ঠে বলে,
– কথা আছে, ছাঁদে যাওয়া যাক?
অভ্র নীলাদ্রির কথাটা অগ্রাহ্য করতে পারলো না। তাই পানিটা খেয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
– চলো
ছাঁদের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে অভ্র এবং নীলাদ্রি। ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। তিন ঘন্টার একটানা ঝুম বৃষ্টি উত্তপ্ত ঢাকা শহরকে শীতল নগরীতে পরিণত করেছে। নীলাদ্রি সিগারেটটা অভ্রের এগিয়ে দিয়ে বললো,
– চলবে?
– হু, থ্যাংক্স।
– তোমার কৌতুহল হচ্ছে না? আমি কেনো তোমকে এখানে নিয়ে এসেছি?
– হচ্ছে না বললে ভুল হবে, তবে একটা অনুমান করতে পারছি। বোন তো আমার ও আছে।
– ঐন্দ্রি আমার শুধু বোন নয়, ও আমার কলিজার অংশ৷ আমার আয়ত্তে থাকলে আমি কখনোই এই বিয়েটা হতে দিতাম না। কারণ তুমি ওর যোগ্য নও………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি