সোহাগী পর্ব ৭

0
420

#সোহাগী
#পর্ব :৭
Lutful Mehijabin

আমিরুলরা চলে গিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। যাওয়ার আগে আসমা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে গিয়েছেন। আগামী পরশু আমিরুল এবং সোহাগীর আকাদ সম্পূর্ণ হবে। এতো বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সোহানা কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে রাশেদের কোন পাত্তা নেই! মেয়ের বিয়ে অথচ বাবা নেই? উঠানের মধ্যেখানে হাত পা ভাঁজ করে বসে রয়েছে সোহাগী। তার চোখে মুখে অসহায়ত্ব স্পষ্ট! আমেনা সোহাগীর পাশে দু হাঁটুর মাঝে মুখ দিয়ে বসে রয়েছেন। তিনি বিমূঢ়! আসমার শেষাক্তো বানী অর্থাৎ সোহাগী কোনদিনই মা হতে পারবে না বিষয়টা মানতে পারছেন না। কিন্তু সোহানার কর্মে বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নেই। সে যে অক্ষম, সোহানার উপর নির্ভর করে তাকে বাঁচতে হয়। এই বার্ধক্য বয়সে জামাতার অর্থে তার প্রয়োজন মিটাতে হয়। যার দরুন ইচ্ছে থাকলেও সোহানা কে কিছু বলতে পারেন না। যদি সোহানা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। তাহলে! এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠবে! পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ স্বার্থপর। আমেনার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়! তিনি নিজ স্বার্থে প্রতিবাদ না করে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন।

অপরদিকে নিজের কাজে ব্যস্ত সোহানা। বিয়ে বাড়ি বলে কথা, মা হিসেবে তার তো দায়িত্ব কম নয়। আমিরুল দের বিদায় দিয়ে, তৎক্ষণাৎ সোহাগীর হাত থেকে টাকা নিয়ে কোমরে গুঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন। মাত্র ফিরলেন। কোথায় গিয়েছিলেন তা সবার অজানা! উঠানে পা রাখতেই তার প্রাণবন্ত মুখশ্রীতে আঁধার নেমে এলো। সোহাগী এবং আমেনা কে উঠানে মলিন মুখে বসে থাকতে দেখে সোহানার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তিনি দ্রুত সোহাগীর নিকট উবু হয়ে অদ্ভুত কান্ড করে বসেন। আচমকা সোহাগীর খোপা বাধা চুলের গোছা শক্ত করে চেপে ধরেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

— এই ভরা হাজে তুই দুয়ারে জাবর দিয়া বইসা আছিস কেন? শাড়িডা যে নষ্ট হইতেছে সেই খেয়াল আছে তোর?

আকস্মিক আক্রমণে ভরকে উঠলো সোহাগী। ইতোমধ্যে ব্যথার তার চোখ জোড়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মুখ থেকে নির্গত হচ্ছে অস্কুট আর্তনাদ! আমেনা কিছু বুঝে ওঠার আগে উত্তেজিত হয়ে দ্রুত সোহানাকে ছাড়তে চেষ্টা করলেন।

— সোহানা ওরে ছাইড়া দে। ছাড় কইতেছি।

সোহানা আমেনার কথার ভ্রক্ষেপ করলেন না। একই অবস্থায় রইলেন। ক্রোধ মাখা কন্ঠে বলেন,

— চুপ করো আম্মা। তোমার জন্য আইজ মাইয়াডা আমার অবাধ্য হইছে। সরো, আমার কামে বাধা দিয়ো না।

— সোহানা তুই ওরে মারতেছিস কেন? সোহাগী কি করছে!

সোহানা কিছু একটা মনে করে লহমায় সোহাগী কে ছেড়ে দিলেন। আবহাওয়ার ন্যায় তার আচরণের পরিবর্তন ঘটলো। নিমেষেই শক্ত হৃদয় কোমল হয়ে উঠলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রেখে সোহাগীর থুতনিতে হাত রেখে নরম গলায় বলেন,

— উঠ মা। আর কয় দিন ই বা আমার বাড়ি থাকবি! পরশু দিনের পর থাইকা আমার বাড়ির মেজবান হইয়া আইবি। তখন এক দেয়াল সৃষ্টি হইবো আমাগো মাঝে। এই দুই দিন লক্ষি মাইয়া হইয়া থাক না মা। তুই যে শাড়ি নষ্ট করছোস এই শাড়িটা আমার বহুত পছন্দের। এই শাড়ির প্রতি আমার মেলা লোভ। তাই তাড়াতাড়ি উইঠা শাড়ি ছাড়।

সোহাগী নিরবে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। মায়ের কোমল কন্ঠস্বর যে তার খুবই প্রিয়। শত হাহাকার ভরা খরার মধ্যে যেমন এক ফোঁটা বর্ষণ মানুষের প্রাণ শীতল করার মতো ক্ষমতা রাখে ঠিক তেমনি মায়ের মধুর বানী হৃদয়ের উত্তপ্ত খরা শীতল করার মতো শক্তিশালী হয়ে থাকে। সোহাগী বিতৃষ্ণাময় মনে বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল ঠিক করে নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করলো। মুহূর্তেই সোহানার মুখে অসহায়ত্ব চাহনি নিক্ষেপ করলো। মেয়ের চোখের ভাষা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না সোহানার। কিন্তু তিনি সোহাগী কে প্রাধান্য দিলেন না। অতঃপর সোহাগী কাঁপা গলায় বললো,

— আম্মা, আব্বা কোথায় গেছে? কখন আসবে?

সোহানার মেয়ের প্রশ্ন শুনে শুকনো ঢোক গিলেন। জড়তা সম্পূর্ণ কন্ঠে উত্তর দেন।

— তা,, তোর জানা লাগবো না শেমরি। সময় হইলে আইসা পড়বো।

— বলো না আম্মা, আব্বা আসে না কেন? আমার আব্বা কোথায়? তাকে দেখার জন্য আমার বুকটা দাউদাউ করে জলছে যে।

আকুতি ভর কন্ঠে কথাগুলো শেষ করলো সোহাগী। এবার বোধহয় সোহানার খানিকটা মায়া হলো সোহাগীর উপর। তড়িঘড়ি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,

— তোর আব্বা গন্জে গেছে সপ্তা খানিকের জন্যি। আগামী সপ্তায় আইবো। এর আগেই তোরে বিয়া দিবার পারলি বাঁচি।

মুহূর্তেই ডুকরে কেঁদে উঠে সোহাগী। কান্নারত অবস্থা বলে উঠলো,

— আম্মা, আমি বিয়েতে রাজি কিন্তু আব্বা না আসলে আমি বিয়ে করতে পারবো না। দরকার পড়লে আমি পালিয়ে যাবো।

সোহাগীর শেষোক্ত কথার ভিত্তিতে ক্ষেপে গেলেন সোহানা। তৎক্ষণাৎ সোহাগীর কোমল গালের উপর আঘাত হানা দিলো। সোহানা সজোরে থা’প্পড় মা’রেন তার ডান গালে। ব্যথায় কুঁকরে উঠলো সে। আমেনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে!

— বিয়াদপ শেমরি! এমন চিন্তা মাথায় ও আনবি না। এই কথার পরিনতি কইলাম ভালো হইবো না।

কথাগুলো বলে তপ্তশ্বাস ফেলেন সোহানা। অতঃপর পুনরায় বলে উঠেন,

— আম্মা তোমার আদুরের নাতি রে ঘরে নিয়া গিয়া সোহাগ করো। মুখের উপর যে চ্যারাং চ্যারাং কথা বলে শিখছে তোমার নানি এমন হইলে দেখো গিয়া স্বামীর ঘরে টিকে নাকি। আমি আগেই সাবধান করতেছি আমার বাড়িতে কিন্তু সোহাগীর কোন জায়গায় নাই।

তৎক্ষণাৎ উঠান থেকে ঘরে চলে গেলেন সোহানা। সোহাগীর দৃষ্টি মাটিতে পলক হারিয়েছে! আমনা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেন না। স্বার্থ পরের মতো নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন।

__________________

বিকেল গড়িয়ে চারপাশের আঁধার নেমেছে। পশু পাখি আপন নিরে ফিরে যাচ্ছে। গৌধুলির লগ্ন! রাখালরা মাঠে থেকে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। দূর পান্ত থেকে আযানের সমধুর প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে। দোকানদাররা দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছে। সন্ধ্যা বলতে যেন চৌদি ডাংগি গ্রামের সকল কর্মরত মানুষগুলো আপন গন্তব্যে পৌঁছতে দ্রুত পা চালান। সৃষ্টিকর্তার হুকুম পালনে আযানের ডাকে মসজিদের দিকে ধাবিত হয় আদর্শ ব্যক্তিগন। অবশ্য রাত হলেই গ্রামটা সবার জন্য অনিরাপদ বলে মানুষ গুলোর বাড়ি ফেরার তাড়া যেন বড্ড বেশি!

ভুঁইয়া বাড়ির সদর দরজায় সামনে পায়চারি করছে জন চারেক দেহবান শক্তিশালী দ্বাররক্ষী। প্রতিদিন দু জন থাকলেও আজ ব্যতিক্রম! জুবায়ের মাস্টার আজ ভর সন্ধ্যায় প্রিয়াকে পড়াতে এসেছে। সারাদিন স্কুল করিয়ে অবশেষে ভুঁইয়া বাড়ি উপস্থিত হতে পেরেছে সে। কিন্তু চারপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অজানা আতঙ্কে তার ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রিয়ার কথাগুলো যদি সত্যি হয়! সত্যিই কী তাদের আজ শেষ দেখা? রিমাই বা কোথায়? সে কী বেঁচে নেই এই ধরণীর বুকে!

দারোয়ান গুলো আজ বেশ কঠোর হয়ে পায়চারি করছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে দু জন ব্যক্তি কে জুবায়ের প্রতিদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা আজ নেই! ইতোমধ্যে জুবায়ের কে দু প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে লক্ষ্য করে দারোয়ান গুলো নিজেদের মধ্যে কানঘুষা করলেন। মিনিট পাঁচেক পর একজন হাতে লাঠি নিয়ে জুবায়েরের সামনে এলেন। আকস্মিক প্রগাঢ় ঝাঝালো কন্ঠে বললো,

— কে আপনি?

হঠাৎ লোকটার আগমনে সামান্য ভরকে গেলো জুবায়ের। এভাবে লোকটা এসে পড়বে তা সে কল্পনা ও করে নি।

জুবায়ের কিছু বলতে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করার পূর্বেই লোকটা বলে উঠে,

— আপনি মাস্টার মশাই তাই তো?

জুবায়ের নির্ভীক থেকে এক গাল হেসে জবাব দিলো।

— হ্যাঁ, কিন্তু আপনি চিনলেন কীভাবে?

— আপনি যে ল্যংড়া বড় সাহেবের কাছে থেকে শুনেছি। যাইহোক এভাবে চোরের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে প্রবেশ করুন। বড়ো সাহেব আপনাকে সোজা দালান ঘরে ঢুকতে বলেছেন। অন্য দিকে পা বাড়ানো নিষেধ। যান।

লোকটার শুদ্ধ ভাষা শুনে খানিকটা আবাক হলো জুবায়ের। অতঃপর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। এখন কথা বাড়ানো মানেই বোকামি বৈকি অন্য কিছুই নয়!

অন্দরমহলের ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকে উঠলো জুবায়ের। সম্পূর্ণ বাড়ি জুড়ে শুলশান নিরবতা। প্রতিদিন চারপাশ আলোকিত থাকলেও আজ আঁধারে আচ্ছন্ন! বাড়িতে মানুষ জন নেই নাকি! কোথায় গিয়েছে সবাই? জুবায়ের কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই সম্পূর্ণ অন্দরমহল ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুব দিলো। অর্থাৎ বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। গা ছিমছাম মুহূর্ত। অন্ধকারে হাঁটতে পারছে না জুবায়ের। তাকে বিস্মিত করে, অদ্ভুত কান্ড কারখানা ঘটতে আরম্ভ করলো। যা স্বাভাবিক বলে মনে হলো না তার নিকট! আচমকা একধরনের বিকট শব্দ শুনতে পেলো সে! মুহূর্তেই জুবায়েরের সর্বাঙ্গের লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠলো। সামনে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তার লক্ষ্য হলো একটা হ্যারিকেন হলদেটে আলো তার নিকট এগিয়ে আসছে। সবকিছু মিলিয়ে যেন ভুতুরে পরিবেশ!

(চলবে)
[কাল থেকে রেগুলার পোস্ট করবো। রিচের দেয়নি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here