#সেই_তমসায়_১২
নুসরাত জাহান লিজা
২৪.
“তাহলে আপনারা দুই ভাইবোন সবকিছুর পেছনে?”
“আপনার হাতের জিনিসটা আমাদের পছন্দ হচ্ছে না, ওটা নিচে ফেলে পা দিয়ে সামনের দিকে সরিয়ে দিন।”
“সে তো আপনি আমার মাথায় যা ধরে রেখেছেন সেটাও আমার অপছন্দ হচ্ছে।”
“ফেলুন।” ঘাড়ের কাছে খোঁ/চা দিয়ে জলদগম্ভীর গলায় বলল মুনিম।
“ওকে, ফেললাম।” মেঝেতে পড়ার শব্দ হলো, এরপর পি/ /স্ত/ /ল/টাকে লা/থি/ দিয়ে শিরিনের দিকে দিল নির্দেশ মতো।
“এবার ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসুন। কোনো ধরনের চা/লা/কি করার চেষ্টা করবেন না, তাহলে…”
“বাহ্! আপনারা বাড়িতে আগত অতিথিদের এভাবেই অপ্যায়ন করেন বুঝি?”
“বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না, অপ্যায়নের পরবর্তী ধাপে এখন আমাদের যাবার ইচ্ছে নেই। বাধ্য করবেন না ময়ূখ সাহেব।”
ময়ূখ সুবোধ ছেলের মতো চেয়ারে গিয়ে বসল। মুনিম গিয়ে বসল হাত পাঁচেক দূরে রাখা সোফায়। সরাসরি ময়ূখের দিকে নিশানা করে বসেছে। শিরিনকে বলল, “তুই তোর কাজ করতে থাক।”
ময়ূখ প্রশ্ন করল, “এরপর প্ল্যান কী আপনাদের? পালানোর আগে আমাকে…”
“আপনাকে সরিয়ে দেবার কোনো প্ল্যান আমাদের নেই। তবে তিনদিন পরে আমাদের ফ্লাইট। এই ক’দিন আপনাকে থামিয়ে রাখতে হবে।”
“সে দেখা যাবে। আমি জানতে চাই সবকিছু কীভাবে করলেন? দেখুন আপনারা বললেন পালানোর আগে আমি যেন বাইরে বেরুতে না পারি তার ব্যবস্থা করবেন। তাহলে আমার কৌতূহল মেটাতেই পারেন।”
মুনিম প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরে কী ভেবে রাজি হলো বলতে। শিরিনও গোছানোয় বিরতি দিয়ে এসে বসল মুনিমের পাশে। দুই ভাইবোন শোনালো এহতেশাম আহমেদের জীবনের একটা অদ্ভুত অধ্যায়।
দেশ ভাগের বছর দশেক পরের কথা, এহতেশাম শিকার করতে ভালোবাসতেন, এছাড়া সারাদেশের নানা জায়গায় ঘুরতে ভালোবাসতেন। হুটহাট নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন বাড়ি থেকে। সাথে কখনো দুই একজন সাগরেদ থাকত। সেভাবেই একবার বেরিয়েছিলেন, চলে গেলেন দেশের অন্য প্রান্তের এক গ্রামে। তখন শীতের প্রকোপ ছিল, অসুস্থ হয়ে আশ্রয় নিলেন সেই গ্রামের এক অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে। তার ছিল দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সুরাইয়ার বয়স তখন কেবল চৌদ্দ।
তারা ভেতরেই থাকত, বাইরের জগতে তাদের বিচরণ তেমন একটা ছিল না। এহতেশামের অসুস্থতা বেড়ে গেল। সেবার জন্য এগিয়ে এলো সুরাইয়া। অত্যন্ত সুশ্রী দেখতে ছিল কিশোরী মেয়েটি। এই দুই দিনে এহতেশাম পছন্দ করে ফেলেন তাকে। কিন্তু সুরাইয়া রাজি হয় না। কিন্তু অনবরত বলার ফলে একসময় তারও অনুভূতি তৈরি হয়। এহতেশাম সব বললেও নিজের বাড়িতে যে তার স্ত্রী, সন্তান আছে তা এড়িয়ে গেছেন।
সুরাইয়ার মা মেয়ের এই প্রেম টের পান, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা এহতেশামকে তার পরিচয় কোথায় থাকে সব জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নিজের বিয়ের ব্যাপারটা এড়িয়ে সুরাইয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তারা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নেন। ধুমধাম করে এহতেশামের পরিবারের অনুপস্থিতিতে বিয়ে হয়ে যায়।
এহতেশাম এরপরও সুরাইয়াকে নিয়ে যান না নিজের বাড়িতে৷ কারণ তিনি আগেই বলেছিলেন তার সাথে তার বাবার কিছু বিষয়ে ঝা/মে/লা চলছে। সবাই তাই বিশ্বাস করে। কিন্তু তিনি আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। সময় গড়ায়, মুনিমের জন্ম হয়, প্রথম সন্তান জন্মের বছর চারেক পরে সুরাইয়া আরেকবার অন্তঃসত্ত্বা হন। তখন দেশের /পরিস্থিতি ভালো না। সেই সময় এহতেশাম বের হন আরেকবার, উদ্দেশ্য পাখি শি/কা/র।
পাখি শি/কা/র চলছিল, সেই সময় ঘটে দু/র্ঘ/ট/না। একটা /গু/ /লি/ গিয়ে লাগে সেখানকার এক পথচারীর। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই লোকটা /মা/ /রা/ যায়। এহতেশাম টাকা পয়সা খরচ করে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দেন। সেখান থেকে গা ঢাকা দিতে সুরাইয়ার কাছে ফিরে আসেন।
এরইমধ্যে একদিন এহতেশামের পকেটে একটা চিঠি পান সুরাইয়া। যা পাঠিয়েছে তার প্রথম স্ত্রী। সুরাইয়া ভেঙে পড়েন। এরপর এহতেশাম অনেককিছু বলে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সুরাইয়া অনড়৷
সেই সময়কার পরিস্থিতি উপেক্ষা করেই সুরাইয়া সাফ জানিয়ে দেন, “নিজের সম্পর্কে বছরের বছর মি/থ্যা/চা/র করা একটা প্র/তা/র/ণা। একটা প্র/তা/র/ক/কে এতবছর বিশ্বাস করেছি, সেইজন্য আমি লজ্জিত। কিন্তু নিজের অবমাননা আমি জেনেশুনে আর করতে রাজি নই।”
“আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে পাওয়ার জন্যই মিথ্যা বলেছি।”
“যারা প্র/তা/র/ক তারা কোনোদিনই কাউকে ভালোবাসতে পারে না। বরং তুলনামূলক ভালো কিছু পেলে সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে। তুমি ফিরে যাও।”
“আমার সন্তানরা?”
“আমি আছি তাদের জন্য। তুমি সত্যিটা আমাকে জানাতে পারতে বিয়ের আগে। তাহলে হয়তো..”
এহতেশাম তারপর নিজের বাড়িতে ফিরে যান। তার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথম প্রথম সন্তানদের দেখতে আসতেন, কিন্তু সুরাইয়া আর কোনোদিন তার মুখোমুখি হননি। আস্তে আস্তে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। মুনিমের বয়স যখন আট তখন সর্বশেষ দেখা হয়।
সুরাইয়া নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। কখনো সেলাই করে, কখনো সবজি-ফল চাষ করে দুই সন্তানকে বড় করতে থাকেন। বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টা করলেও তিনি রাজি হননি। সেখানেও রো/ষে/র মধ্যে পড়েন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন না। তার বাবার সম্পত্তিতে নিজের অংশটুকু বুঝে নিয়ে আলাদা ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করেন। অনেক কষ্ট হলেও চলে যেত দিন।
নানা জনের নানান কথায় সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েও তিনি বুক চিতিয়ে লড়ে গিয়েছেন। মুনিম আর শিরিন ছেলেবেলাতেই তাই অনেক বাস্তবতা বুঝতে শিখেছে। নিজের বাবার প্রতি রুষ্ট হয়েছে। মুনিম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন সুরাইয়া পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান। সন্তানদের শয্যাপাশে নিয়ে একটা উপদেশ তিনি দিয়ে যান,
“কখনো কারোর সাথে প্র/তা/র/ণা করিস না। তোদের যেটুকু আছে সেটুকুই অন্যের কাছে প্রকাশ করিস। নিজে যা না তা জাহির করার মধ্যে বাহাদুরি নেই, বরং নিচতা আছে।”
মুনিমের ঘাড়ে বোনের দায়িত্ব এসে পড়ে। সে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হতে পারে না। ছোট বোনকে একা কার কাছে রাখবে। নানা-নানী তো আগেই নেই। মামাদের ভরসায় রেখে কীভাবে যাবে অতদূর। একসময় শিরিনের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে এই বাড়ি বিক্রি করে জেলাশহরে চলে যায়। সেখানে একটা একরুমের বাসা ভাড়া নেয়। এখানকার কলেজে বিএ ভর্তি হয়। মাঝে গ্যাপ ছিল দুই বছরের। বোনকে কলেজে ভর্তি করায়। কিন্তু খেই পায় না খুব একটা, হিমশিম খেতে থাকে।
একসময় মনে হয় প্রতি/ /শো/ধ নেবে। এভাবে মাঝপথে ফেলে যাবার জন্য। শিরিনের বিয়ের তোরজোর করলেও সে প্রথম প্রথম রাজি না হলেও একসময় মত দেয়। বোনের বিয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে এহতেশামের ঠিকানায়। একসময় দেখা হয়, পরিচয় দিয়ে নিজের প্রাপ্য বুঝে চায়। এহতেশাম বিগলিত হন। কিন্তু এভাবে নিজের পরিবারের সামনে বলতে পারবেন না বলে জানান। তবে তিনি ছেলেকে কাছেকাছে রাখার জন্য চাকরি দেন এখানে। জানালার গ্রিল সেজন্যই কাটা হয়েছিল, সন্তানের সাথে যেন একান্ত সময় কাটানো যায়।
শিরিনের ডিভোর্স হয়ে যায় দুই বছর পরে। মা/তা/ল স্বামীকে সইতে পারে না। ওকেও এখানকার হাসপাতালে কাজ নিয়ে দেন এহতেশাম। আরও বছর কয়েক যাবার পরে তিনি মেয়েকেও নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন আসলেও তার দেখাশোনার জন্য একজন লাগত।
এই পর্যায়ে মুনিম থামল। ময়ূখ বলল, “জানালার গ্রিল, সুযোগটা ঠিকঠাক কাজে লাগিয়েছেন, তাই না?”
“না, জানালা নয়, উনি ঘরের আলমারি সরিয়ে নিয়েছিলেন একজনকে দিয়ে। যেটা শিরিন দেখেছিল। আমরা আন্দাজ করি সেখানে এসব রাখতে পারেন৷ তিনি চলে যাবার দুইদিন পরে আমরা এসব সরাই।”
“না, এগুলোর কথা বলিনি। আপনার বাবাকে /খু/ /ন করেছেন কীভাবে?”
“খু/ ন আমরা কেন করতে যাব? আমরা কেবল টাকা-পয়সা চেয়েছিলাম। যা আমরা এতকাল কিছু হলেও পেতাম৷ আমাদের জীবন গোছানো হতে পারত। তারজন্য সেটা হয়নি। তাই বলে তাকে খু/ /ন! আমাদের জন্য অসম্ভব।”
শিরিনও প্রবল আপত্তি জানালো।
“দেখুন, আমরা তার এই ধনসম্পদ সব আনতে চাইনি। কিন্তু একটা ক্ষো//ভ থেকে এনেছিলাম। এখন এর তিন ভাগের একভাগ আমরা রাখছি। বাকিটা ফিরিয়ে দেব। সে অনুযায়ী ভাগ বাটোয়ারা করছিলাম। কৌশল করছিলাম ফিরিয়ে দেবার, সরাসরি দিতে গেলে ধরা পড়ে যাব বলে। তাকে সরিয়ে আমাদের কী লাভ? আমরা কেবল ভালোভাবে বাঁচতে চাইছিলাম৷”
মুনিম বলল, “মা বেঁচে থাকলে আমাদের কাজে কষ্ট পেতেন। আমরা তার সম্মান ধরে রাখতে পারিনি।”
এদের চেহারায় কেন যেন মিথ্যা খুঁজে পেল না ময়ূখ। বরং অনুশোচনা ঝরছে। আসলেও, এমন ব্যক্তিত্বের মায়ের সন্তানের জন্য এটা লজ্জাজনক।
ময়ূখের মাথায় সেই গ্রিল না থাকা জানালাটা ঘুরছিল, আর সেই পাখি শিকার করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালো লোকটার পরিবারের কথা। নাহ্! নিজের চিন্তাশক্তিকে আরও ঘষামাজা করতে হবে।
সবার আগে এখান থেকে মুক্ত হতে হবে, দু’দিনের আশায় বসে থাকা সম্ভব নয়, নইলে আসল পাখি হাওয়া হয়ে যেতে পারে!
…….
(ক্রমশ)