সেই আদুরে দিন পর্বঃ২৪

0
1050

#সেই_আদুরে_দিন
#পর্বঃ২৪
#Arshi_Ayat

রৌদ্রুপের মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে।কিছুই ভাবতে পারছে না সে।মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে কিছু একটা হারিয়ে গেছে।মন বিশ্বাস করতে পারছে না আর মস্তিষ্ক বিশ্বাস করেও মানতে পারছে না।যখন কমিশনার ফোন দিয়ে কথাটা বলল তখন একমুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।কোনো এক দৈব শক্তির সাহায্যেই বোধহয় সে বাড়ি পর্যন্ত আসতে পেরেছে।বাড়ির সামনে ফায়ার ব্রিগেডের লোক,পুলিশ সবাই উপস্থিত।রৌদ্রুপ পৌঁছুতেই পুলিশ সুপার এসে তাকে বলল,’স্যার,একটা পোড়া দেহ পাওয়া গেছে।লাশ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

পাথরের মতো গাড়ি থেকে নেমে লাশের কাছে চলো এলো রৌদ্রুপ।লাশটা একনজর দেখে শুদ্ধতার মুখটা মনে পড়তেই ওর মাথা ঘোরাতে লাগলো।চোখের সামনে অন্ধকার,কুয়াশা!

লাশ নিয়ে যাওয়া হলো ডি এন এ টেস্টের জন্য।একমাত্র ডি এন এ টেস্ট’ই শনাক্ত করতে পারে।রৌদ্রুপ কেও হাসপাতালে অভজার্ভেশন এ রাখা হলো।সে এখন ট্রমার মধ্যে আছে।মেয়ের শোকে আরমান সাহরীফেও অবস্থা নাজেহাল।

তিনদিন পর…
এখন কিছুটা ঠিক আছে রৌদ্রুপ।কিন্তু তবুও তাকে আরো কয়েকদিন অভজার্ভেশন এ থাকতে হবে কিন্তু রৌদ্রুপ সেগুলোর ধার ধারলো না।কিছুটা সুস্থ হতেই হাসপাতাল থেকে চলে আসলো সোজা আরমান সাহরীফ এর বাসায়।রৌদ্রুপকে দেখে আরমান সাহরীফ মলিন কন্ঠে বলল,’আসো ভেতরে আসো।’

রৌদ্রুপ আর আরমান সাহরীফ সোফায় বসলেন।দু’জনই চুপ হয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর রৌদ্রুপ বলল,’বাবা,আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার শুদ্ধ মরে গেছে।’

আরমান সাহরীফ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।তারপর নিজের হাত দিয়েই চোখের পানি মুছে বললেন,’বিশ্বাস তো আমারও হচ্ছে না কিন্তু এটাই সত্যি।আমার মেয়েটা চলে গেছে আমায় ছেড়ে।’

‘না,বাবা।ও আমাদের ছেড়ে যায় নি।আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনো ঘাপলা আছে।ডি এন এ টেস্টের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতে পারবো না ওটা শুদ্ধতার বডি।’

‘কিন্তু যদি ডি এন এ টেস্টের রিপোর্ট ও মিলে যায় তাহলে?’

‘মিলবে না মিলতে পারে না।’

আরমান সাহরীফ রৌদ্রুপের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।নিজের পর এই ছেলেটাই তার মেয়েকে অনেক বেশি ভালোবাসে।সেইজন্যই মৃত্যুটা এখনো মেনে নিতে পারছে না।

ডিপার্টমেন্ট থেকে রৌদ্রুপের ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ এখন ওর মানসিক অবস্থা ভালো না।এই অবস্থায় কাজে যোগ দেওয়া উচিত হবে না।তবে রৌদ্রুপ জানতে পারলো সিশা রিজাইন করেছে।স্বশরীরে রিজাইন লেটার না দিলেও মেইল করে দিয়েছে।এখন সিশা কোথায় আছে কেউই জানে না।হঠাৎ রিজাইন করার কারণ কেউ বুঝতে না পারলেও রৌদ্রুপ ঠিকই বুঝতে পারলো।সে মনে মনে বলল,’সিশা তুই যেখানেই থাকিস।তোকে ঠিক খুঁজে বের করবো আমি।আমার সাথে গেম খেলতে নামার ফলও পাবি।’
—————–
মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের একজন সদস্য নিখোঁজ গতকাল রাতে তিনি এয়ারপোর্ট থেকে নিখোঁজ হয়ে যান।সর্বশেষ তাকে এয়ারপোর্টে দেখা গেছে।তার নাম টমস।এদিকে আরেকজন সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় গাড়ি ব্লাস্ট হয়ে নিহত হয়েছেন।সাথে সাত বছর বয়সী মেয়েও ছিলেন।নিহত কর্মীর নাম বিদিশা আলম।

সকাল সকাল এই খবর পেয়ে রৌদ্রুপ ভিষণ ভাবে শকড হয়ে গেছে।একসাথে বিদিশা আর টমস দুজনকেই সরিয়ে দেওয়ার কাহিনি কিছুটা হলোও আন্দাজ করতে পেরেছে রৌদ্রুপ।

আজকে ডি এন এ টেস্টের রিপোর্ট দিবে।তাই সে হসপিটালে যাবে কিন্তু তার আগে বিদিশার বাসায় যেতে হবে।জানাজায় থাকতে।সেখান থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যাবে।

জানাজা শেষে ও হাসপাতালে চলে এলো।ডাক্তার বাহারের চেম্বারে আসতেই।উনি রিপোর্ট’টা রৌদ্রুপের হাতে দিয়ে বললেন,’রিপোর্ট’টা দেখুন।’

রৌদ্রুপ রিপোর্ট দেখলো সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শুদ্ধতার ডি এন এ মিলে যাচ্ছে তার মানে লাশটা শুদ্ধতার।ইতিমধ্যে শুদ্ধতার বাবাও চলে এসেছেন।তিনি রিপোর্ট’টা দেখে চোখের পানি মুছে রৌদ্রুপের কাঁধে হাত রেখে বললেন,’এবার নিজেকে সামলাও বাবা।আসলেই আমার মেয়েটা আর নেই।’

রৌদ্রুপ কিছু বলল না রিপোর্ট’টা নিয়ে উত্তরার বাসাটায় চলে এলো।ওদের বেডরুমে ওর আর শুদ্ধতার বড় একটা ক্যান্ডিড ফটো আছে যেখানে শুদ্ধতা রৌদ্রুপের চুল টানছে আর রৌদ্রুপ বাচ্চাদের মতো করে রেখেছে চেহারা।ছবিটা শুদ্ধতা ওর ফুপুর বাড়ি যাওয়ার পর বাঁধিয়েছিলো সে।বাসায় আসার পর এই সারপ্রাইজ’টা পেয়ে এতো খুশী হয়েছিলো মেয়েটা।রৌদ্রুপ সন্তপর্ণে এসে দাড়ালো ছবিটার সামনে শুদ্ধতার ছবি’টা ছুঁয়ে বলল,’দুনিয়ার সবাই বলছে তুমি মৃত।কিন্তু আমি কেনো বিশ্বাস করতে পারছি না।কেনো মনে হচ্ছে বেঁচে আছো।তোমার ডেথ সার্টিফিকেট,ডি এন এ রিপোর্ট সব আমার হাতে।প্রত্যেক’টা টিভি,চ্যানেলে দেখাচ্ছে তুমি মৃত।মানুষ আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছে।তোমার জন্য আফসোস করছে।কয়েকদিন পর ভুলে যেতে বলবে কিন্তু তুমিই বলো তোমাকে ভোলা সম্ভব?একজীবনে কোনোভাবেই সম্ভব না।তুমি কি পারতে না আরো কয়েকটা যুগ আমার সাথে থাকতে?কেনো নিয়তির কাছে ভালোবাসা পরাজিত হলো?’রৌদ্রুপের কন্ঠ ভারী হয়ে এলো।চোখের কার্নিশ বেয়ে অবাধ্য জলধারা গড়িয়ে পড়ছে কপল বেয়ে।

চোখের পানি মুছে।নিজের ফোনটা বের করে কাউকে কিছুটা বলল।রিপোর্ট গুলো যত্ন সহকারে আলমারিতে রেখে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কিছু একটা ভেবে নিলো।

এদিকে ডিপার্টমেন্টে একে একে সব ভালো ভালো কর্মীরা রিজাইন নিচ্ছে,নয়তো মরে যাচ্ছে নাহলে গায়েব হয়ে যাওয়ায় সবাই বেশ চিন্তিত।সবচেয়ে ভরসার ছিলো রৌদ্রুপ।একটু আগে সেও মেইল করে রিজাইন লেটার’টা পাঠিয়ে দিলো।সিশার রিজাইনটা নিয়ে সবারই বিভিন্ন জল্পনা কল্পনা চলছিলো কিন্তু কেউই সঠিক’টা জানতে পারে নি এখন আবার রৌদ্রুপও রিজাইন নিয়ে নিলো।কি হলো এদের?এদিকে টমসকে হন্যে হয়েও খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না।
————–
রাত বাড়তেই রৌদ্রুপ সাবধানে এপার্টমেন্টের ছাদে চলে এলো।লম্বা একটা রশি ছাঁদের পেছনটায় ফেলে পিলারের সাথে শক্ত করে বেঁধে দিলো যা নিচ পর্যন্ত চলে গেছে।রশিটা বেয়ে রৌদ্রুপ নিচে নেমে গেলো।এপার্টমেন্টের বাউন্ডারি টপকে বাইরে বেরিয়ে এলো।বাইরে একটা কালো গাড়ি অপেক্ষা করছে ওর জন্য।রৌদ্রুপ গাড়িতে উঠতেই গাড়িটা স্টার্ট দিলো।

ফাঁকা হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাঁটছে রৌদ্রুপ।একবারে কোণার একটা রুমে দিয়ে নক করতেই দরজা খুলে গেলো এবং ও ভেতরে ঢুকে গেলো।ভেতরে ডাক্তার বাহার বসে আছে।তার হাত পা বাঁধা আর মুখ বাঁধা।ভেতরে কালো কাপড় পরা দু’জন দাড়িয়ে আছে।রৌদ্রুপ ওদের ইশারা দিতেই ওরা বেরিয়ে গেলো।রৌদ্রুপ ডাক্তার বাহারের মুখের টেপ’টা খুলে দিয়ে বলল,’কি ডাক্তার সাহেব কেমন আছেন?’

‘আমাকে এভাবে আঁটকে রেখেছেন কেনো?’

‘আপনি আমাকে মিথ্যা রিপোর্ট দিলেন কেনো?’

‘দেখুন আমি বাধ্য হয়েছি এটা করতে।

‘আপনাকে কে বাধ করলো?’

ডাক্তার বাহার কাঁপতে কাঁপতে বলল,’ডি এন টেস্টের রিপোর্ট দেওয়ার আগের দিন দুপুরে আমার ফোনে একটা ভিডিও সেন্ড করা হয় সেখানে দেখা যায় কিছু লোক আমার স্ত্রীর গলায় চাকু ধরে রেখেছে।এরপর একজন কল দিয়ে বলল রিপোর্ট না পাল্টালে আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলবে।’

‘যে কথা বলেছে আপনার সাথে সে কে ছিলো?পুরুষ নাকি মহিলা?’

‘পুরুষ কন্ঠ ছিলো।স্যার বিশ্বাস করুন আমি এমন কিছু করতে চাই নি কিন্তু এমন না করলে ওরা আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলতো।আমি আমার বউকে খুব ভালোবাসি।’

রৌদ্রুপ শীতল কন্ঠে বলল,’আমিও আমার বউকে খুব ভালোবাসি।ওর জন্য একহাতে সবকিছু ধ্বংসও করতে পারি আবার আরেক হাতে গড়তেও পারি।’

কাল পর্যন্ত রৌদ্রুপ বিশ্বাস করতে পারছিলো না শুদ্ধতা আর নেই।ওর মন বারবার বলছিলো সব মিথ্যা বানোয়াট।এতোবছরে গড়া গোয়েন্দা মস্তিষ্কও বলছিলো এটা ষড়যন্ত্র।অতঃপর রৌদ্রুপ ডাক্তার বাহারের কল রেকর্ডিং চেক করতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেলো।তার মানে শুদ্ধতা বেঁচে আছে।এই একটা নির্ভরতা কতখানি স্বস্তি দিয়েছে তাকে সেটা বোঝানো সম্ভব না।রৌদ্রুপ মনে মনে বলল,’শুদ্ধ! চিন্তা করো না।খুব শীঘ্রই আমাদের আদুরে দিন শুরু হবে।সেই আদুরে দিন!

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here