সূর্যশিশির পর্ব ৪

0
511

সূর্যশিশির
৪.
বার্তার টুংটাং শব্দ শুনে বই থেকে চোখ তুলে তাকালো অরুনিকা। তখন ভোর ছয়টা। এ সময় রূপা ঘুমে বিভোর হয়ে থাকে। তাহলে আর কে আছে বার্তা পাঠানোর মতো? উৎসুক হয়ে ফোনটা হাতে নিলো। পর্দায় আবিরের নাম দেখে ভারি চমকালো সে ; কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ সৃষ্টি হয়। বার্তাটি –

“আমার সম্পর্ক ভাঙার দুঃসাহস কী করে হয় তোমার? তুমি কি রূপার প্রতি আলাদা কিছু অনুভব করো?”

অরুনিকা আবিরের প্রশ্নে আশ্চর্য হলো। সে সময় নিয়ে প্রত্যুত্তরে লিখলো-
“ঠিক ধরেছেন। আমি রূপার প্রতি আলাদা কিছু অনুভব করি, রূপাও অনুভব করে। আমরা বড় হয়ে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে ব্রিটিশদের দেশে চলে যাবো। সেখানে গিয়ে বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে সংসার করবো। আপনাকে আমাদের সংসার লাইভ করে দেখাব।’

বার্তাটি পাঠানোর পর সে দশ মিনিট অপেক্ষা করলো। এরপরও উত্তর না আসায় ফোনটি বিছানার উপর রেখে ব্যালকনিতে গিয়ে বই নিয়ে বসলো। আবির ছেলেটাকে সে ভীষণ অপছন্দ করে। রূপার পাশে দেখলে গায়ে ফোস্কা পরার মতো অনুভূতি হয়। বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে ডুব দিতেই সেলিনা হক এলেন। মেয়ের পাশে বসে আদুরে গলায় বললেন, ‘চুলগুলো আঁচড়ে নিতি মা। এলোমেলো হয়ে আছে।’

‘পড়াশোনার এতো চাপ, চুল আঁচড়ানোর সময় আছে?’

‘আমি আঁচড়ে দেই?’

‘উহু, এখন বিরক্ত করো না মা।’

সেলিনা চুপ হয়ে গেলেন। অরুনিকা একমনে বই পড়ছে। তার বেণির কিছু চুল বিচ্ছিন্ন হয়ে কানের দু’পাশে দুলছে। সেলিনা অপলক চেয়ে রইলেন।

মিনিট ত্রিশ পর তিনি রয়ে সয়ে বললেন, ‘একটা কথা বলি ?’

অরুনিকা বই থেকে মুখ না তুলে বললো, ‘বলো।’

‘গতকাল রাতে কোথায় গিয়েছিলে?’

অরুনিকা বিব্রত হয়ে ওঠলো। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘কোথাও যাইনি। রুমেই তো ছিলাম।’

‘তোমার বোরকা বারান্দায় ঝুলতে দেখেছি। তুমি রূপার কাছে গিয়েছিলে?’ সেলিনার কণ্ঠ শান্ত, ধীর।

‘বললাম তো মা, যাইনি কোথাও।’

বাইরে দুটো কাক ডাকছে। সেলিনা কাক দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু দারোয়ান তো বললেন বের হয়েছো।’

পুরোপুরিভাবে ফেঁসেছে সে। আর অস্বীকার করার পথ নেই। তাই কপট রাগ নিয়ে মা’কে এড়ানোর চেষ্টা করলো, ‘কেন বিরক্ত করছো মা? পড়তে দাও না। এসব কথা তো পরেও বলা যাবে।’

সেলিনা হক কথা শেষ না করে থামার পাত্রী নন। তিনি বললেন, ‘তোমার পাপা অনেকবার বলেছেন, রূপার সাথে না মিশতে৷ মেয়েটা অন্য পরিবেশে বেড়ে ওঠেছে। শার্ট-প্যান্ট পরে ঘুরে, প্রতিদিন এক গাদা পরপুরুষের মাঝে কাজ করে। তুমি….’

অরুনিকা চট করে সেলিনার মুখের কথা কেড়ে নিল, ‘এমন করে কেন বলছো? কোনো কাজ তো ছোট না মা। রূপার সব কথা তো আমি তোমাদের বলেছি। ও তো ইচ্ছে করে, ওরকম পরিবেশে বেড়ে ওঠেনি। রূপা খুব ভালো ও দুঃখী মেয়ে। আমি রূপার সঙ্গ কখনো ছাড়বো না।’

সেলিনা অরুনিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘পাপার সাথে ভেজাল করো না সোনা। পাপার রাগ, জেদ সম্পর্কে তো জানো তুমি। জানো না?’

‘পাপা তো বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে। তুমি বলো না কিছু তাহলেই হবে।’

সেলিনা কথা বাড়ালেন না। কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ছেলেটাকে হারিয়েছেন, মেয়েটাকে হারাতে চান না। তিনি রুম ছেড়ে বেরোতে বেরোতে আক্ষেপের সুরে বললেন , ‘এতো দয়া কেন যে তোমার মনে!’

_
অরুনিকা আর পড়ায় মনোযোগ দিতে পারলো না। ভেতরটা তেতো অনুভূতিতে উথলে ওঠছে। রূপাকে কেউ নিচু চোখে দেখুক সে চায় না। কিন্তু তার চাওয়াতে কার কী যায় আসে? সে থম মেরে বসে রইলো। চক্ষুদ্বয়ে বৃষ্টির পূর্বাভাস।
হঠাৎ খেয়াল করলো, বাসার সামনে আবির দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনে টুং করে শব্দ হলো। ব্যাপার কী? অরুনিকা দ্রুত বিছানা থেকে ফোন নিয়ে দেখলো, আবির তাকে নিচে যেতে বলছে! সরাসরি কিছু কথা বলতে চায়। অরুনিকা তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তরে লিখলো-

” যা বলার ফোনে বলুন। আমি এখন আসতে পারবো না। আর নয়তো আগামীকাল দেখা করুন।”

আবির নাছোড়বান্দা। সে সরাসরিই কথা বলতে চায়। বেশ কয়েকবার বুঝিয়েও তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা গেল না। হয় অরুনিকা গিয়ে কথা বলবে নয়তো সে জায়গা ছাড়ছে না। বাধ্য হয়ে অরুনিকা দৌড়ে নিচে নেমে এলো। গেইটের বাইরে বের হতেই আবির চপল পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। অরুনিকা কপট রাগ নিয়ে বললো, ‘দেখুন ভাইয়া, এইটা আপনার এলাকা না। এভাবে আপনি আমার বাসার সামনে আসতে পারেন না। মানুষ দেখলে আমার পরিবারের নাক কাটা যাবে। আমার বাবা দেখলে আমাকে খু’ন করবে।’

আবির বললো, ‘আমি কিছু কথা বলেই চলে যাবো। বেশি সময় নেব না।’

অরুনিকা চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো, ‘দ্রুত বলুন।’

‘আমি জানি তোমাদের মধ্যে আলাদা কিছু নেই। সবটাই বন্ধুত্ব।’

অরুনিকা দুই হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে বললো, ‘তাহলে তখন জিজ্ঞাসা করলেন কেন?’

আবিরের চোখেমুখে অস্থিরতা। তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত চলছে। সে বললো, ‘রাগ থেকে বলেছি। তুমি প্লিজ, রূপা আর আমার সম্পর্কটা ঠিক করে দাও। প্লিজ অরুনিকা। আমি এই মাসেই রূপাকে বিয়ে করবো। ও’কে আর হোটেলে কাজ করতে হবে না। কারো অবহেলাও পেতে হবে না৷ আমার কাছে খুব সুখে থাকবে। তুমিতো ওর সুখই চাও, তাই না?’

অরুনিকা জবাবে চুপ রইলো। আবির বললো, ‘আমাকে এতো হিংসে করো না। আমি তোমাদের বন্ধুত্বে বাঁধা হবো না। আমার চাচাতো ভাই বুয়েটে পড়ছে৷ দরকার পড়লে তুমি তাকে বিয়ে করে রূপার কাছে চলে আসবে। আমি বিয়ের সব দায়িত্ব নেব। আমার ভাই যেমন মেধাবী, তেমন সুন্দর। পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। তোমার সাথে খুব ভালো মানাবে। দুই বান্ধবী একসাথে থাকবে।’

অরুনিকার মন-মস্তিষ্ক ধরেই নিয়েছে যা-ই হয়ে যাক আবিরের সাথে রূপাকে সে জুড়বে না। তাই এতো কথাতেও তার মধ্যে পরিবর্তন এলো না। সে বললো, ‘রূপা আপনাকে রিজেক্ট করেছে। ও আপনাকে ভালোবাসলে নিশ্চয়ই রিজেক্ট করতো না।’

‘ও তোমার জন্য এমন করেছে। রূপা অন্ধের মতো ভালোবাসে তোমাকে। তুমি বললে বিষও খাবে।’

‘আমি কখনো রুপাকে বিষ খেতে বলবো না। তাছাড়া আসল কথা হলো, রূপা আপনাকে ভালোবাসে কিনা! আপনি কালজয়ী প্রেমকাহিনীগুলো পড়েননি? ভালোবেসে নিজের জীবন ত্যাগ করে, বাবা-মা, ভাইবোন সবাইকে বিসর্জন দেয়। আমিতো বন্ধু মাত্র। আপনি ওভাবে রূপাকে প্রলুব্ধ করতে পারেননি তাই ওর মনে তীব্র কোনো অনুভূতি নেই আপনার জন্য। যদি থাকতো, আমাকে ভুলে আপনার হাতই ধরে রাখতো।’

আবির দুই হাতে মুখ ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরপর বললো, ‘প্লিজ অরুনিকা? আমাকে একটু বুঝো।’

অরুনিকা বিরক্ত গলায় বললো, ‘আপনি যান ভাইয়া, অনুরোধ করছি। আর কথা বাড়াবেন না। অনেক সময় নিয়েছেন। এবার যান।’

সে গেইটের ভেতর পা রাখতেই আবিরের রাগ মিশ্রিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘রূপার জীবন তুমিই ধ্বংস করবে৷ তুমি একটা দু’মুখো সাপ। রূপার কাছে সবসময় ভালো মানুষ সেজে থাকার নাটক করো।’

রাগে-অপমানে সঙ্গে সঙ্গে অরুনিকার পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্বিগুণ রাগ নিয়ে বললো, ‘রূপা আপনার থেকে বেটার জীবনসঙ্গী ডিজার্ভ করে। সময় এলে আমি নিজে ওর জন্য সেই মানুষটাকে খুঁজে বের করবো। কী মনে করেছেন? আপনার ফ্যামিলি হিস্ট্রি আমি জানি না? আপনার মা উচ্চতায় চার ফুট, বাবা পাঁচ ফুট। আর আপনার উচ্চতা পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি। আপনি চান একটা লম্বা মেয়ে বিয়ে করে লম্বা লম্বা ছেলেমেয়ে জন্ম দিতে৷ চার বছর লম্বা মেয়ে খুঁজেছেন কিন্তু সব জায়গায় রিজেক্ট হয়ে আমার রূপার উপর নজর দিয়েছেন৷ অসহায়ত্বের নাটক করে ওর মনে সহানুভূতি জাগিয়ে সম্পর্কে জড়িয়ে নিলেন! আপনি ওর হৃদয়কে কখনো ভালোবাসেননি। ওর উচ্চতাকে ভালোবেসেছেন। আর আপনার নিজের বাড়ি আছে? রূপাকে রাখার মতো? নাকি পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি রূপার পাশে দাঁড়ানোর মতো উচ্চতা আছে? হাঁটেনও তো পা টেনে টেনে। সবদিক দিয়ে আপনি অযোগ্য। আমি বেঁচে থাকতে কখনো রূপাকে আপনার হাত ধরতে দেব না। আর জীবনে আমার চোখের সামনে আসবেন না।’

কথা শেষ করে ঠাস করে গেইট বন্ধ করে দিল অরুনিকা। এ অধ্যায়ের শেষ এখানেই ঘটুক।

চলবে…
(একদিন পর পর নতুন পর্ব দেব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here