স্বপ্নছায়া,পর্ব:৪

0
529

#স্বপ্নছায়া
#৪র্থ_পর্ব

শারমিন বেগম মুখ তুলে তাকাতেই দেখলেন ঐন্দ্রিলা বসার ঘরের কোনায় চুপ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই শারমিন বেগমের মুখে আরোও চিন্তার ঢল নেমে এলো। দিশান ছুটে এসে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরলো। ঐন্দ্রিও তাকে কোলে তুলে শ্বাশুড়ির পাশে গিয়ে বসলো। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– কিছু হয়েছে মা?
– আসলে কিভাবে বলবো বুঝছি না!

কথাটা শুনে ঐন্দ্রিলা শওকত সাহেবের দিকে তাকায়। বেঁচারার মুখখানা ও বেশ শুকনো লাগছে। ঐন্দ্রিলা শারমিন বেগমের হাত ধরে বলে,
– আমি তো আপনার মেয়ের মতো মা, আমাকে নির্দ্বিধায় বলুন।
– তোমাদের বৌভাতের অনুষ্ঠানটি হবে না মা। অভ্রের এসব অনুষ্ঠান এটেন্ড করা একেবারেই পছন্দ নয়। তোমার বাবা ওকে বোঝানোর কম চেষ্টা করেন নি, কিন্তু ও কিছুতেই রাজী হয় নি। আসলে ছেলেটা আমার একটু একরোখা, ও সিদ্ধান্ত বদলানো এতোটা সহজ নয়। লজ্জায় আমাদের মাথা কাঁটা যাচ্ছে, বৌভাতের অনুষ্ঠান সব মেয়েদের প্রাপ্য। তোমাদের বিয়েটা যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেনো! তুমি এ বাড়ির বউ, এটা নিরন্তন সত্য। কিন্তু অভ্র বুঝতেই চাইলো না। মেজাজ খারাপ করে অফিস চলে গেল।

শারমিন বেগম লজ্জিত কন্ঠে কথাটা বললেন। তার অসহায়ত্ব দেখে ঐন্দ্রিলার খারাপ লাগতে শুরু করলো। যতই হোক মানুষটি তার মায়ের মতো। বৌভাতের অনুষ্ঠান নিয়ে এমনেই ঐন্দ্রিলার কোনো মাথাব্যাথা নেই। মানুষের সামনে সং সেজে বসে তাদের সান্তনা শোনার মতো মানসিকতাটা প্রায় শেষের দিকে তার। শারমিন বেগমের হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীর কন্ঠে ঐন্দ্রিলা বলে,

– মা, এই সামান্য ব্যাপারে আপনার মন খারাপ? কারোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়াটা একেবারেই উচিত নয়। সত্যি বলতে মা আমিও চাচ্ছিলাম এই অনুষ্ঠানটা কোনো ভাবে ক্যান্সেল করা যায় কি না! আমার ও এতো অনুষ্ঠানাদি ভালো লাগে না। কি হবে অনুষ্ঠানটি না হলে? বিয়েতে দুটো মানুষের সুখে থাকাটা বেশি জরুরী, এসব অনুষ্ঠান করা বা না করায় কিছুই যায় আসে না মা। আপনি আমাকে ভাববেন না। আমার এই সিদ্ধান্তে কোনো দ্বিমত নেই।

ঐন্দ্রিলার কথা শুনে শারমিন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার বুক থেকে পাথরটা যেনো থেমে গেছে। ঐন্দ্রিলার মাথায় হাততা বুলিয়ে স্নেহমাখা কন্ঠে বললেন,
– আমার ছেলেটার ভাগ্যে আল্লাহ তাআলা একটা হীরার টুকরা মেয়েকে লিখেছেন। আমি সবসময় চাইতাম এমন একটা মেয়ে তার জীবনে আসুক৷ যে তার শক্ত খোলসের ভেতরের হৃদয়টিকে বুঝতে পারবে। যাক গে, তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত করলে ঐন্দ্রিলা৷ চা খাবে তো? আমার মানুষটা খুব চা খেতে ভালোবাসি।
– আপনি বসুন মা, আমি করে আনছি। আমি মানুষটাও চা খেতে বড্ড ভালোবাসি।

ঐন্দ্রিলা দিশানকে শারমিন বেগমের কাছে দিয়ে চা বানাতে চলে গেলো। বরটা যেমন ই হোক না কেনো শ্বশুরবাড়ি নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই। চা বানাতে বানাতে বাবার কথা খুব মনে পড়ছে ঐন্দ্রির। মানুষটার ঔষধ ও তাকেই মনে করিয়ে দেওয়া লাগে৷ মনে না করিয়ে দিলে হয়তো ঔষধটুকু খেতে ভুলে যাবেন। আসার সময় দিশা এবং পিউকে বুঝিয়ে এসেছিলো তবুও মনটা খচখচ করছে তার। তাই দেরি না করে বাবাকে ফোন লাগালো ঐন্দ্রিলা। ফোনটা দু বার বাজার পর তৃতীয় বারে শরীফ সাহেব রিসিভ করলেন। গদগদ স্বরে বললেন,
– বুড়ো ছেলেটার কথা অবশেষে মনে পড়লো আমার মায়ের?
– কি করবো বলো, এতো অবাধ্য ছেলেকে তো একা রেখে আসতে পারি না। কি করো? নাস্তা করেছো?
– হ্যা, নাস্তা করা শেষ, পিউমা ঔষধটা দিয়ে গেছে। খেয়ে এখন বসে বসে বই পড়ছিলাম
– কলেজে যাবে না?
– নারে মা, আজ ভালো লাগছে না। আচ্ছা, কাল আসছিস তো জামাইকে নিয়ে?
– এখনো জানি না বাবা, তবে চেষ্টা করবো।
– ঐন্দ্রি মা
– হুম, বলো।
– তুই খুশি তো এই বিয়েতে?
– খুশি থাকাটা বড্ড আপেক্ষিক বাবা, এটা মানুষের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়৷ এই দেখো না, এ বাড়ির প্রতিটা মানুষ আমাকে এতোটা ভালোবাসে বলার বাহিরে। শুধু ঐ একটা মানুষের সাথেই আমার সম্পর্কটা জমে নি। ব্যাপার না, সময়ের কাছে ছেড়ে দিয়েছি আমি৷ সময়ের সাথে সাথে হয়তো তার মনেও জায়গাটা করে নিতে পারবো।

শরীফ সাহেব চুপ মেরে গেলেন। মেয়ের কন্ঠের সুপ্ত উদাসীনতা তার বুঝতে বাকি রইলো না। নিজেকে খানিকটা অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন তিনি। অবশ্য ছেলেটা তাকে অপরাধী বানিয়েই ফেলেছে। ঐন্দ্রিলা বাবার নীরবতাকে ভাঙ্গার জন্য বললো,
– জানো বাবা, এখন আমি চা বানাচ্ছি৷ আমার শ্বাশুড়ি মা তো আমার মতো, চাখোর। উনার নাকি চা ছাড়া চলে না। এখানে সবাই খুব ভালো বাবা। তুমি চিন্তা করো না। আমি ইনশাআল্লাহ সুখী হবো দেখো।
– ইনশাআল্লাহ।
– থাকো আমি রাখলাম ফোনটা।

ফোনটা কেটে কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকলো ঐন্দ্রিলা। এতো জোর গলায় কথাটা বললো সে, সুখী হওয়া কি এতোটাই সহজ!

৩.
দিশান খেলছে, আর ঐন্দ্রিলা তার সামনে বসে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বাচ্চাটির বয়স তিন বছর দু মাস। আদো আদো ভাষায় কথা বলে। আজ সারাটাদিন ঐন্দ্রিলার সাথেই ছিলো সে। ঐন্দ্রিলা তাকে সুনিপুণ দৃষ্টিতে অবলোকন করেছে, তার চেহারার মাঝে বাঙ্গালী ভাবখানা নেই৷ শুধু চোখটা অভ্রের মতো, ঘোলাটে। এ ব্যাতীত অভ্রের সাথে কোনো মিল নেই বাচ্চাটির। হয়তো বাচ্চাটি অভ্রের নিজের নয়। হয়তো সে বাচ্চাটিকে এডোপ্ট করেছে। কিন্তু একটা কথাও নিশ্চিত হয়। সব কথায় আগে “হয়তো” শব্দটি আছেই। এর মাঝেই আহানার কন্ঠ কানে আসে তার।
– ভাবী আসবো?
– আরে আসো না, এতো ফরমালিটির কিছু নেই।
– দিশানের খাবার পাঠিয়েছিলো মা। ও তো তোমাকে ব্যাতীত কিছুই বুঝে না। তাই এখানেই নিয়ে এলাম।
– দাও আমি ওকে খাওয়িয়ে দিচ্ছি।
– এটা খুব অদ্ভুত জানো তো! কারণ দিশান খুব ইন্ট্রোভার্ট। অথচ সে তোমাকে এতোটা পছন্দ করে। ইভেন ও ভাই আর মা ব্যাতীত তেমন কারোর হাতে খায় অবধি না।
– তোমার ভাই ওকে অনেক ভালোবাসে তাই না?
– প্রচুর। ভাই দিশান বলতে পাগল।
– আহানা, সত্যি করে একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?
– হ্যা বলো ভাবী
– দিশানের সাথে তোমার ভাইয়ের সম্পর্কটা কি? অনেকে বলে ও তোমার ভাইয়ের সন্তান, অনেকে বলে এডোপ্ট করা বেবি। আমি সত্যিটা জানতে চাই।

আহানা প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
– দিশান ভাইয়ের ছেলে নয়। দিশানকে ভাই এডোপ্ট করেছে। ভাইয়া যখন সবেমাত্র বিজনেস এ জয়েন করে তখন আমাদের একটি বাহিরের কোম্পানির সাথে ডিল হয়। সেখান থেকে একটা ক্যাথেলিক মেয়ের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়। তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু মেয়েটা ক্যাথেলিক এবং ভাইয়া মুসলিম হওয়ায় দুই ফ্যামিলি ই সম্পর্কটা মেনে নেয় নি। মেয়েটির নাম ছিলো জ্যানিফার। জ্যানিফার আপুকে তার বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেন। ভাইয়া যখন এই ঘটনা জানতে পারে, প্রচুর ভেঙ্গে পড়ে। ও একেবারে বদলে গিয়েছিলো। তার রাগ, জেদ যেনো দ্বিগুন হয়ে গেলো। এর পর বাবা ভাইকে বাহিরে পাঠিয়ে দেয়। ভাই বাহিরেই ছিলো আড়াই বছর। তারপর একদিন সে জানায় সে দেশে ফিরছে। মা তো খুব খুশি ছিলো সেদিন। কিন্তু ভাইয়া একা ফিরে নি, দিশান ও তার সাথে ছিলো। দিশানের পরিচয় নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে সে জানায় দিশান নাকি জ্যানিফার আপুর ছেলে। বিদেশে যাবার পর জ্যানিফার আপুর সাথে তার আবারো দেখা হয়৷ আপুর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো৷ দিশান তখন খুব ছোট। জ্যানিফার আপুর হেলথ কন্ডিশনটা ভালো ছিলো না। তার লাঙ্গ ক্যান্সার ধরা পড়েছিলো। ভাইয়া অনেক ট্রাই করে যাতে তাকে বাঁচানো যায়৷ কিন্তু সম্ভব হয় না। বাচ্চাটাকে দেখার মতো কোনো মানুষ ছিলো না। জ্যানিফার আপু মারা যাবার পর দিশানকে ভাইয়া এডোপ্ট করে। তারপর ওকে নিয়ে দেশে ফিরে আসে। আমি জানি হয়তো তোমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। নিজের স্বামীর প্রাক্তনের বাচ্চাকে চোখের সামনে দেখতে কারোর ই ভালো লাগবে না। কিন্তু দিশান ভাইয়ার সাথে এতোটা গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে, তুমি চাইলেও তাকে আলাদা করতে পারবে না। কথাগুলো বাবা-মা তোমাকে বলতে পারতো না। কিন্তু এক না এক সময় তো জানতেই পারতে। দিশানের সত্যটা মেনে না নিলে তুমি কখনোই ভাইয়াকে বুঝতে পারবে না।

ঐন্দ্রিলা কথাগুলো শুনছে। সত্যিটা এতোটা তেতো তার জানা ছিলো না। তবে মজার ব্যাপার ঐন্দ্রিলার খারাপ লাগছে না। বরং দিশানের প্রতি মায়া লাগছে৷ হয়তো অভ্র এখনো জ্যানিফার নামক মেয়েটিকে ভালোবাসে। তাইতো তার শেষ স্মৃতিকে আগলে রেখেছে। ঐন্দ্রিলা মুচকি হেসে বললো,
– এই সত্যিটা আমার জানা দরকার ছিলো৷ ধন্যবাদ।

ঐন্দ্রিলার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহানা৷ দিশানের ব্যাপারটা সে এতো সহজভাবে মেনে নিবে এটা আহানা কল্পনা করে নি। আহানার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো৷ সে কোনো ভুল করে নি, সঠিক মানুষকেই সে সত্যটা জানিয়েছে।

রাত ১২টা,
আজ কাজের চাপটা মাত্রাতিরিক্ত ছিলো, তাই বাসায় ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছে অভ্রের। বাড়ির প্রতিটা মানুষ হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন স্পেয়ার কি দিয়েই দরজাটা খুলতে হবে। অভ্র চাবিটা বের করে দরজার কিহোলের কাছে নিতেই দরজাটা খুলে যায়৷ যেনো দরজার ওপারের মানুষটি তার অপেক্ষাতেই ছিলো৷ অবাক চোখে তাকাতেই দেখে ঐন্দ্রিলা দাঁড়িয়ে আছে। নীল শাড়িতে, চুলগুলো খোঁপা করে দাঁড়িয়ে আছে সে। এরুপে মেয়েটাকে মন্দ লাগছে না। ঐন্দ্রিলা নামক মেয়েটা প্রতি মূহুর্তে অভ্রকে চমকে দেবার মতো কাজ করে। অভ্র কল্পনাও করে নি মেয়েটা তার জন্য জেগে থাকবে। অভ্র কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঐন্দ্রিলা বলে,
– আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। গাড়িটা যখন মেইন গেটে ঢুকেছিলো, আমি দেখেছি। ফ্রেস হয়ে নিন খাবার দিচ্ছি।

অভ্র খানিকটা বেকুবের মতো ঐন্দ্রির দিকে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটার প্রতি কৌতুহল তার যেনো বেড়েই যাচ্ছে৷ অভ্রকে দাঁড়িয়েয়া থাকতে দেখে ঐন্দ্রিলা বলল,
– ঘরের বাহিরেই থাকবেন নাকি? আসুন৷

অভ্র ভদ্র বাচ্চার মতো ঐন্দ্রিলাকে অনুসরণ করে ভেতরে গেলো৷ মিনিট বিশেক পর ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলো সে। খাবারের মাঝেই ঐন্দ্রিলা বলে উঠলো,
– কাল আমাদের বাসায় যেতে হবে।
– হ্যা যাও, আমি কি মানা করেছি।
– আমি তো একা যাবো না, আপনি সাথে যাবেন।

কথাটা শোনামাত্র……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here