সে ৩.

0
1287

সে ৩.
#লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

‘ আমার ধারে কাছে ঘেঁষতে যেয়ো না। থামো এবার। খুব হিংস্র আমি ।’

সামান্য একটা কথাকে ভয় পাচ্ছে মৌনতা! তাও আদতে সেটা মনের কল্পনা নাকি বাস্তবেই ঘটেছে জানা নেই তার। তবে সেই সোনালী চোখজোড়া? ভয়ংকর ছিল প্রচন্ড। সাথে কি যেন একটা ছিল সে চোখ জুড়ে, ভুলতে পারছেনা সে। মৌনতা জোর করে নিজের মনকে বুঝাতে চেষ্টা করে সেটা কেবলই একটা হিলোসিনেশন। কিন্তু ভয় হয়।

কিছুক্ষণ বাদে কাজের মেয়ে আসলে তাকে আর পূর্ণিকে নিয়ে আবার আসে চিলেকোঠার ঘরটাতে। ময়না চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘ আপা এনে আইলেন কেন? স্যার তো কইছিল আমারে ছাদে না আইতে। ‘

মৌনতার বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আসে। এই মেয়ের সবকিছুতেই অতি আগ্রহ একদম ভালো লাগে না তার। একরাশ বিরক্তি নিয়েই সে বলে,

‘ আসতে না করেছে ছাদে অনেক গাছ আছে তাই। যাতে সেগুলোতে কেউ হাত না দেয়। শোনো আজ এই ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করবে। এটাই তোমার কাজ। নিচের ঘরের কোনো কাজ করতে হবে না। ‘

ময়না তার কাজে লেগে যায়। মৌনতা আর পূর্ণিও সাহায্য করে। চৌকি পরিষ্কার করে ময়লা তোশক ধুয়ে ছাদে শুকাতে দেয়, ভাঙ্গা চেয়ার জিনিসপত্র ফেলে নতুন আসবাবপত্র রাখা‌ হয়। বেলা দেয়া হয় কর্ণারের পুরোনো চুলা, আধ ভাঙ্গা হাঁড়িপাতিল। রাখা হয় সৌখিন কিছু ফ্লাওয়ার ভাস। টেবিলের ইঞ্জিনিয়ারিং বইগুলো সব পরিষ্কার করা হয়। কাজ শেষে ময়না চলে গেলে নিচে চলে আসে পূর্ণি। মৌনতা একাকী বসে থাকে চিলেকোঠার ঘরে। একদম নতুন রূপ পেয়ে ঝকঝক করছে ঘরটা। ঘরের দক্ষিণা জানালা খুলে তার সামনে বসে মৌনতা। জানালাটা বাড়ির পেছনের দিকে। ঘন গাছপালা ঘেরা স্থানটা রহস্যময় সুন্দর। মৌনতা কিছু সময় সেখানে চুপচাপ বসেই কাটিয়ে দেয়। অস্বাভাবিক কিছুই লক্ষ্য করেনা। একটু আগের ঘটনাটাকে নিছকই মনের ভ্রান্তি ভেবে নেয়। সন্ধ্যা নামতেই পূর্ণি এসে আরেক দফা ডাকাডাকি করে যায়। মৌনতা এবার নিচে নেমে আসে। দুপুরে খাওয়া হয়নি মনেই ছিলনা একবারে জন্য। পূর্ণি ডিম ভাজি আর আলু ভর্তা করেছে, সঙ্গে ধোঁয়া ওঠানো সাদা চাউলের ভাত। মেয়েটা কাজে বেশ চটপটে, রাঁধে ভালো। মৌনতা পেট ভরে খেয়ে নেয়‌। পূর্ণি আবার ব্যস্ত হয়ে পরে এসাইনমেন্ট নিয়ে। মৌনতার বিরক্ত লাগে সবকিছু।

চুপচাপ এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। গ্রীলের ফাঁকে প্রকৃতি দেখার মজা আলাদা। লাল-বেগুনী আকাশ খন্ডে খন্ডে ভাগ হয়ে যায়। পাখিরা তাড়াহুড়ো করে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের ছোট্ট ঘরে। সবাই ব্যস্ত কেবল মৌন ছাড়া। তার মনে বিশাল জটলা পেকে আছে। অনেকটা রহস্য যেন তাকে ঘিরে রেখেছে। সমাধানও আছে হয়তো।

মৌন ভাবনার মাঝেই হঠাৎ থমকে যায়। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কোমর সমান লম্বা খোলা চুলগুলোতে কেউ হাত বুলাচ্ছে। কে, পূর্ণি? পূর্তির তো চুল একদম ভালো লাগে না। সে কখনোই মৌনতার চুলে হাত দেয়নি আজ অবধি। তবে কে? মৌন ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে নিলেই হঠাৎ কেউ সজোরে তার ঘাড় চেপে ধরে। মুখ বারান্দার লোহার গ্রীলের সাথে ল্যাপ্টে থাকে। ব্যাথায় কঁকিয়ে ‘ আহ ‘ করে চিৎকার করে উঠে মৌনতা। কিন্তু তার গলা দিয়ে যেন কথা বের হতে চায়না। ঘাড়ে যেখানে ধরেছে জায়গাটা যেন জ্বলে যাচ্ছে। যে ধরেছে তার হৃদয় খুব বেশিই পাষাণ। মৌনতা আবার সেদিনের কন্ঠটা উপলব্ধি করে। ফিসফিসিয়ে গলা!

‘ তোমাকে আমি শেষ করে ফেলতে চাইছিল না। ছেড়েও দিব না। মুহূর্তেই ছুঁড়ে ফেলতে পারি অগ্নিকুণ্ডে। ভষ্ম করে দিতে পারি চোখের পলকে। বাচ্চা মেয়ে। এতো উৎসাহ ভালো নয়! এর পর আর সুযোগ দেব না। ‘

মৌনতা কিছু বলতে চায়। কিন্তু এতো জোরে চেপে ধরেছে তাকে যে মুখ নাড়াতে পারে না। ভয় আর ব্যাথায় চোখ বুজে ফেলে সে। চোখ ছাপিয়ে টপটপ করে পড়ে অজস্র অশ্রু কণারা। অবাধ্য হয়ে গেছে তারা। কিছুক্ষণ বাদে মৌনতা কাঁধের কাছটা হালকা অনুভব করে। ব্যাথা ভয় সংশয় সব ভুলে গিয়ে দ্রুত পেছন তাকাতেই বারান্দার দরজার পাশে একটা কাঁচের জগ ফেলে ভেঙ্গে ফেলে কেউ। ঝনঝন শব্দ তুলে টুকরো টুকরো হয়ে পরে থাকে কাচগুলো। মৌনতা দ্রুত আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। অজান্তেই হাত চলে যায় কাঁধে। কাঁধ হাত দিতেই আবার ব্যাথা পায় সে। দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। পূর্ণি ততক্ষণে দৌড়ে চলে এসেছে সেখানে। নিচে ভাঙ্গা জগটাকে দেখে মুখ কুঁচকে ছোট করে বলে,

‘ তুই ভেঙেছিস? ‘

মৌনতা কোন উত্তর দেয়না। পূর্ণি একা একাই বকবক করতে থাকে। মৌন‌ চুপচাপ পূর্ণির পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে গিয়ে ভালো করে দেখে নিজের কাঁধ-গলা। গাঢ় লাল ছাপ পড়ে আছে সেখানে। মৌনতা চমকে উঠে আরো ভালো করে দেখে। সত্যিই সেখানে হাতের স্পষ্ট দাগ বসে গিয়েছে। মৌনতার ঠোঁট সামান্য বিস্তৃত হয়। তার মানে তার ভাবনাগুলো মিথ্যে নয়! সত্যিই এই বাড়িতে, সেই চিলেকোঠার ঘরে অস্বাভাবিক কারো অস্তিত্ব আছে! খুশিতে মন বাকবাকুম করে মৌনতার। ছোট থেকেই হনটেড জিনিসের প্রতি তার অন্যরকম আকর্ষণ। কিন্তু মি. সৌকত তার মেয়েকে এসব থেকে দূরে রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে এখন যদি নিজ বাড়িতেই ভৌতিক এক্সপেরিয়েন্স হয়ে যায় তবে মন্দ কি! মৌনতা খুব ভয় নিয়েই ঠিক করে আজ রাতে সে চিলেকোঠার ঘরটাতে যাবে। একবারে জন্য হলেও তাকে যেতে হবে।

চিন্তা-ভাবনায় তলিয়ে থেকে কোনরকম এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করে মৌনতা। রাত হতেই আকাশ ছেয়ে আসে কুচকুচে কালো নীরদে। কাল মুহূর্ত ঋতু ভুলে গিয়ে হেমন্তে নামে ঝুম বৃষ্টি। খনে খনে বিদ্যুৎ চমকায়। ঝলকে উঠে আকাশ। শীতল পরিবেশে পূর্ণি ঘুমিয়ে ডাল হয়ে গিয়েছে। মৌনতার মন অস্থির হয়ে থাকে কখন যাবে চিলেকোঠায়!

চলবে.

পর্ব ২
https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3128973360664728/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here