সূর্যশিশির পর্ব ৭

0
410

সূর্যশিশির
৭.
কালবৈশাখীর ঝড়ে থরথর করে কেঁপে উঠে রহিম মিয়ার চালাঘর। অরুনিকার খালু মঞ্জু তিনটে ছাতা নিয়ে সেদিকে ছুটে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে রহিম মিয়ার পুরো পরিবারকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন তিনি। জানালার পাশে বসে উক্ত দৃশ্যটির স্বাক্ষী হলো অরুনিকা। সে তার খালুকে ছোট থেকেই খুব সম্মান করে, এই ঘটনার পর হৃদয়ের ভক্তি আরো বেড়ে গেল। অরুনিকা ঘর থেকে বেরোনোর জন্য উদ্যত হতেই খুব কাছে কোথাও বজ্রপাত হয়। সে চমকে উঠে জানালার বাইরে তাকায়। বিজলির আলোয় চোখের পর্দায় দৃশ্যায়িত হয় সেই মানুষটির মুখ! সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। লজ্জায়, আড়ষ্টতায় টেনে দিলো জানালার পর্দা।
হীরা বাইরের মেঠোপথে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে ধরে রেখেছে কালো রঙের ছাতা। মনে হলো এদিকওদিক কিছু খুঁজছে। কী খুঁজছে? অরুনিকার মনে প্রশ্নটি ঘুরপাক খেতে লাগলো। খালার বাড়ি শহর থেকে বেশ দূরের একটি ছোট গ্রামে৷ এখানে এসেছে আজ তিনদিন। প্রতিটি মুহূর্তে যে ছেলেটির অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বক্ষের হাড়ে হাড়ে লটকে ছিল সে ছেলেটি আজ এতো কাছে! কী জন্য এসেছে এখানে? আমার জন্য? অরুনিকা টের পেল তার শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। সম্মোহনী একটা অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। সে থম মেরে চেয়ারে বসে রইলো।
চোখ বুজলেই হীরার মুখখানা ভেসে ওঠে। তার ললাটজুড়ে ছড়ানো চিকচিকে চুল, রুক্ষ ঠোঁটে রাখা সিগারেট, আর চোখের চাহনি; দৃশ্যটা মনের ক্যানভাসে সন্তপর্ণে আটকা পড়েছে। অরুনিকা আবার সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে চায়! সে দ্রুতবেগে পর্দা তুলে দিলো। কিন্তু একি! কোথায় সে? চারপাশে খুঁজেও মানুষটির দেখা পেল না। সত্যি কি এসেছিল? নাকি সবটাই দৃষ্টিভ্রম?
_
রাত বাজে দুটো। ঝড় হাওয়ার তাণ্ডবে গাছপালা ভেঙে পড়ছে। বিদ্যুৎ নেই ঘন্টাখানেক ধরে। রূপা দ্বিতীয় তলার ঈশান কোণে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। বৃষ্টির পানির ছিটা এসে লাগছে চোখেমুখে। এতে অবশ্য তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলো, কেউ আছে নাকি। এরপর অতি সাবধানে পুরু, শুকনো ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে রাখলো পাতলা কাগজে মোড়া ধূমপানের উপকরণবিশেষ।

মাঝেমধ্যে লুকিয়ে সিগারেট টানার কু-অভ্যাস রয়েছে তার। এ খবর কাকপক্ষীর দৃষ্টিগোচরেও নেই। তবে অরুনিকা বহুবার প্রশ্ন করেছে, তোর ঠোঁট দিন দিন কালো হচ্ছে কেন রে?

রূপা প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ থেকেছে। অরুনিকা বন্ধুর ঠোঁট আগের রঙে ফিরিয়ে আনার জন্য কোরিয়ান, জাপানিজসহ পাঁচ-ছয়টি দেশের লিপবাম এনে দিয়েছে তাতেও ঠোঁটের উন্নতি হলো না। কী করে হবে? যদি প্রতিদিন সিগারেট নামক নেশায় পুড়তে থাকে ঠোঁট! রূপা ধোঁয়া ছেড়ে চোখ বুজলো। বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে৷ আকাশের হুংকারে বারংবার প্রকম্পিত হয়ে উঠছে ধরণী। পরিবর্তন হয় না শুধু তার মুখের প্রতিক্রিয়া। সে খুব ছোটবেলা থেকে ঝড়ের তাণ্ডব, বজ্রপাত, ভূমিকম্প সব সহ্য করে এসেছে নীরবে, একা।

আবহাওয়া কিছুটা শান্ত হয়ে এলে রূপা শার্টের পকেট থেকে ফোন বের করলো। অরুনিকাকে ভীষণ মনে পড়ছে। আজ সারাদিন কথা হয়নি। কল দিতে গিয়ে মাথায় এলো, যদি ঘুমে থাকে তাহলে তো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। সে ফোনটা আবার রেখে দেয় বুকপকেটে। ঠিক তখনই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠলো। অরুনিকা কল করেছে! রূপা সিগারেট ফেলে কল রিসিভ করে।

‘এতো রাতে জেগে আছিস! ব্যাপার কী?’ পা দুটো টানটান করে বসলো সে।

অরুনিকা ছোট করে বললো, ‘এমনি।’

‘এমনি কী? কী করছিলি?’

‘কিছু না।’

রূপা আগ্রহান্বিত হয়ে বললো, ‘গলার আওয়াজ বিলাইয়ের মতো হয়ে আছে দেখি! কিছু বলবি?’

অরুনিকা দাঁত নখ দিয়ে খুটছে। রূপা কান খাড়া করে রেখেছে। ওপাশ থেকে অরুনিকা মিনমিনে সুরে বললো, ‘দোস্ত?’

‘শুনছি, বল।’

‘শোন না।’

‘বল না রে মা।’ রূপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
অরুনিকা বুকের কাছে বালিশ টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে ডাকলো, ‘দোস্ত?’

‘এই তুই ফোন রাখ।’

‘রাগ দেখাচ্ছিস কেন? বলছি তো।’

রূপা আবার চেয়ারে বসলো। অরুনিকা জানালা দিয়ে একবার বাহিরটা দেখলো। তারপর ঢোক গিলে বললো, ‘রূপা, রূপারে…’
সে থামলো। তারপর বললো, ‘আমার মনে হচ্ছে আমার খুব কঠিন অসুখ করেছে। ম’রেটরে যাবো। নয়তো পা’গল হয়ে পাগলাগারদে থাকবো।’

‘এসব কী ধরনের কথা! জ্বর-টর বাঁধিয়েছিস?’

‘না, না ওমন কিছু না। অন্য অসুখ, একদম আলাদা।’

রূপা চিন্তায় পড়ে গেল। বললো, ‘কেমন? কোথায় যন্ত্রণা হয়? পরিষ্কার করে বল।’

‘আমি নিজেও জানি না কোথায় অসুখ করেছে। শুধু অনুভব করতে পারছি, আমার ভীষণ অসুখ।’

রূপা ভাবলো। এরপর সাবধানে প্রশ্ন করলো, ‘কারো প্রেমে পড়েছিস?’

সঙ্গে সঙ্গে অরুনিকার ফকফকে গাল দুটো গোলাপি রঙ ধারণ করে। বুকের ভেতর অনুভূতির তরঙ্গ খেলে যায়। সে ফোন কানের সাথে চেপে ধরে বললো, ‘জা…জানি না।।’

রূপা হাসলো। অরুনিকা কখনো কারো প্রেমে পড়েনি। বরং প্রেম নিয়ে সবসময় সমালোচনা করেছে। কে সেই সু-পুরুষ যার প্রেমে অরুনিকা পড়লো। প্রেমে পড়ে মেয়েটার কণ্ঠই পরিবর্তন হয়ে গেছে! রূপা প্রবল উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলো, ‘ছেলেটা কে? কোথায় দেখেছিস?’

‘চিনি না। জানিস রূপা, মানুষটা কেমন করে যেন তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমি না…আমি ওই তাকানোটাই ভুলতে পারছি না। কিছুতেই না।’

রূপা নিজেও কেমন বাঁধভাঙা আনন্দ অনুভব করছে৷ অরুনিকা প্রেমে পড়েছে! সে সামনের খোলা জায়গাজুড়ে পায়চারি করতে করতে বললো, ‘কোথায় দেখেছিস সেটা বল আগে। আমি খুঁজে বের করে তোর সামনে নিয়ে আসবো।

‘তোদের বাজারে দেখেছি। তোকে খুঁজতে গিয়ে।’

রূপার ঠোঁটের হাসি নিমিষে উধাও হয়ে গেল৷ দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কোনদিকে দেখেছিস?’

অরুনিকা সেদিনের ঘটনা খুলে বলে। ছেলেটি ক্যারাম খেলছিল উল্লেখ করতেই রূপা অজানা আতঙ্কে ঘাবড়ে গেল। বাজারের পশ্চিম দিকে জুয়া খেলা চলে। জুয়া খেলার জের ধরে প্রতিদিন চলে হাঙ্গামা। ভালো ছেলে নিশ্চয়ই জুয়া খেলবে না। বহুবার পুলিশ এসে এসব পোলাপানদের ধরে নিয়ে গেছে। সেখানে আবার কাকে ভালো লাগলো অরুনিকার?

ওপাশ থেকে অরুনিকা অনবরত বলছে , ‘হ্যালো, রূপা? রূপা? হ্যালো…’

রূপা ভাবনা থেকে বেরিয়ে বললো, ‘ছেলেটা দেখতে কেমন?’

‘চুলগুলো সুন্দর, কপালে ছড়িয়ে ছিল। ফর্সা দেখতে।’

‘ঠিক আছে।’

রূপার হঠাৎ চুপসে যাওয়াটা টের পেরে অরুনিকা বললো, ‘কী হয়েছে ? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলি যে।’

সে মিথ্যা বললো, ‘আম্মা ডাকছে।’

‘এতো রাতে ডাকছে! বিপদ হলো নাকি?’

রূপা এক হাতে ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বললো, ‘গিয়ে দেখি। রাখ এখন।’

সে কল কেটে আরেকটা সিগারেট ধরালো। কে সেই মানুষ! দেখতে নিশ্চয়ই সুন্দর হবে। অরুনিকা সৌন্দর্যকে খুব বেশি মূল্য করে। কিন্তু যদি ভালো ছেলে না হয়? রূপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। ঠিক তখন হাট করে খুলে যায় সামনের বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার জানালা। রূপা ধড়ফড়িয়ে ওঠে। জানালার ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটি ভরাট পুরুষ কণ্ঠ, ‘দেশ তো উন্নতির জোয়ারে ভাসছে। মেয়ে মানুষ সিগারেট টানে!’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here