সে ৪.

0
1636

সে ৪.
#লেখনী_সাইমা_ইসলাম_প্রীতি

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মৌনতা। সারাদিনের ক্লান্তি শরীরে জেঁকে বসেছে। নিশাচরদের ডাক জানান দিচ্ছে রাত এখন বড্ড গভীর। ঘড়ির কাঁটা হয়তো দুইয়ের ঘরে স্থির। ঘুমের মাঝেই কেমন অস্বস্তি বোধ হয় মৌনতার। মনে হচ্ছে তার খুব কাছে বসে কেউ তাকে খুব গভীরভাবে দেখছে। মৌনতার ঘন কালো চুলে হালকা হাতে স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। ভ্রুঁ সামান্য কুঁচকে আসে মৌনতার। চেহারার ভাঁজগুলো আরো সূক্ষ্ম হয়। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে হঠাৎই উঠে বসে মৌনতা। ঘরটা অতিরিক্ত ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। মৌনতার হাঁড়ে হাঁড়ে কাঁপুনি ধরে যায়। ঠান্ডায় নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়ে সামনের চেয়ারে তাকিয়ে একটা আবছা অবয়ব দেখতে পায়। অবয়বটা তার দিকেই দেখছে। মৌনতার শরীর অবশ হয়ে আসে। ছাদে কেউ সে ছাড়া। এই অবয়ব তাকে আক্রমণ করে বসলে বাঁচাবার ও কেউ নেই। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মৌনতা নড়াচড়া করে না। শুধু বিছানা হাতড়ে নিজের মোবাইলটা খুঁজে আর সেই কালো মানুষ দেহি জিনিসটার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকে। অতিরিক্ত ভয় পেলে মৌনতার এমনটা হয়। নড়াচড়া সব বন্ধ হয়ে যায়। অনেকক্ষণ হাতড়েও মোবাইল খুঁজে পাওয়া যায় না। এবার মৌনতার কান্না পায়।

হঠাৎই যেন অবয়বটার চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। সেই সোনালী চোখজোড়া! তাহলে এই কি ‘সে’! মৌনতার মনে কেন যেন একটু সাহসের সঞ্চার হয়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘ কি চাই আপনার? কে আপনি? আমার বাড়িতে কি করে এসেছে? ‘

অবয়বটার কোন প্রকার হেলদুল দেখা যায় না। এখন একটু আলো পেলে হয়তো মৌনতা তাকে ভালো করে দেখতে পারতো। কিন্তু ঘরটাতে আঁধারের ছড়াছড়ি। বৃষ্টি হয়তো থেমেছে। আকাশে মেঘলা। মৌনতার চুল গুলো হঠাৎ জানালা দিয়ে ধেয়ে আসা এক ছটাক বাতাসে সাঁ সাঁ শব্দ তুলে উড়তে থাকে। মেয়েটার কপালে ,নাকের পাশে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মায়াময়ী দেখাচ্ছে। মৌনতা একবার চোখের পলক ফেলে চোখ খুলতেই অবয়বটা একদম ওর কাছে চলে আসে। ভড়কে উঠে মেয়েটা। হাঁটু মুড়ে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে। চোখ বুঁজে মুখ কুঁচকে রুদ্ধশ্বাস বলে চলেছে,

‘ প্লিজ আমাকে কিছু করবেন না। আমি আপনার কোন ক্ষতি করিনি। আমাকে কিছু করবেন না। আপনি আমার বাড়িতে থেকে আমাকেই বিব্রত করতে পারেন না। ‘

অনেকটা সময় মৌনতা গুটিসুটি মেরে থেকেও কারো স্পর্শ বা কিছু উপলব্ধি করতে পারে না। চোখ খুলে টিপটিপ করে তাকাতেই সচকিত হয় মৌনতা‌। সুদর্শন এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। পড়নে গাঢ় কালো হুডি। চোখ দুটো সোনালী। কেমন অদ্ভুত চাহনি দিয়ে সে দেখছে মৌনতাকে! মৌনতার শ্বাস প্রশ্বাস আরো দ্রুত হয়ে যায়। নিজেকে কোনো রকম ধাতস্থ করার চেষ্টা করে বলে,

‘ আ-আপনি কে? ‘

‘ তোমাকে আমি নিষেধ করেছিলাম আমার ঘরে আসতে? ‘

‘ আপনার ঘর কি করে হলো এটা! ‘

ছেলেটা মৌনতার কথায় যথেষ্ট রেগে গিয়ে মৌনতার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। যৌনতার মনে হচ্ছে গলিত লোহা ঢেলে দিয়েছে তার হাতে। ভীষণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৌনতা চেঁচিয়ে বলে,

‘ আপনি কে? কোন মানুষ নন‌‌! আমার লাগছে ছাড়ুন আমার হাত‌। আপনার শরীরের তাপমাত্রা এতো বেশি কি করে? আহ! জ্বলে যাচ্ছে ‌। ‘

ছেলেটা মৌনতার হাত ছাড়ে না। মৌনতা এবার কান্না করতে শুরু করে। ছেলেটার ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত এক হাঁসির ঝলকানি দেখে মৌনতার কান্নার বেগ বাড়ে। ব্যাথায় কঁকিয়ে চোখ বুঁজে রাখে সে। তখনই হঠাৎ বাহির থেকে পূর্ণির গলা শোনা যায়। মৌনতাকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে এসেছে। মৌনতা এবার যেন মনে বল ফিরে পায়‌। চোখ খুলে সামনে থাকা ছেলেটাকে কিছু বলতে নিয়ে দেখে সামনে কেউই নেই। হাত বাড়িয়ে একাকী বসে আছে মৌনতা। অবাক হয়ে দ্রুত নিজের হাতের দিকে খেয়াল করে দেখে সেখানে কোনো আঘাত কিংবা পোড়া চিহ্ন ও নেই। এটা কি করে সম্ভব! একটু আগেই তার চেপে ধরেছিল সোনালী চোখা সে! পূর্ণি চিলেকোঠার ঘরে চলে এসেছে ততক্ষণে। মৌনতাকে বেশ কটমটিয়ে বলে,

‘ এই বেয়াদব মেয়ে, তুই এই মাঝরাতে একা একা এখানে চলে আসলি! সাহস তো দেখি তোর মাত্রা ছাড়িয়েছে। ঘরটাতে কি ঠান্ডা! তোর মনে কি ডরভয় কিচ্ছু নাই? ‘

মৌনতা কিছু বলে না। একটু আগে কি হয়ে গেল তাই বুঝার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সে স্বপ্ন তো দেখছিল না। তাহলে কল্পনা? মৌনতাকে ঠাঁয় বসে থাকতে দেখে পূর্ণি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে হাত টেনে ধরলো মৌনতার। তেড়া তেড়া গলায় বললো,

‘ চল, আর যদি এমন কাজ করতে দেখছি না? আঙ্কেলরে ডাইরেক্ট বলে দিব তোর কান্ড। ‘

মৌনতা ও চুপচাপ উঠে আসে। ছাদ থেকে চলে আসার সময় চিলেকোঠার ঘরের জানালার গ্রীল ভেদ করে দেখতে পায় সেই ছেলেটা। তার দিকেই তাকিয়ে বসে আছে। মৌনতা নির্বাক হয়ে রয়।

সেদিন রাতে আর ঘুম হয়নি মৌনতার। পুরো রাত জুড়ে কারো চলাফেরার শব্দ শুনেছে‌। ভোর রাতের দিকে কে যেন গিটারে টুং টাং শব্দ তুলে গানও গেয়েছে। কিন্তু ফজরের আযানের পর আর কোন শব্দ পায়নি মৌনতা। সকাল হয়ে না হতেই ঘুমে তলিয়ে পরে সে। ধীরে ধীরে নেমে আসে শরীর কাঁপানো জ্বর। গ্রাম-বাংলায় একটা কথা আছে , অশীরীরীর ছোঁয়া লাগলে নাকি জ্বর আসে!

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here