#সেই_তমসায়_১৫
নুসরাত জাহান লিজা
এহতেশাম সাহেবের এমন হিমশীতল ব্যক্তিত্বের কাছে তার সন্তানরা ভীষণভাবে ম্রিয়মাণ। সারাজীবন একটা ভয় আর কুণ্ঠা নিয়ে তারা বেড়ে ওঠেছে। সেজন্য বাইরে যতই ঠাঁটবাট বজায় রাখার চেষ্টা চলুক, ভেতরে ভেতরে তারা ফাঁপা আর অন্তঃসারশূন্য। দুই ভাইয়ের তুলনায় মুনিরা কিছুটা ব্যতিক্রম।
তাদের পরিবারের এতসব গোপনীয়তা বাইরের লোকজন জেনে যাক এটা কেউই চায়নি। এসব নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা এদের কারোরই নেই। কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে এলে সেই সাপ তাদেরকেও ছোবল দিতে পারে এই শঙ্কা তাদের মধ্যে ছিল। মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে তাদের ক্ষতি নেই, বরং নির্বিঘ্নে কাঙ্ক্ষিত জিনিস হাতে এসে যাচ্ছে। এটাই বা কম কী!
সব চাপা পড়েই যাচ্ছিল, কিন্তু বিপত্তি বাঁধল উইল। সেটার অনুসন্ধানে আগমন হয় প্রাইভেট ডিটেকটিভ ময়ূখ এহসানের। সে যে এমন নাছোড়বান্দা মানুষ এবং যে কাজে এসেছে তার বাইরেও নাক গলাবে এটা সাঈদ বুঝতে পারেনি।
ময়ূখ একটা জিনিস আবিষ্কার করেছে, এই বাড়ির মানুষগুলোর মধ্যে কপটতা বিরাজ করছে। যা না, তাই দেখানোর চেষ্টা, যা আছে তা লুকোনোর প্রবণতা এদের মধ্যে প্রকট।
বেড়ে উঠার সময়টায় চোখের সামনে মাকে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা পেতে দেখলে কিংবা নিজেরা প্রাপ্য স্নেহ ভালোবাসাটুকু না পেলে সেই সন্তানরা আদৌ মেরুদণ্ড সোজা করে কোনোদিন দাঁড়াতে পারে কি? ভাবল ময়ূখ। এমন সন্তানরা যদি নিজের স্বার্থটুকুই দেখে আসে শুধু, তবুও এর দায় পুরোটাই কি তাদেরই! হয়তো নয়।
ময়ূখের আক্ষেপ ওর একটা পরিবার নেই বলে ভালো একটা পরিবার আসলে। এমন পরিবারকে সে পরিবার ভাবতেই চায় না। পরিবার মানে সে বোঝে যেখানে এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা থাকে প্রত্যেকে, একজনের আনন্দে অন্যরা হাসে, একজনের কষ্ট সবাই ভাগাভাগি করে নেয়। একসাথে হাসে, একসাথে কাঁদে, একসাথেই এগিয়ে যায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে! কেউ কাউকে ল্যাং মেরে মাড়িয়ে যাবার কথা ভাবে না! অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো ময়ূখের বুক বেয়ে।
আজ আরেকবার এহতেশাম সাহেবের জানালার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। শুনেছে সেদিন এবং তার আগের দিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য যেদিন লাশ পাওয়া যায় সেদিন থেকে বৃষ্টি হয়নি কয়েকদিন। যেহেতু মাসের বেশি পেরিয়ে গেছে, তাই যা খুঁজতে চাইছে তা হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রথম কাঁদা মাখা বৃষ্টি আর তারপর কাঠফাটা রোদ, তাতেই কিছুটা আশার আলো দেখল।
প্রথমে তেমন কিছুই চোখে পড়ল না, হতাশ হয়ে ফিরে আসার আগে সারাবাধা কিছু কাঠের টুকরো সরিয়ে নিল, যেগুলো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। সেটা সরাতেই পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। একেবারে স্পষ্ট নয় যদিও, শুধুমাত্র আকৃতি বোঝা যাচ্ছে। সে ওটা মেপে নিল। এটা কতটা কাজে আসবে সে জানে না। কাঠগুলো এভাবে না রাখা হলে চিহ্নের শেষাংশটুকুও থাকত না। তবুও এটা যে তখনকারই তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে এবার ভেতরে এলো। ওপাশে তেমন কিছু পাওয়া গেল না, কারণ ঘর সাফসুতরো করা হয়েছে বেশ ভালো মতো।
তবে সেই মাপের পায়ের ছাপ একজনের সাথে মিলে গেল। এবং যার ছাপ সে-ই আবার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো লোকটার সন্তান। সে জানালার নিচের দেয়ালের যে জায়গায় ছাপটা পাওয়া গেল তাতে সেটা বেয়ে কেউ উপরে না উঠলে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে গোলমাল বাঁধল মালতির জবানবন্দি। সে তার আগেরদিন রাতে একজনের সাথে এহতেশাম সাহেবের উত্তপ্ত কথোপকথন শুনেছে। যা এই বাড়িতে একেবারেই রেয়ার। সে-ও জোরালোভাবে চলে এলো সন্দেহের তালিকায়।
দুটো বিষয় অনেক ভেবে চিন্তে নিজের পরিকল্পনা গুছিয়ে মোক্ষম চাল দিয়ে দিল। এহতেশাম সাহেবের দুই পক্ষের সন্তানরা আগেই বাদ পড়ে গেছে। সেটাই ধরে নিল সে।
“আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা আলোচনায় বসব আপনাদের সাথে। সবাই থাকবেন, কেউ যেন বাদ না থাকে। যে বাদ পড়বে সে ফেঁ/সে যাবে।”
২৮.
এই বাড়ির প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এসে উপস্থিত হয়েছে। কেবল রায়হানের বড় মেয়ে এখানে থাকে না সে নেই, আর একজন নেই।
“আপনার ভাই কোথায় মৃদুলা ম্যাডাম?”
“ও-কে আপনি এই বাড়িতে কয়দিন দেখেছেন? সে এই বাড়িতে অনেকদিন ধরে থাকে না।” আশ্লেষে বলল মৃদুলা।
ময়ূখ সবার দিকে চোখ বুলিয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, “আমি তাকে ধরে ফেলেছি।”
‘তাকে’ বলতে আসলে সে কাকে বুঝিয়েছে তা ঘরের প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছে। হট্টগোল শুরু হয়ে যাচ্ছিল, সা/স/পে/ক্ট/দের অভিব্যক্তি ভালো মতো খেয়াল করল ময়ূখ, একজন নির্বিকার, আরেকজনের চোখের পাতা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে সে আবারও বলে উঠল, “কিন্তু সে কে বলার আগে আমি একটা গল্প বলতে চাই।”
এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল ময়ূখ, ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো!
“অনেকবছর আগে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা ছেলের জন্ম হয়। বাবা-মায়ের সাথে তার ছোট্ট ছিমছাম পরিবার। তার পরিবারে অন্য কেউ ছিল না, কারণ ভালোবেসে বিয়ে করেছিল তারা। কোনো পরিবার মেনে নেয়নি। মেয়ে মামার বাড়িতে থাকত, লোকটার পরিবারের অমতে তারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। একদিন এক জমিদার বংশীয় শিকারীর অসাবধানতায় ছোট্ট ছেলেটার বাবার মৃ/ /ত্যু হয়। তার মা কোথায় যাবে কী করবে কিচ্ছু ভেবে পায় না। সেখানেই কয়েকমাস কেটে যায়। কিন্তু ছোট বাচ্চা নিয়ে পরিবারহীন একজন নারীর বাস কতটা দুর্বিষহ হতে পারে তিনি উপলব্ধি করেছেন।”
খানিকটা থেমে সবার কৌতূহলী এবং একজনের বিস্মিত এবং অপর একজনের স্বস্তিমাখা মুখ জরিপ করে পুনরায় বলতে শুরু করল, “তিনি ফিরে এলেন শ্বশুর বাড়িতে। এখানে তার ছেলেকে সবাই সুন্দরভাবে গ্রহণ করলেও তার প্রতি বিষেদগার রয়েই যায়। খুব অল্প বয়সেই তিনি চলে যান পৃথিবী থেকে। ছেলেটা বড় হতে থাকে চাচার কাছে, সময়ের সাথে সাথে একসময় তার বাবা-মা হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে। সে চাচার কাছে চাচার পরিচয়ে বড় হতে থাকে। পড়াশোনা চলে পাশাপাশি। সেই চাচা আবার চাকরি করে এহতেশাম সাহেবের অধীনে। যখন থেকে বুঝতে শুরু করে তখন থেকেই ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে ওর মনে। বড় হতে হতে তা রূপ নেয় প্রতিশোধ স্পৃহায়। পড়াশোনা শেষে গ্রামে ফিরে এসে চাচাকে বলে সে এখানে কাজ করবে। কিন্তু বললেই তো আর এখানে সুযোগ পাওয়া যায় না৷ তাছাড়া চাচাও আপত্তি করলেন। এতদূর পড়াশোনা করে এখানে কেন? চাইলে অনেক ভালো সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। এর কিছুদিনের মধ্যে চাচা মারা যান। সেই সময় এহতেশাম সাহেবের একজন বিচক্ষণ লোক প্রয়োজন ছিল যে এই ফাঁকা জায়গাটা নিতে পারে। বিশ্বস্ত লোকের ভাইয়ের ছেলে, তারউপর বিদ্যা-বুদ্ধি ভালো। তিনি নিয়ে নিলেন তাকে।”
সবাই এবার ঘুরে যার দিকে তাকালো, ময়ূখও তার চোখে চোখ রেখে বলল, “পরের কথাটা কি আপনি বলবেন সাজিদ? যা বলেছি এখান থেকে কিছু বাদ পড়ল কি?”
ঘর নিমিষেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল, সাঈদ উঠে সাজিদের গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হলে ময়ূখ আবার সবাইকে থামতে বলল। কিন্তু এবার সহজে থামল না, বেশ বেগ পেতে হলো।
উঁচু গলায় ময়ূখ বলল, “আমার কথা শেষ হয়নি। আমি উপসংহারও বলিনি। আমি শেষ কথা বলার আগে আপনারা কেউ উ’ত্তে”জি”ত হবেন না।”
ময়ূখ সাজিদের চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালো, সেখানে ভয় নেই এতটুকু, অনুশোচনাও নেই, আছে কেবল অদ্ভুত এক ক্রো/ধ। তবুও কেমন ঠান্ডা আর শীতল! সহজ সরল মুখের সাজিদের সাথে এর কোনো মিল নেই, যেন তার খোলসে ভিন্ন এক সত্তা। ঠোঁটে হাসিতে বি/দ্রু/প ঝরে পড়ছে!
“বাকিটাও আপনি ই বলুন, মিস্টার ডিটেকটিভ। দেখি আমাকে নিয়ে কী কী হাইপোথিসিস দাঁড় করালেন!”
……..
(ক্রমশ)