সূর্যশিশির পর্ব ২৩

0
277

সূর্যশিশির
২৩.
পিচঢালা রাস্তা, দুই পাশে সারি সারি গাছ৷ রূপা দ্রুতবেগে এগোচ্ছে৷ গরমের জন্য তার মাথায় ক্যাপ নেই, চুল ঝুঁটি করে রাখা; গায়ে লঘু বেগুনি রঙের বড় সাইজের টি-শার্ট। নিজ মনে যখন রুমি আর অরুনিকার কথা ভাবছিল তখন দৈবাৎ রাস্তার বিপরীত দিক হতে ফাইয়াজের বাইকটিকে আসতে দেখল। কালো রঙের বাইকটি নিত্যদিন দেখা দেয়, তাই চিনতে অসুবিধে হলো না। কালো শার্ট পরিহিত ফাইয়াজের চোখে আজ চশমা নেই। নিজের অজান্তে রূপার সাইকেলের গতি হ্রাস পেল।

পাশ কেটে যাবার সময় ফাইয়াজ এমনভাবে রূপাকে দেখল, যেন শত্রুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছে। রূপা পিছনে ফিরে নিজ মনে আওড়াল, “আজব!”

অন্যদিকে মনোনিবেশ করায় সাইকেলের ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছিল, রূপা দ্রুত সামলে নিলো।

তখনই বেজে ওঠল ফোন। রূপা সাইকেল এক পাশে দাঁড় করিয়ে কোমরের লেদারের ব্যাগ থেকে ফোন বের, স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে অবাক হলো।
রিসিভ করল, “হ্যালো?”

ওপাশ থেকে ভেসে এলো প্রবল ভাবাবেগ, “রূপা!”

রূপার বুক ছলাৎ করে ওঠে। ফোন শক্ত করে কানের সঙ্গে ধরে বলল, “তোকে ফোনে পাই না কেন? ছাদে কী করিস? আন্টি কী ফোন দেয় না? তোকে কত কি বলার আছে জানিস? আর একদিন পার হলে কথার চাপেই মরে যেতাম।”

অরুনিকা চাপাস্বরে বলল, “তোকেও অনেক কথা বলার আছে। মা ফোন দেয় না। পাপা পরের সপ্তাহ চলে যাবে সিঙ্গাপুর তখন আমরা আবার প্রতিদিন দেখা করব। কেমন আছিস তুই?”

“আর বলিস না, রুমি কার সঙ্গে যেন পালিয়ে গেছে!”

“কী!” অরুনিকা চমকে গেল। বলল, “কবে?”

“গত পরশু৷ এখন রুমিকেই খুঁজছি, রাস্তায় আছি।”

“এখন তাহলে রাখি?”

“না রাখতে হবে না৷ পরে আবার কখন না কখন কথা হয়। আমি সানাদপুর থেকে বের হয়ে রাস্তার একপাশে সাইকেল রেখে গাছের গুঁড়িতে বসলাম। কেমন আছিস? ঠিকমতো পড়াশোনা করছিস?”

অরুনিকা অপাঙ্গে হিরণকে এক পলক দর্শন করে বলল, “দোস্ত, আমি সেই মানুষটাকে পেয়েছি।”

রূপা সবিস্ময়ে বলল, “কোন মানুষ?”

অরুনিকা কপাল কুঁচকে বলল, “ওইযে, বাজারে দেখেছিলাম। ওর নাম হিরণ মজুমদার। আমাকে খুঁজে বের করে, আমাদের বিল্ডিংয়েই উঠেছে।”

রূপা উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে বলল, ” তখন থেকে তোর পিছু নিয়েছে?”

রূপার আতঙ্কিত গলার স্বর শুনে অরুনিকা বলল, “তেমন কিছু না৷ ছেলেটা অনেক ভালো আর ভীষণ সুন্দর। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ফিজিক্স নিয়ে পড়ে৷ ভদ্র, মার্জিত বাচনভঙ্গি। চারদিন ধরে প্রতিদিন আমাদের কথা হয়৷ জানিস, খুব সুন্দর গিটারও বাজায়৷ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি দোস্ত।”

ফিসফিসিয়ে সাবধানে বলল অরুনিকা।

রূপা বলল, “ফিসফিস করে কথা বলছিস কেন? রুমে তুই?”

“না ছাদে। হিরণের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ওর ফোন দিয়েই তোকে কল করেছি।”

রূপা তড়িৎগতিতে নাম্বারটা পুর্নবার দেখল। কে এই হিরণ মজুমদার? রূপার খুব অস্থির লাগছে।
সে বলল, “এতোই মিশে গেছিস যে ফোন দিয়ে দিলো! এতো কথা বলবি না, আমি আগে ছেলেটাকে দেখব।”

অরুনিকা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, “তোর খুব পছন্দ হবে৷ পাপা চলে যাবার পর আমি মিট করিয়ে দেব।”

“না, না। এত দেরি কে করবে? আমি আজই আসব।”

“এখন তো চলে যাবে। তুই বরং হিরণকে কল দিয়ে বাহিরে দেখা করে নে। আমি ওকে বলে দেব।”

“মিট করবে?”

“আমি বলব। আমার বিশ্বাস, আমার কথা রাখবে।”

“আচ্ছা। বলে দিস তাহলে, রাতে আমি কল দেব।”

“ঠিক আছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা। দ্রুত আর সাবধানে বাড়ি যা৷ রুমি নিজেই ফিরে আসবে দেখিস।”

“তাই যেন হয়৷ রাখছি তাহলে। আমি কিন্তু রাতে এই নাম্বারে কল দেব।”

“আচ্ছা। আমি বলে দিচ্ছি।”

অরুনিকা কল কেটে ফোনটা হিরণের হাতে দিয়ে বলল, “আমি আরেকটা অনুরোধ করতে চাই।”

হিরণ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “করো না।”

“আমার বন্ধু তোমাকে দেখতে চায়। কেউ আমার নতুন বন্ধু হলেই ও দেখতে চায়, সেই মানুষটা কেমন। আমাকে খুব ভালোবাসে তো তাই কেয়ারিং বেশি। যদি তোমার সমস্যা না হয়, দেখা করবে?”

হিরণকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা গেল৷ অরুনিকা বলল, “জোর করছি না। তোমার ইচ্ছে।”

হিরণ কিছু একটা ভাবার নাটক করে বলল, “উম! এক শর্তে তোমার বন্ধুর সাথে দেখা করব।”

অরুনিকা হেসে বলল, “শর্ত! কী শর্ত?”

“তোমার সুন্দর হাসির একটা ছবি তুলতে দিতে হবে।”

অরুনিকার ঠোঁটের কোণের হাসি প্রসার লাভ করল। বলল, “আচ্ছা, তুলুন।”

“এতক্ষণ তো তুমি বলছিলে, এখন আবার আপনি কেন?”

“সরি। তুলো।”

অরুনিকা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। হিরণ ফোনের ক্যামেরা ধরে বলল, “স্মাইল।”

অরুনিকা হাসার সঙ্গে সঙ্গে হিরণ সেই দৃশ্যটি ক্যামেরায় বন্দী করে নিলো। অতঃপর বলল, “কোথায়, কখন দেখা করতে হবে?”

“রাতে তোমাকে কল করে জানাবে।”

হিরণ আশ্চর্য হয়ে বলল, “আমার ফোনে কল করবে?”
অরুনিকা মাথা ঝাঁকাল।
হিরণ বলল, “এমন বন্ধুত্ব আমি আর দুটো দেখিনি।”

জেসমিনের পঙ্গু স্বামী আর ভাই নিয়ে সংসার৷ একমাত্র ছেলে নটরডেম কলেজে, হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। স্বামী ইশতেহার মাহবুব একজন ফ্রিল্যান্সার। দূর্ঘটনায় পা হারানোর পর অনেক অভাবে দিন কাটলেও, ফাইয়াজের বড় হওয়া আর ইশতেহার ফ্রিল্যান্সার হওয়াতে তাদের দিন পাল্টেছে। তাদের জীবনের গল্পটা এখন যতটা সুন্দর, স্বাভাবিক তার থেকেও করুণ ও অস্বাভাবিক ছিল অতীতে। জেসমিনের হৃদয়চক্ষু বধির নয়, সে মানুষ বাছাইয়ে পটু। ফাইয়াজের বেলাতেই যে কীভাবে ভুল হয়ে গেল!

রূপাকে বাড়ি যেতে দেখে জেসমিন দ্রুতপদে এগিয়ে এসে ডাকলেন, “রূপা?”

রূপা থমকে দাঁড়াল। জেসমিন গেইট খুলে অনেকটা অনুনয়ের সুরে বললেন, “ভেতরে আসো, কিছুক্ষণ কথা বলি।”

রূপা ভেতরে ভেতরে অপ্রস্তুত হয়ে গেল৷ পুনরায় প্রস্তাব নিয়ে রসন ভিলায় গেলে এই বাড়িতে তার বিয়ে হবে!
রূপা কিছু বলার আগে জেসমিন তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গিয়ে গেইট বন্ধ করে দিলেন।

পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে৷ সন্ধ্যা হওয়াতে বাড়ি ফিরছে তারা৷
জেসমিন রূপাকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে বললেন, “তুমি কিছুক্ষণ আমার সামনে বসে থাকবে?”

রূপা খুব অবাক হলো। জেসমিনকে খুব আবেগী লাগছে!
মুখফুটে কিছু বলল না।

জেসমিন মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার ঝুঁটিটা খুলবে?”

রূপা ভাবল, “খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাত্রীর চুলের গোছা মোটা আর লম্বা নাকি দেখতে ডাকল নাকি?”

জেসমিন যেন রূপার মনের কথা টের পেয়ে গেল।
তিনি বললেন, “না খুললে সমস্যা নেই।”

বিনয়ী, আন্তরিক মিষ্টি মুখের জেসমিনকে অগ্রাহ্যের স্পর্ধা রূপার কোমল হৃদয়ের নেই।
সে ঝুঁটি খুলতেই, চুল ছড়িয়ে পড়ে পৃষ্ঠদেশে।

জেসমিন সুনয়নে রূপাকে দেখে বুঝতে পারলেন ফাইয়াজের রূপাকে পছন্দ করার কারণ।
তিনি রূপার পাশে বসে বললেন, “তোমার মুখের গঠন আমার আম্মার মতো। কপাল আর ভ্রু একইরকম।”

রূপা বলল, “আপনার আম্মার ছবি দেখার আগ্রহ হচ্ছে।”

“দেখাব। তুমি বসো, আমি ছবি নিয়ে আসছি।”

চলবে…
(একেক লাইন লিখতে অনেক সময় নিতে হয়৷ তাই দেরি হয়ে যায়।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here