সূর্যশিশির পর্ব ৫

0
427

সূর্যশিশির
৫.
রসন ভিলা বহু পুরনো বাড়ি। ঠিক কত বছরের পুরনো রূপার জানা নেই। বাড়িটির কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। নিচ তলা বাদে দুই তলা ও তিন তলা পুরো খালি৷ দুই তলার এক কোণে ছোট করে একটা রুম করে দিয়েছেন বারেক। সেখানেই রুপার নিবাস৷ বাড়ির সম্মুখপানে এক কাঠার মতো জায়গায় ছোট পরিসরে বাগান করা হয়েছে৷ রুমি আর রিনি বাগানের পরিচর্যা করে। তবে বাড়িটি তাদের নিজের নয়। অতীতে সুমনা ও বারেক নতুন বিয়ে করে এক রুম ভাড়া নিয়েছিলেন। একদিন বাড়িওয়ালা হুট করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এরপর থেকে তারা এখানে আছে। এই এতো বছরে কেউ এই জায়গার দখল নিতেও এলো না। রূপা মাঝেমধ্যে ভাবে, যদি বাড়িটা কখনো তাদের ছেড়ে দিতে হয় কোথায় যাবে? সাতজন সদস্যের সংসার। শহরে ভাড়া দিয়ে থাকা তো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তাছাড়া ভাড়াটিয়া হয়ে থাকা মানে মালিকের নানারকম শর্ত বহন করা! এর পূর্বেই টাকা সঞ্চয় করে নিজেদের একটা জায়গা করে নেয়া উচিত। কিন্তু সুমনা বা বারেকের সেই চিন্তা একেবারে নেই। তারা এমনভাবে থাকে যেন এটাই তাদের বাড়ি, বাপ-দাদার ভিটা! রূপা গলায় গামছা ঝুলিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বাগানের ফুলগাছে সেচনীর সাহায্যে পানি দিচ্ছে রুমি।

রূপা পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ভালো করে পানি দে। কয়দিন ধরে দেখছি গাছগুলো কেমন শুকিয়ে থাকে।’

রুমি না তাকিয়ে রূঢ় কণ্ঠে বললো, ‘তোর কাজে তুই যা আপা। আমার কাজ আমি ঠিকভাবে করতে পারি।’

রূপা গামছাটা গলা থেকে নিয়ে কোমরে বেঁধে বললো, ‘তোরে গতকাল গলির মুখে রাজন মিয়ার পোলার লগে আলাপ করতে দেখলাম। কী চলছে তোদের?’

এবার রুমির টনক নড়ে। সে ঘাবড়ে যায়।পনেরো বছরের কিশোরী রুমি সদ্য প্রেমে পড়েছে। প্রেমের প্রথম দিনই ধরা পড়ে যাবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। ভয়ে বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। আম্মা জানলে মার একটাও মাটিতে পড়বে না। কিন্তু রূপার সামনে দূর্বলতা প্রকাশ করার মেয়ে সে নয়। মুখ গম্ভীর করে ফিরে তাকালো।

বললো, ‘কী চলবে? নোট চেয়েছিল, দিয়েছি।’

রূপা সন্দিহান চোখে রুমিকে আগাগোড়া দেখলো। রুমি এক হাত দিয়ে অন্য হাত বার বার স্পর্শ করছে। তার দৃষ্টি অস্থির। রূপা নিশ্চিত, রুমি প্রেম করছে৷

সে বললো, ‘মাত্র এইট পাস করলি। এখনি এসব কী? তাছাড়া রাজন মিয়া নিজে বদমাশ তার পোলাপানও বদমাশ। ব্রেকাপ করবি নয়তো আমি আম্মারে সব বলে দেব।’

হুমকি দেয়াতে রুমি ছ্যাৎ করে ওঠলো, ‘আম্মারে বলবি? বল, যা। তোরে আম্মা চার আনা দাম দেয়? তোর কথা জীবনেও বিশ্বাস করবে না।’

‘না করলে নাই। আমার বলা আমি বলবো।’

‘তুই প্রেম করস নাই?’

‘কই করতে দিলি? তখন তো আম্মারে তোরাই বললি। আর আমি প্রতিদিনই মার খাই, বকা খাই, গালি শুনি। তোর জন্য কিন্তু নতুন হবে৷ আমি সুযোগ দিচ্ছি। রাজন মিয়ার পোলার সাথে আর চলিস না। এই পোলা তোর বান্ধবী পিংকির সাথেও লাইন মারে। খোঁজ নিলেই জানতে পারবি। এখন গাছে পানি ঢাল, যা। সামনে থেকে সর।’

রূপা রুমিকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল। এই ধাক্কাটার জন্য প্যাচপ্যাচ করে কেঁদে মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করবে রুমি। রাতে বাড়ি ফিরলেই সুমনা এসে রূপার কানের কাছে ক্যাচক্যাচ করবে। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। রুমিকে ধাক্কা মেরে চলে আসতে পেরেছে এতেই খুশি সে।

রূপা মনে মনে রাতের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলো, ‘হোটেল থেকে খেয়ে বাড়ি ফিরে দৌড়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেব। আম্মা মশার মতো জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভনভন করে ঠিক একসময় চলে যাবে।’

রূপার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। মনটা ফুরফুরে আজ। সবকিছু ভালো লাগছে। অরুনিকার সাথে দেখা হলে আরো ভালো অনুভব হতো৷ কিন্তু আজ অরুনিকা খালার বাসায় চলে যাবে৷ খালার নাকি মেয়ে হয়েছে।

_
রূপা হেঁশেলে ঢুকে বিস্মিত হলো। অরুনিকা আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে। বারেক মিয়ার সাথে জমিয়ে আলাপ করছে। রূপা অবাক কণ্ঠে বললো, ‘তোর না কোথায় যাওয়ার কথা। যাসনি?’

রূপার চমকে যাওয়া দেখে অরুনিকার আনন্দ হচ্ছে৷ বললো, ‘যাব তো কিন্তু বিকেলে। পাপা আর মা আন্টির মেয়ের জন্য গিফট কিনতে গেছে। ভাবলাম, এই সুযোগে তোকে দেখে যাই।’

‘ভালো করেছিস। আমাকে তো চমকে দিলি তুই।’

বারেক গদগদ হয়ে দুজনের কথার মাঝে ঢুকে গেলেন , ‘মা জননীরে কখন থেকে বলছি কিছু খেতে। কিছুই খায় না। বলে, রূপা আসলে খাব।’

রূপা বললো, ‘ও বাইরের খাবার খায় না আব্বা৷ তুমি বাড়ি যাও। আম্মা যেতে বলছে। আমি দুপুরের সব রান্না সেড়ে ফেলবো। আযানের সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়ো।’

বারেক যাওয়ার আগে অরুনিকাকে বললেন, ‘আসি মা জননী? রূপা তুই কিছু খেতে দিস।’

অরুনিকা মাথা কাত করে বললো, ‘আসেন আংকেল।’

বারেক মিয়া চোখের আড়াল হতেই অরুনিকা রূপাকে বললো, ‘আংকেল অনেক ভালো।’

রূপা আলগা করে হাসলো। অরুনিকা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভাবলো। এরপর বললো, ‘কিন্তু বোকা।’

রূপা হাতে পেয়াজ ও ছুরি নিয়ে বললো, ‘আম্মা যা বলে তাই করে। নিজের জ্ঞানে চলতে পারে না, বেশিই সরল। নয়তো মানুষ হিসেবে সৎ। এখন কী খাবি বল?’

‘কোক খেতে ইচ্ছে করছে।’

রূপা পেয়াজ কাটতে কাটতে বললো, ‘তুই বোরকাটা খোল আর অপেক্ষা কর। আমি নিয়ে আসছি। ক্যাশ কাউন্টারে সুজন থাকবে। কিছু দরকার পড়লে বলিস। ভুলেও বের হবি না।’

অরুনিকা দুই ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘সুজনকে পাঠা। তুই যাচ্ছিস কেন? তুই এখানে থাক।’

‘আমি পাঁচ মিনিটে চলে আসবো। সুজন গেলে বিশ মিনিট লাগিয়ে দিবে। তুই বস। বাজারেই তো।’

‘আচ্ছা যা।’

রূপা যাওয়ার পরপরই অরুনিকার মনে হলো, দুজন একসাথে গিয়েই কিনতে পারতো। এই সুযোগে রূপার সাথে বাজারটাও হাঁটা হয়ে গেল। কখনোই তো পুরোটা বাজার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অরুনিকা দ্রুত নিকাব পরে দৌড়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। রূপা নেই। নিমিষে উধাও! সুজন পেছন থেকে ডাকলো, ‘এই যে নাইকা, কই যান?’

‘রূপা কোনদিকে গেছে?’

‘কুক আনতে গেছে? তাইলে ডাইনে গিয়া এক্কেবারে শেষ মাথাত যান। তাইলে পাইবেন।’

অরুনিকা কোনদিকে যাচ্ছে না দেখেই সুজন একজন খরিদ্দারকে সিগারেট দিতে নতজানু হলো।

_
অরুনিকা ডান দিকে হাঁটতে শুরু করে। তার গ্রাম্য পথের মতো বাঁকা ভ্রুজোড়ার ঠিক নিচে থাকা কাজল কালো আঁখিদ্বয় উৎসুক হয়ে চারপাশ দেখছে। এটি বৃহৎ বাজার। মাছ, সবজি, আসবাবপত্র, জামাকাপড় সবকিছু এখানে আছে। হোটেলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

হীরা ক্যারাম খেলায় মগ্ন। পরপর বারোটা সিগারেট শেষ করে তেরো নাম্বার সিগারেটটি দুই ঠোঁটের মাঝে রাখলো। ক্যারামবোর্ডের জায়গা থেকে দশ ফুট দূরত্বে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা বসেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘিরে রেখেছে তাকে। বাচ্চাদের হৈচৈ কানে লাগছে খুব। হীরা চাঁদাবাজি করে যা পেয়েছিল সব প্রায় শেষের দিকে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ভাগ্য সহায় হচ্ছে না। যখন যেখানে যাচ্ছে বাজিতে বার বার হেরে ফিরছে। এরকমটা কখনো হয়নি। আজকে হারলে পকেট একেবারে শূন্য হয়ে পড়বে। চিন্তায় কপালের রগগুলো দপদপ করছে তার। দুই দলই সমান সমান পয়েন্ট নিয়ে শেষ ধাপে আছে।

হাওয়াই মিঠাই দেখে অরুনিকা সেদিকে এগিয়ে এলো। বহুদিন পর হাওয়াই মিঠাই দেখলো সে। ছোটবেলায় খুব খাওয়া হলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে খাওয়াটা কমে গিয়েছে। তাছাড়া খুব একটা দেখাও যায় না। সে হাওয়াই মিঠাই কেনার আগ্রহ প্রকাশ করলো, ‘মামা, আমাকে একটা দিন।’

মেয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনে হীরাসহ বাকি তিনজন খেলোয়ার ও ক্যারামবোর্ডের আশেপাশে থাকা সবগুলো ছেলে ঘুরে তাকায়। বাজারের এ পাশটায় জুয়া খেলা, হাঙ্গামা, রাজনীতি চলে। একটা আবাসিক হোটেলও আছে। টাকা ঝাড়লেই রাতে মেয়ে পাওয়া যায় সেখানে। বস্তির বাচ্চাকাচ্চা এদিকে এলেও কোনো নারী আসে না। খেলার টান টান উত্তেজনা চলছে তাই তারা দৃষ্টি সরিয়ে খেলায় মনোযোগ ধরে রাখলো।

বাচ্চাগুলোকে ওমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরুনিকার মায়া হলো। মিঠাইওয়ালাকে বললো, ‘সবগুলো বাচ্চাকে একটা করে দিন। টাকা আমি দিচ্ছি।’

হীরা আবার তাকায়। মেয়েটার কথাবার্তা পরিষ্কার, সুন্দর! তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে আরাম লাগছে। সে সিগারেট ফেলে আঙুলের সাহায্যে স্ট্রাইক দ্বারা গুটিতে আঘাত করে। আশ্চর্যভাবে একসাথে তিনটে গুটি পকেটে পড়ে গেল! এতক্ষণ কিছুতেই হচ্ছিলো না। বার বার লক্ষভ্রষ্ট হচ্ছিলো!

সবগুলো বাচ্চার হাতে হাওয়াই মিঠাই দিয়ে মিঠাইওয়ালা বললো, ‘একসো বিস টেকা অইলো।’

‘দাঁড়ান দিচ্ছি।’

হীরা তৃতীয়বারের মতো তাকালো। স্ট্রাইক ঘুরে তার দিকে এসেছে। সে দ্রুত স্ট্রাইক দিয়ে গুটিতে আঘাত করে। পকেটে আরো দুটো গুটি পড়ে। পরপর স্ট্রাইক গ্রহণের সুযোগ পেতে থাকে সে।

অরুনিকা নত হয়ে ব্যাগ থেকে টাকা নিতে গেলে বার বার নিকাব তার ডাগর চোখ দুটি ঢেকে ফেলে। এতে টাকার হিসাব করতে সমস্যা হয়। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন পারলো না অধৈর্য হয়ে নিকাব তুলে ফেললো। ঠিক সেই মুহূর্তে হীরা লাল গুটি পকেটে ফেলে দিলো। চিৎকার করে ওঠে তার দলবল। হীরা হেসে চতুর্থবারের মতো ফিরে তাকায়। চিৎকার শুনে তাকালো অরুনিকাও। মুহূর্তে তার কৃষ্ণকায় হরিণী মায়াবী চোখের ছত্রছায়ায় আটকে গেল হীরা।

অরুনিকা মিঠাইওয়ালাকে টাকা দিয়ে নিকাবে ঢেকে ফেললো তার সুন্দর মুখশ্রী। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল অঘটন। হীরার নজর তীরের বেগে ভেদ করে হৃদয়। বুকের ভেতর কিছু একটা হাট করে খুলে যায়। মিষ্টি ঘ্রাণের ছোঁয়া লাগে নাকে। বোধহয় হাওয়াই মিঠাইয়ের ঘ্রাণ। অরুনিকা উলটো ঘুরে দ্রুত হাঁটতে থাকে। রূপা কোথায়? ব্যাগের ভেতর ফোন ভাইব্রেশন হচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here