#সেই_তমসায়_১৪
নুসরাত জাহান লিজা
এহতেশাম আহমেদ যত বেড়ে উঠতে থাকেন, তার মধ্যে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব তত প্রকট হতে থাকে। তবে পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। পড়াশোনা করেছেন ঢাকায়, তখন প্রথমবার একটা বড় কে/লে/ঙ্কা/রি/তে জড়ান। তার একটা বন্ধু নিখোঁজ হয়েছিল, যাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, কারণটাও অজ্ঞাত। এরপর ফিরে আসেন নিজের এলাকায়।
তার বাবা তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু কারোর কথা কানে তোলার মতো অবস্থা তার ছিল না। তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে দিন দিন। মদ্যপান করে মাতাল হয়ে এই বাড়ির একজন কর্মীকে ছাদ থেকে ফেলে দেন। তার হ/ঠ/কা/রি/তা/য় ওই লোকের মৃ/ত্যু হয়। কিন্তু অত্যন্ত কৌশলের সাথে ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়। মৃ/ত ব্যক্তির পরিবার খোঁজ করতে এলে তাদের জানানো হয় জানানো হয় সে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কই গেছে তারা জানেন না।
এহতেশাম বাবার এহেন কাজে প্রশ্রয় পেয়ে হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া। নিজের কথার কোনো বিরুদ্ধাচরণ তিনি একেবারেই সইতে পারেন না। এমন আরও অসংখ্য কাজ এই বাড়ির চার দেয়াল পেরোতে পারেনি কোনোদিন।
ছেলের মতি ফেরানোর জন্য ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। বেশ বড় ঘরের অল্পশিক্ষিত মেয়ে রাবেয়ার সাথে বিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পরিবর্তন আসে না। প্রথম কিছুদিন ঠিকঠাক চললেও স্ত্রী’র সাথে সময় কাটাতে তার ভালো লাগত না। কারণ তার সাথে কথা বলে তিনি শান্তি পান না৷ তার মানসিকতার সাথে রাবেয়ার মানসিকতার বিস্তর ফারাক। ফলে, বাবার উপরে আরও অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন।
সন্তান আসে, কিন্তু তার মতি ফেরে না। তৃতীয় সন্তান আসবে, তার আগে আগে তিনি নিরুদ্দেশ হন। তখন দেখা হয় সুরাইয়ার সাথে, বিয়ে করেন, সেখানেও সন্তান হয়। আরও একটা দুর্ঘটনা ঘটে পথে।
তার বাবা তাকে ত্যা/জ্য করার হুমকি দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। দ্বিতীয় বিয়ের কথা এই বাড়িতে গোপন থেকে যায়। এহতেশাম এবং তার বাবা ব্যতিত অন্য কেউ জানত না বিষয়টা। কিন্তু স্ত্রীর প্রতি সম্মানবোধ তার কোনোদিনই ছিল না। সরাসরি কোনো কথা বলতেন না, কিন্তু শীতল ব্যবহারে বুঝিয়ে দিতেন তিনি অনেক দূরের মানুষ, রাবেয়ার ধরাছোঁয়ার বাইরের কেউ।
তার সন্তানদের মধ্যে রায়হান একটু আধটু বুঝতে শুরু করে। স্ত্রীর প্রতি জমা হওয়া ক্ষোভ ঢালতেন সন্তানদের উপরে। একটা ছোট্ট ভুল করলেও তার জন্য বড় শাস্তি বরাদ্দ হতো। ওইটুকু বাচ্চাদের সাথে এমন ব্যবহার রাবেয়া মানতে পারতেন না। তিনিও কিছু কথা শুনিয়ে দিতেন। ঘরে অশান্তি ছিল প্রবল। এরমধ্যে এহতেশাম সাহেবের বাবা গত হলেন। সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে তার উপরে।
এর বছর দুয়েক পরে তার একমাত্র বোন মা/রা যায়। তার ছোট্ট দুই ছেলে মেয়েকে এখানে নিয়ে আসেন। বোনের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল। তাই তার সন্তানদের কখনো অ/ব/জ্ঞা করেননি।
হাতে এত ধনসম্পদ আর টাকা কড়ি সাথে অবাধ ক্ষমতা পেয়ে তিনি ধীরস্থির হলেন। বিচক্ষণ হলেন এবং সবকিছু শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরলেন। এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে টু-শব্দটি হলেও তার কান অব্দি পৌঁছে যেত। অতি বিশ্বস্ত কিছু লোককে নিজের চারপাশে রাখতে শুরু করেন, যারা বলা মাত্রই তার জন্য সবকিছু করতে পারে।
নিজের ইমেজ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠলেন, বাইরের লোক তাকে এবং তার পরিবারকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত, সেটা আরও বাড়ল। কিন্তু ঘরে তিনি খুব একটা বদলাননি।
রায়হান আর মুনিরার মনে আছে এখনো, তাদের মা হুট করে একদিন মা/রা গেলেন। ওরা ভীষণ অসহায়বোধ করত। কিন্তু বাবার কাছ থেকে ছাড় পেত না।
এহতেশাম তার দুই ছেলেকে প্রায়ই বিদ্রুপাত্মকভাবে বলতেন, “গা/ধা/র গর্ভে মানুষের বাচ্চা থাকলে তারা গা/ধা/ই হয়। জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ তোমরা।”
তাদের মন বিদ্রোহ করলেও কিছু বলা সম্ভব ছিল না। কারণ এই লোকটাকে তারা অসম্ভব ভয় পেত। মনে মনে জমা হতো অবর্ণনীয় ক্ষো/ভ। কিন্তু সেটার প্রকাশ ছিল না৷ তাতে বিপদ বা/ড়/ত।
এই বাড়ির পুরনো লোক আলাউদ্দিন। সে তার দাদার কাছে গল্প শুনেছিল, এহতেশাম সাহেবের দাদা আর বাবার প্রভাব প্রতিপত্তির বিস্তারের গল্প। এই অঢেল সম্পদের অনেক অংশের সাথে লেগে আছে অনেক অসহায় মানুষের র/ক্ত আর শ্রম। তাদেরও অজস্র গল্প এই বাড়ির ইটে ইটে, বালুকণায়, বাতাসে মিশে আছে।
বয়স বাড়তে বাড়তে তিনি হয়ে উঠেন আরও সাবধানী, অনেক বেশি দূরদর্শী। রক্তের গৌরব তাকে করে তুলে আরও বেশি দাম্ভিক। তার মাপা আচরণে আর চলনে বলনে ঠিকরে পড়ত আভিজাত্য। বুদ্ধিমত্তা আর চাতুর্যের সংমিশ্রণে এহতেশাম আহমেদ এই এলাকার জন্য একজন প্রবাদপ্রতিম মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। মানুষ তার নাম উচ্চারণ করে সম্ভ্রমের সাথে।
২৭.
ময়ূখ নিজের সংগৃহিত সব তথ্য জুড়ে দিয়ে এহতেশাম সাহেবের এই জীবনপ্রবাহ দাঁড় করিয়েছে।
দুই মৃ/ত ব্যাক্তির পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে একটা নাম পাওয়া গেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা বাকি রয়ে গেছে।
তবে সাথে আরেকটা বিষয় ওর মাথায় ঘুরছে, এই ব্ল্যা/ক/মে/ই/লের বিষয়টা। এহতেশাম সাহেবের সন্তানরা এবং এই বাড়ির কেউ মুনিম আর শিরিনিরের বিষয় সম্পর্কে অবগত নয়! মুনিমরাও এটা করেনি। তবুও ওদের বাইরে কেউ তো আছে যে জানত বা জেনে গিয়েছিল! এবং সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল।
এহতেশাম সাহেবের মতো আত্মম্ভরি মানুষ কোনোভাবেই এটা ভালো চোখে দেখেননি এটা তো জানা কথা। কার সাথে তার রেষারেষি ছিল সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
প্র/তি/শো/ধ না সত্য প্রকাশের হু/ম/কি! কোনটা তার জন্য কাল হলো! তিনি কাউকে তোয়াক্কা করতেন না, তাহলে এই বিষয়টা নিয়ে তার ভয়ই বা কেন ছিল? ইমেজের ভয়? চিন্তায় ডুবে যায় ডিটেকটিভ ময়ূখ এহসান।
……..
(ক্রমশ)