সূর্যশিশির পর্ব ৬

0
412

সূর্যশিশির
৬.
হেঁশেলে অরুনিকাকে না পেয়ে রূপা ক্যাশ কাউন্টারে এলো। তার চোখেমুখে উদ্বেগ স্পষ্ট।
বুকের ভেতর দুশ্চিন্তা দলা পাকিয়ে আছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সুজনকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘সুজন, অরুনিকা কোথায়? ভেতরে না ছিল।’

সুজন বললো, ‘ওস্তাদ, নায়িকা তো তোমারে খুইজা বাইর হইয়া গেল।’

রূপা খিটখিট করে ওঠলো, ‘আমাকে খুঁজে গেছে মানে কী? ওদিকে তো আমি ওরে দেখলাম না।’

রূপাকে রাগতে দেখে সুজন ঘাবড়ে যায়। কথা বলতে গিয়ে দেখে শব্দ বেরোচ্ছে না। রূপা টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘হা করে আছিস কেন? কথা বল, কোনদিকে গেছে?’

সুজন ঢোক গিলে বললো, ‘আমা…আমারে জিগাইলো রূপা কোনদিকে গেছে? আমি কইলাম ডাইনে গেছে। এরপরই গেল গা।’

রূপা দুই হাত কোমরে রেখে বললো, ‘বলতো ডান কোনদিকে?’

প্রশ্ন শুনে সুজন স্তব্ধ হয়ে গেল। ডানবাম নির্দেশনাতে সে সবসময় ভুল করে। রূপার কড়া দৃষ্টি তার রক্তে শীতলতা বয়ে দিচ্ছে। সে আঙুল তুলে ডানদিক ইঙ্গিত করলো। সঙ্গে সঙ্গে গালে থাপ্পড় পড়ে। সেকেন্ড কয়েকের জন্য চারিদিক ঝাপসা মনে হয় সুজনের। রূপা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো চেঁচিয়ে বললো, ‘এটা ডান নাকি বাম? আমি বাম দিকে কোক আনতে গিয়েছিলাম। তোরে কতবার আমি ডান-বাম শেখাব? এজন্য কাস্টমারদের সাথেও কতবার ঝামেলা হলো। এরপরও তোর শিক্ষা হয় না।’

সুজন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ‘তুমি যেমনে দিয়া গেলা আমি ওইডাই কইছি। খালি বাম না কইয়া ডাইন কইছি।’

‘তাহলে অরুনিকা যখন অন্যদিকে যাচ্ছিলো ওরে বললি না কেন?’

‘দেহি নাই তো। তহন কাস্টমার আইছিলো।’

রূপা আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলো না। বেরিয়ে পড়লো অরুনিকার খোঁজে। মেয়েটা যতবার বাজারে এসেছে বাইরে ঘুরার জন্য চুকচুক করেছে। এবার সেই সুযোগ লুফে নিল। বিপদ না ঘটিয়ে থামবে না। ডান দিকে বদমাশ ছেলেদের আড্ডাখানা৷ গেল তো গেল ওদিকেই গেল!

পকেট থেকে ফোন বের করে অরুনিকাকে কল করলো। ফোন ধরছে না! রূপা টের পেল বুকের ভেতরে অস্থিরতা নামক পোকাটা ধীরে ধীরে ব্যথা দিতে শুরু করছে। যেন খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে হৃদয়টা। কী হলো অরুনিকার? কল দিতে দিতে সামনের দিকে ছুটছে সে। তার দৃষ্টি অসহিষ্ণু, কাতর। বাজারের শেষ মাথায় অবস্থিত আবাসিক হোটেলটির সামনে এসে দাঁড়াতেই অরুনিকার সাড়া মেলে।

‘হ্যালো?’ অরুনিকার কণ্ঠ।

রূপা যেন ধুধু মরুভূমির মাঝে দৈবাৎ পানির কোয়া পেল, ‘অরু…অরু কই তুই? তোরে না বের হতে না করছিলাম। এখন কই তুই?’

‘পাপা কল করছিলো। আমি রিক্সায়, বাসায় যাচ্ছি।’ ওপাশ থেকে রিক্সার বেলের টুং-টুং শব্দ শোনা যাচ্ছে।

রূপা হাফ ছেড়ে বাঁচে। দমভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, ‘সাবধানে যা৷ তোর কোক আমি খেয়ে নিচ্ছি। গলা শুকিয়ে গেছে।’

‘খেয়ে নে। বাড়ির কাছে চলে এসেছি, রাখছি।’

‘আল্লাহ হাফেজ।’

_
হীরা ঝিম ধরে বসে আছে চেয়ারে। সে ভাবনায় মগ্ন। আকাশজুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ; দৃষ্টি সেখানেই নিবদ্ধ। তার একনিষ্ঠ সঙ্গী দুলালের উপস্থিতিতে সে সম্বিৎ ফিরে পেল। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো, ‘ মেয়েটির নাম কী? কোথায় থাকে? বাসার ঠিকানা এনেছিস?’

দুলাল দুই হাত তুলে হীরাকে শান্ত হতে বলে। এরপর বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বললো, ‘ভাই, ভাবি বিরাট বাড়ির মাইয়া। আমি একদম পিছু পিছু গেছি। একবারের জন্যেও চোখের পলক ফালাই নাই। ভাবির নাম অরুনিকা চৌধুরী। আইএ পাস করছে। ভাবির বাপে ভারসিটিতে ইংরেজি পড়ায়, মা হইলো ডাক্তর। ভাবির একটা বড় ভাই আছে। ভাই কানাডা সিটিজেন পাইছে। র’চত্বরের চার নাম্বার গলির সাদা রঙের ছয় তলা বাড়িটা ভাবির বাপের। তিন তলায় ভাবিরা থাকে। বাকি সব ফ্লেট ভাড়া দিয়া রাখছে। গ্রামেও নাকি বিরাট জমিদারি আছে। ভাবিদের গ্যারেজে দুইটা গাড়ি। তাও ভাবি কেন বোরকা পইরা এই বাজারে ঘুরঘুর করলো হেইডাই বুঝতাছি না। আবার রিক্সা দিয়া বাড়িত গেল৷ শুনলাম, হেরা নাকি ধর্মকর্ম মানে ভালো। ভাবির বাপ চরম রাগী। এই কামডা তোমার জন্য মেলা কঠিন হইবো হীরা ভাই।’

হীরার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। সে চুলে চিরুনির মতো হাত চালিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো, ‘ হয়ে যাবে কাজ। এইবার আব্বাও আমার উপর খুশি হয়ে বাড়িতে যেতে বলবে।’

‘তাইলে তো তোমার জন্যে এইটা আসলেই বড় কাজ।’

‘মাস শেষ হতেই দেখবি আব্বা আম্মার সাথে আবার এক ছাদের নিচে আছি। তুইও থাকবি সাথে।’

‘এইডাই যেন হয় হীরা ভাই। খালাম্মার রান্ধা ছাড়া জীবনটা কেমন নিরামিষ হইয়া গেছে। যা ই খাই মাটি লাগে।’

বছর দেড়েক পূর্বে কাজকর্ম না করায় হীরাকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, বাবার পকেট কেটে সিগারেট কেনা ছিল তার নিত্যকার ঘটনা। বাবা সেসব ছাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন পারলো না বের করে দিলো। বহুবার সে বাড়ি ফিরতে চেয়েছে; বাবা অনুমতি দেয়নি। বখাটেপনা আগে থেকে থাকলেও চাঁদাবাজিটা বাড়ি থেকে বের হয়েই শুরু হয়েছে।
জীবন ঝুঁকি নিয়ে চাঁদাবাজি করতে প্রথম প্রথম ভয় হলেও ধীরে ধীরে সে ভয় কাটিয়ে সন্ত্রাস হয়ে ওঠে৷ এখন দিনদুপুরে খুন করতেও হাত কাঁপে না। একবার চাঁদাবাজি করে অনায়াসে সারামাস পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দেয়।

হীরা দুলালকে নিয়ে বাজারের একটি বিল্ডিংয়ে দুই রুমের বাসা ভাড়া নেয়। বাজার থেকে র’চত্বর খুব কাছে। র’চত্বরে বাসা ভাড়া নেয়ার মতো সামর্থ্য তার নেই। এখান থেকেই অরুনিকাকে জয় করে নিতে হবে। এরই মধ্যে দুলাল হাড়ি পাতিল নিয়ে ফিরলো৷ হীরা বললো, ‘কী আজব! এখনো তো তোর ভাবি ঘরে আসেনি। হাড়ি পাতিল নিয়ে এলি কেন?’

‘হোটেলের খাওন খাইতে খাইতে সারাটাদিন বাথরুমে দৌড়াই। এইযে ব্লেন্ডার নিয়া আসছি। তুমি বাজার কইরা আনো আমি আজকে নিজে রাইন্ধা খামু।’

হীরা হাসলো। পাতিল হাতে নিয়ে বললো, ‘তুই রাঁধবি?’

‘হাইসো না ভাই। বড় জ্বালা নিয়া কিনে আনলাম। তুমি বাজার করে নিয়া আসো। আমি ভাত বসাই।’

হীরা বেশ আগ্রহ নিয়ে বাজার করতে বের হয়।
মুরগি কিনতে গিয়ে ঘটনাচক্রে দেখা হয় রূপার সাথে। রূপা হোটেলের জন্য মুরগি নিতে এসেছে। হীরাকে দেখে সে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই দেখা হয়েছে! রূপা দ্রুত নিজের দৃষ্টি সংযত করে।

হীরা রূপার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে বললো, ‘চাপিলা মাছ, দেখা হয়ে গেল তো আমাদের।’

রূপা হীরাকে এড়িয়ে মুরগিওয়ালাকে বললো, ‘মামা, আমাকে তিনটে মুরগি দিবেন ২ কেজি করে।’

সাথে সাথে হীরাও বললো, ‘আমাকে মামা তিন কেজির একটা দিবেন। চার কেজি হলে আরো ভালো। মাংস যেন বেশি থাকে। আমার আবার হাড্ডি ভালো লাগে না।’

হীরা হেসে রূপার আরো কাছে এসে দাঁড়ায়। রূপা বিরক্তি নিয়ে তাকালে সে রূপাকে চোখ মারলো। তাদের উচ্চতা প্রায় কাছাকাছি। মাত্র দুই ইঞ্চির তফাৎ। হীরা ক্ষীণ সুরে রূপার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘আচ্ছা তোমার সাইজ কত?’

রূপা দাঁতে দাঁত চেপে তাকায়। হীরা ফিক করে হেসে ওঠলো। রূপা কিড়মিড় করে বললো, ‘বেশি বার বাড়বেন না। সবসময় আমি ছেড়ে দেব না।’

হীরা নাটকীয় ভঙ্গিতে হাসলো। বললো, ‘ওবাবা! কী করবে? মারবে?’

রূপা দূরে সরে দাঁড়ায়। রাগে তার ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু সে কিছু করতে চায় না। চার বছর আগে বাজারে ভেজাল করতে গিয়ে তাদের হোটেলের খুব ক্ষতি হয়েছিল। সেই ক্ষতির মুখোমুখি আর সে হতে চায় না। দ্রুত মুরগি নিয়ে চলে যায়। হীরা একটা কাগজ কুড়িয়ে সেটা মুড়িয়ে রূপার পিছনে ছুঁড়ে মারলো।

চলবে….
(দুলাল চরিত্রটিকে দুই মেশালি ভাষায় কথা বলতে দেখে কেউ বিব্রত হবেন না৷ চরিত্রটিই এমন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here