#সোহাগী
#পর্ব :৫
Lutful_Mehijabin
জুবায়ের আর এক মুহূর্তও নষ্ট করলো না। দ্রুত মায়ের কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। সে আর পারছে না বুকের ভেতর পাথর চেপে বেড়াতে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে একদমই পারছে না। তাই নিজেকে সংযত রাখতে মায়ের কাছে ক্রন্দন রত কন্ঠে বলে উঠলো,
— মা গো আমি যে বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেয়ার চেষ্টা করছি। আমি তো জানি আমি কখনোই চাঁদ ধরতে পারবো না তাও অযথা কেন স্বপ্ন বুনছি, বলো না মা?
জুবায়েরের কথা শুনে সালেহার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে। শুকনো ঢোক গিলেন তিনি। আনমনে ছেলের মাথায় হাতড়িয়ে দিতে লাগলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,
— তুই কোন চাঁদে হাত দেবার চেষ্টা করছিস?
সালেহার প্রত্যুত্তরে জুবায়ের শক্ত কন্ঠে ঝটপট বললো,
— ভুঁইয়া বাড়ির ছোট মেয়ে, ওই চাঁদ যে জোছনা রাতে আকাশের বুকে ঝুলে থাকা চাঁদের চেয়েও অধিক আকর্ষণীয়। আমি যে কঠিন ভাবে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি।
ছেলের কথার প্রেক্ষিতে সালেহা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। জুবায়েরের চুলের ভেতর তার হাত স্থির হয়ে এসেছে। বুকের ভেতরটা ঝড় রাত্রির উত্তাল উদ্যম সমুদ্রের ন্যায় অশান্ত হয়ে উঠেছে। সত্যিই তার ছেলে যে বামুন হয়ে চাঁদ ধরার প্রয়াস চালাচ্ছে! জুবায়ের তার চোখ জোড়া বন্ধ করে ফির বলে উঠলো,
— জানো মা চাঁদটা আজ আমার মতো ল্যাংড়া, কালো ছেলের জন্য চোখের জল বিসর্জন দিয়েছে, নিজের সৌন্দর্য কে কম বলে গন্য করেছে। আমার কে খোলসা করে বলেছে তাকে যেন আমি নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখি। সে যে এই বামুনের সঙ্গে সারাজীবন ঘর সংসার করার স্বপ্ন বুনছে!
কথাগুলো শুনে সালেহা অবাক চরমে পৌঁছে গেলেন। কাপড়ের আঁচল দাঁত দ্বারা চেপে ধরলেন। বিষ্ময়কর চোখে ছেলের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন! অতঃপর নিম্ন স্বরে বলেন,
— কী বলিস রে বাজান! আমার বিশ্বাস হইতেছে না। ভুঁইয়া বাড়ির মাইয়া আমার ছাওয়ালের লগে সারাজীবন পার করতে চাই? আমার এই পাখির বাসায় সংসার পাততে চাই?
সালেহার কথার প্রত্যুত্তরে জুবায়ের ছোট করে উত্তর দিলো,
— হু।
সালেহা কিছুক্ষণ ছেলের মুখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটার চোখের কোণে দুর্বোধ্য রহস্য এসে পাড়ি জমিয়েছে। তা মোটেও সহ্য করতে পারছেন না সালেহা। জমিদার বাড়ির মেয়ে থেকে এমন প্রস্তাব তার নিকট বিষ্ময়কর! তাদের মতো ছোট ঘরে নিশ্চয়ই জমিদার তার মেয়েকে দিবেন না! তার চেয়ে বড় কথা তাদের মতো নিচু জাতের মানুষের স্বপ্নেও জমিদার বাড়ির মেয়ের দিকে চোখ দেওয়া পাপ। বর্তমানে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে সালেহার। তার ছেলে যে ওই চাঁদের প্রতি ভীষণ দুর্বল! এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে অসহায় মনে করা বেশ স্বভাবিক। সালেহা নিজেকে ধাতস্থ রাখলো। শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
— তুমি কি চাও জুবায়ের? চাঁদ টা নিজের করে নিতে নাকি চাঁদের জীবন থেকে চিরতরে বিচ্ছেদ নিতে?
নিমিষেই জুবায়েরের হৃদয়মনে অদ্ভুত প্রশান্তি বয়ে গেলো। সাহসের জোয়ার বইছে বুকের ভেতর। তৎক্ষণাৎ মায়ের কোল থেকে উঠে পড়লো জুবায়ের। ব্যথাতুর মুচকি হাসির সহিত বললো,
— যা চাই তা কী সম্ভব মা? কিন্তু আমি যে তিলে তিলে শেষ হতে চাই না।
জুবায়ের বলা বাক্যটা শুনে সালেহা ক্রন্দন রত কন্ঠে বলেন,
— তুই আমাকে ওই মেয়েটার কথা আগে কেন বললি না? তুই এমন মনমরা হয়ে থাকিস না বাজান। তুই যদি চাস তাইলে আমি যাব তোর কাকীরে নিয়া ভুঁইয়া বাড়িতে। তোর চাঁদ যেহেতু স্বয়ং রাজি তাইলে কোন চিন্তার বিষয় নাই। আমি যাব ওই বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়া। তোর মতো শিক্ষিত ছেলে কে ভুঁইয়া ফিরাইতে পারবো না আমার মনে হয়।
মুহুর্তেই পুলকিত হৃদয় নিয়ে সালেহাকে জড়িয়ে ধরলো জুবায়ের। সালেহার কাঁধে মাথা এলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
— মা, আমার চাঁদ যে অনেক ছোট। এ বয়সে সংসার করবে কি করে!
জুবায়ের মা ছেলের কথা প্রেক্ষিতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। মুহূর্তেই তার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুচকি হেসে তিনি বলে উঠেন,
— ওই নিয়ে চিন্তা করতে হইবো না তোকে। তোরা শুধু সুখী থাক এই প্রার্থনা করি খোদার দোয়ারে। আপাতত তোদের আকাদ সাইরা রাখুম। তারপর বউ মা যখন একটু বড় হইবো তখন ওরে ঘরে তুইলা আনবো।
জুবায়ের মায়ের কাঁধে মাথা রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,
— মা গো, আমার যে মনে হচ্ছে তারা আমাদের ফিরিয়ে দিবে।
সালেহা উত্তেজিত হয়ে বলেন,
— কেন?
— কারন তুমিই বলো মা কোন বাবা মা চাই তার সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে কে পা ভাঙা প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে? আমাদের মতো গরীব ঘরে মেয়ে কে তুলে দিতে কোন বাবা রাজি হবে! তাছাড়া চাঁদ যে আমাদের এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না। খুবই কষ্ট হবে তার। মা গো আমার না ভীষণ ভয় হচ্ছে? বলো না মা, আমি পাবো তো আমার চাঁদ টা কে? কেন মা, সৃষ্টিকর্তা কেন বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন পুষে দিলো আমার বুকের ভেতর!
নিমিষেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন সালেহা। জুবায়েরের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। অতঃপর কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন,
— সৃষ্টিকর্তা যা করেন তা আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। তুই আল্লাহ উপর ভরসা রাখ। কিছু হইবো না। ভুঁইয়া বাড়ির হগলে অনেক ভালো মনের মানুষ। তারা নিশ্চয়ই বুয়েটের পড়া একজন ছাত্রের চেহারা না দেখে যোগ্যতা আর চরিত্রে টা দেখবেন। আর আমার ছাওয়াল যে যোগ্যতা এবং স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী তা আমার আর মুখ ফুইটা বলা লাগবো না!
____________________________
রাত পেরিয়ে দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে চারপাশ। মাথার উপর স্কুল ব্যাগ নিয়ে বাড়ির পথে পা চালিয়ে যাচ্ছে সোহাগী। স্কুল ছুটি দিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। গরমে হাঁফিয়ে উঠেছে সে। সূর্যের তীর্যক কিরণ সোহাগীর গা উত্তপ্ত করে তুলেছে। যার দরুন বড্ড দ্রুত পদে হাঁটছে সে। রাশেদ আর তামিম তার পিছু পিছু হাঁটছে। কিন্তু ইচ্ছে করেই তাদের অবহেলা করে যাচ্ছে সোহাগী। আজ স্কুলে ও কথা বলে নি তাদের সঙ্গে। সারাদিন বিষন্ন হয়ে বসে ছিলো মেয়েটা। তার চোখ মুখ যে ফুলে গিয়েছে তা তার বন্ধুদের চোখের আড়াল হয় নি। তাই সোহাগীর মন ভালো করতে কেন মেয়েটা উদাসীন হয়ে রয়েছে তা জানতে তার পিছু নিয়েছে রফিক এবং তামিম।
— কীরে সোহা কথা কইতেছিস না কেন? আজ তোর কি হইলো রে!
রফিকের কথা শুনে একবার আড় চোখে পিছু তাকালো সোহাগী। তামিম আর রফিক তার পিছু নিয়েছে! সোহাগী জবাব দেওয়ার পূর্বে তামিম বললো,
— ওই ছেমড়ি ঢং করতেছিস কেন? আমারা কী করছি? কাল কে তোরে নিয়া নদীর পাড়ে যাই নি দেইখা কি রাগছাস? রাগিস না সোহা। চল আজকে যাই।
তামিমের কথাগুলো সোহাগীর কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই ছুটে দৌড় দিলো সোহাগী। দু হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগলো। দৌড়ে বাড়িতে যাওয়ার পথে বললো,
— তোরা আমার পিছে আসবি না বললাম। আমি তোদের উপর রাগ করি নি। তোরা আমাকে বিরক্ত করবি না প্লিজ।
সোহাগীর কথার প্রেক্ষিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো রফিক এবং তামিম। তারা দুজনে বাকরুদ্ধ! সোহাগীর এমন আচরণ মোটেও প্রত্যাশা করে নি তারা।
—
বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই সোহাগীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। তার বিন্দু পরিমান ইচ্ছে নেই বাড়িতে প্রবেশ করার। কিন্তু তাও বাধ্য হয়ে পা বাড়ালো। ভেতর প্রবেশ করতেই চমকে উঠে সোহাগী। তাদের পুরো বাড়ি জুড়ে পোলাও এবং মুরগির মাংস কোষানোর সু ঘ্রাণে মম করছে! আজ কতোদিন পর এই সুমিষ্টি ঘ্রাণের সাথে পরিচিত হলো সে। বিষয়টা মোটেও সুবিধা জনক লাগলো না তার! শুকনো ঢোক গিললো। অতঃপর ব্যাগ কাধে নিয়ে কলপাড়ারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। মুহূর্তেই হুট করে কোথা থেকে যেন আমিনা এসে উপস্থিত হলেন। সোহাগীর কাধে থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বললেন,
— যা তো সোনা, একবারে গোসল সাইরা আই। সাবান মাইখা গোসল করবি কইলাম। শরীরের কী অবস্থা করছিস দেখছাস একবার! বেশি করে মুখ ডলবি কিন্তু।
আমেনার কথা ভাব ভঙ্গি অপরিচিত লাগে সোহাগীর নিকট। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে স্বল্প আওয়াজে সোহাগী বললো,
— কেনো নানী?
আমেনা খুশী মনে প্রত্যুত্তর দিলেন,
— তোরে আজ নতুন শাড়ি দিয়া সাজামু তাই। এহন যা তো গোসলে যা।
অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠলো সোহাগী কাঁপা গলায় বললো,
— শাড়ি পড়াবো কেনো নানী?
— তোরে ভুঁইয়া বাড়ি থাইকা দেখবার আইবো আজ।
আমেনার কথা শেষ হতেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো সোহাগী। আজ তার সঙ্গে কি হতে চলছে বিষয়টা ভালো করে অবগত আছে। ভীষণ অস্থির লাগছে সোহাগীর। না, কখনোই তার বাবা তাকে বিয়ে দিবে না। বাবাতো কাল রাতেই বলেছে তার মা হাজার চাপ প্রয়োগ করুক তবুও তাকে বিয়ে দিবে না। দেখতে আসছে তো কী হয়েছে! তার তো অনেক দূর পড়তে হবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। বাবার কথাগুলো তার কানে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো। সোহাগী কাঁপা কন্ঠে আমেনাকে জিজ্ঞাসা করলো,
— আব্বা কোথায় নানী?
(চলবে)