সূর্যোদয় পর্ব ২৩

0
55

#সূর্যোদয়
#পর্ব_২৩
#কারিমা_দিলশাদ

৫৯.

এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। কালকে মারুফ তাকে মেসেজ করেছিল। যেখানে বলা হয়েছে তিনি আজকে ঐশীর ডিসিশন জানার অপেক্ষা করবে। রাত সাড়ে ১১টা বাজে এখন। ঐশী নিজের রুমে হাতে ফোন নিয়ে অনবরত পায়চারি করছে।

সে ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে, কিন্তু তার ভয় করছে এই ডিসিশন নিয়ে সে ভবিষ্যতে পস্তাবে না তো? ইশশ মেয়ে হয়ে না জন্মালে কত ভালোই না হতো! আল্লাহ তায়ালা তাকে অন্যকিছু তৈরি করতো তাহলেই তো এসব দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগতে হতো না। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এরপর কললিস্টে গিয়ে কল করে মারুফকে।

মারুফ ফোন নিয়েই বসেছিল। এই এক সপ্তাহ সে চরম টেনশন, উদ্বিগ্নতা নিয়ে ছিল। বারবার ভেবেছে ঐশী কখন ফোন দিবে, কখন ফোন দিবে…. কি বলবে এসব নিয়ে। তার ভাবনার মাঝেই ফোনে কল আসে। তার বুকটা কেঁপে উঠে ঐশীর ফোন না তো? ফোন হাতে নিয়ে দেখে, হ্যা। সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন কল। যার জন্য তার এতো অপেক্ষা। কিন্তু এখন এই ফোনটায় তার ধরতে ইচ্ছে করছে না।

ফোনটা ধরলেই ঐশী যদি না করে দেয় তখন? এতোক্ষণ তো তাও তার মনে মনে একটা আশা ছিল। সে কল্পনা করেছে ঐশী তাকে হ্যা বলবে কিন্তু ফোনটা ধরে যদি তার কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পায়। তাহলে?? সে রীতিমতো ঘামছে। কাঁপা কাঁপা হাতে সে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। খুব কষ্ট করে বলে,

“ হ্যা…লো?”

“ এসপি স্যার আ আমি ঐশী বলছি।”

“ জ্বি.. জ্বি ঐশী বলুন। আমি আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় করছিলাম। বলুন…. আ আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন?”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসছে না। মারুফ কান থেকে ফোনটা সামনে নিয়ে দেখে ফোনটা কেটে গেল কি না। না ফোনটা কা’টে নি। সে আবার ফোন কানে ধরে বলে,

“ হ্যালো হ্যালো? হ্যালো ঐশী আপনি শুনতে পারছেন? ঐশী? ”

ওপাশ থেকে কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। মারুফ আবার ডাকে,

“ ঐশী?”

“ হুমম..”

“ আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন?” — কাতর স্বরে শুধায় মারুফ।

“ আপনি আ আ আপনি আমার পরিবারে প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারেন। আ আমার কোনো আমার কোনো আপত্তি নেই। ” — কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো ওপাশ থেকে ভেসে আসতেই মারুফের ভিতর থেকে এক শান্তির শ্বাস বেরিয়ে আসে।

অথচ সে জানলো না ওপাশ থেকে এই কথাগুলো বলতে সেই নারীর ঠিক কতখানি কষ্ট হয়েছে। সেই নারীর চোখ থেকে না জানি কত অশ্রুকণা ঝরেছে।
মারুফকে কথাগুলো বলে ঐশী আস্তে আস্তে দেয়াল ঘেষে বারান্দায় বসে পড়ে। তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে মনে হবে ঐশী খুব বেশিই রিয়েক্ট করে ফেলছে। কিন্তু কেবল সেই জানে পুরুষদের প্রতি তার কতটা ঘৃণা, বিতৃষ্ণা। বিয়ে, প্রেম, ভালোবাসা এই শব্দগুলোকে সে ঠিক কতটা অবিশ্বাস করে।

৬০.

ঐশী তাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিয়েছে। সে ভেবে নেয় ঐশী হয়তো লজ্জা পেয়েছে। তাই মারুফ আর ফিরতি কল ব্যাক করে না। তার এখন খুব খুশি লাগছে। খুব খুব খুব খুশি লাগছে। তার জীবনে এমন খুশি হাতেগুনা দুবার’ই এসেছে। যখন সে বিসিএস ক্যাডার হয় এমন খুশি সে তখন হয়েছিল। দ্বিতীয়বার যখন তার প্রমোশন হয় তখন। এর আগে টিউশনি করে আর একটা দোকানে কাজ করে করে সংসার চালিয়েছে, এরপর চাকরি হতেই আস্তে আস্তে তাদের দিন বদলাতে শুরু করে।

পাত্রের বাজারে একসময় তার বেশ চাহিদা ছিল। অনার্স পাশ করে প্রথম বিসিএসেই যখন পুলিশ ক্যাডারে তার সুযোগ হয়ে যায় তখন থেকেই। এখনও আছে। তবে বয়স একটু বেশি হয়ে যাওয়াতে এখন অনেকেই একটু বাঁকা নজরে দেখে।

তখন পরিবারের কথা ভেবে এসব বিষয়ে কখনো নজর দেয় নি। তার মা-ও কখনো এ বিষয় নিয়ে কথা তুলে নি। হয়তো সংসারের কথা ভেবে কিংবা অন্য সন্তানদের কথা ভেবে। তার মা হয়তো ভেবেছে মারুফ যদি বিয়ে করে ফেলে আর এই সংসারে টাকা না দেয়। মারুফ বিষয়টা বুঝতো। কিন্তু আজকাল বেশ অবাক হয়, বেশ ভাবায় তাকে এই বিষয়গুলো।

মা-র কি কেবল চারটায় সন্তান? ও কি মায়ের সন্তান না? কেবল বাকিদের কথা, বাকিদের ভবিষ্যতের কথা এবং নিজের সংসারের কথা চিন্তা করে গেছে তার মা। কই তার কথা তো কখনো চিন্তা করে নি। এই যে দেখতে দেখতে বত্রিশ বছরে গিয়ে ঠেকলো তার বয়স। তার মা আজ পর্যন্ত তার বিয়ে নিয়ে কথা তুলে নি। তার কি কোনো ভবিষ্যৎ নেই?! এভাবেই কি চলবে?

কতকিছুই তো করলো পরিবারের জন্য। যখন তার বাবা মা’রা যায় তখন সে সবে ঢাবিতে ভর্তি হয়েছে। ওই সময় থেকেই সে এই সংসারের হাল ধরেছে। টিউশনির পাশাপাশি পার্টটাইম জব করে করে বাবার কিছু ঋণ ছিল, সেগুলো শোধ করেছে। মা’কে বলেছিল কিছু জমি বিক্রি করে ঋণগুলো শোধ করার কথা। কিন্তু তার মা মাথা পাতে নি। নিজের পড়াশোনা চালানোর সাথে সাথে বাকি চার ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ চালানো। সবার মুখের খাবার জোগানো। ছোট ভাইবোনদের আবদার মেটানো। বোনদের চাকরি, তাদের ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়া সব করেছে। আরও দুই ভাইদের পড়াশোনার খরচ এখনও দিচ্ছে।

কিন্তু তার মা কখনো একবারও তার খোঁজ জানতে চায় নি। যখন ঢাকায় ছিল প্রতিদিন ফোন দিয়ে এটা নেই, ওটা নেই, এটা লাগবে, ওটা লাগবে, এর কলেজের ফি লাগবে, ওর কোচিং এর ফি লাগবে এসব নিত্য কথা ঠিকই বলতো। কিন্তু আদর করে মারুফ খেয়েছে কি না, ও ভালো আছে কি না কখনো জানতে চায় নি। কেবল দুই ঈদে বাড়িতে আসতো। দেশেও থেকেও বিদেশিদের মতো জীবন ছিল তার।

তাদের গ্রামের বাড়ি মোহনগঞ্জ। এখন তার মা আর তার সবচেয়ে ছোট ভাই তার সাথেই থাকে। মেজো ভাইটা থাকে ঢাকা। সে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে। বোন দু’টোর তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারপরও তারা মাসের বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকে। যদিও তারা নিজেরাও চাকরিজীবী।

তবুও তার মা সারাক্ষণ এই বোনের এটা লাগবে, ওই বোনের ওটা লাগবে, এই ভাইয়ের এটা লাগবে, ওই ভাইয়ের ওটা লাগবে। কখনো এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে না সে কেমন আছে। তার সবচেয়ে ছোট ভাইটাই একমাত্র তার কষ্টটা একটু বুঝে। মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নেয়। তবে ওছাড়া অন্য কেউ তার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনটাও বোধ করে না।

তবে সে এখন বেশ বুঝে গেছে নিজের লাইফ স্যাটেল তার নিজেকেই করতে হবে। তাই যখন ঐশীকে তার ভালো লেগে যায় তখন আর অন্য কোনোকিছু সে চিন্তা করে নি। ‘ঐশী’ নামটা মনে হতেই তার মুখে এক বিস্তর হাসি ফুটে উঠে। আজ তার খুব শান্তিতে ঘুম হবে। ঐশীকে দেখার পর থেকে তো আর ঘুম দেখাই দেয় না।

আচ্ছা ঐশীর সাথে তার বিয়ে হওয়ার পর ঐশী তাকে ভালোবাসবে তো? না বাসলে সে বাসিয়ে নিবে সমস্যা নেই। সে খুব ভালবাসবে ঐশীকে। মেয়েটার চোখে সে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। ঐশীর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার পর জানতে পারে, এই মেয়েটাও জীবনে খুব একটা সুখী না। তার জীবনেও অনেক ইস্যু আছে। মেয়েটাও কষ্টে আছে।

মারুফ ঠিক করে বিয়ের পর ঐশীর সব স্বপ্ন সে পূরণ করার চেষ্টা করবে। সবসময় সব পরিস্থিতিতে সে ঐশীর পাশে থাকবে। তাদের খুব সুন্দর একটা সংসার হবে। খুব সুখে থাকবে তারা। ঐশীকে সে পৃথিবীর সব সুখ দিবে। ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না।
এসব কথা ভাবতেই ভাবতেই মারুফ গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

৬১.

আর ওদিকে ঘুম নেই দুজন মানুষের চোখে। একজন প্রেয়সীকে না পাওয়ার ব্যর্থতায় কাতর ও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। সাথে সাথে নিজেকেও পোড়াচ্ছে নিকোটিনের ধোঁয়ায়।

আর অন্য একজন নিজের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে শংকায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। সে জানে না ভবিষ্যতে কি হবে? কিংবা কি হতে চলেছে। সে সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা করছে।

প্রতিটা মানুষের ভিতরে আলাদা আলাদা ব্যাথা থাকে। এক আকাশের নিচে কত বিচিত্রতা। ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি, ভিন্ন ভিন্ন ব্যাথা, ভিন্ন ভিন্ন খুশি। কেউ মনের আনন্দে আরামের নিদ্রায় মগ্ন, কেউ বা ভিতরে ভিতরে কষ্টে জর্জরিত হয়ে কাটাচ্ছে নিদ্রাহীন রজনী।

#ক্রমশ……

( কপি করা নিষেধ। কেউ কপি করবেন না।

আজকে সবাই গল্প সম্পর্কে যার যার মতামত প্রকাশ করবেন প্লিজ। আশা করি কেউ এড়িয়ে যাবেন না। ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here