সূর্যশিশির
২২.
সূর্য তখন মাথার উপর। তাপপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রচন্ড গরমের কারণে প্রাণহানিও ঘটছে। রূপা কপালের ঘাম মুছে বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেল। গরমের তীব্রতা তার শরীর জ্বালিয়ে দিচ্ছে৷ এতো গরম কখনো পড়েনি! সে হন্য হয়ে খুঁজছে রাজন মিয়ার ছেলে নয়নকে। রাজন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে শুনল, নয়ন তার নানার বাড়িতে৷ তাই রূপা সেদিকেই যাচ্ছে।
বোতল রেখে রূপা দুই হাতে সাইকেলের হাতল ধরে, প্যাডেলে পা রাখে। চোখের পলকে চলে যায় দূরে। গন্তব্য সানাদপুর। ত্রিশ মিনিটের পথ।
সানাদপুর পয়েন্টে এসে একজন পথচারীকে ডাকল রূপা। পথচারী দাঁড়ালে রূপা প্রশ্ন করল, “হামদু মিয়ার বাড়ি কোনটা?”
পথচারী দক্ষিণে ইঙ্গিত করে বলল, “ওইযে কলা গাছগুলো দেখা যাচ্ছে, ওইখানে।”
রূপা হেসে বলল, “ধন্যবাদ চাচা।”
হামদু মিয়ার টিনের বাড়ি। বাড়ির উঠান নিরিবিলি।
রূপা সাইকেল এক জায়গায় রেখে হাঁকল, “কেউ আছেন?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। পুর্নবার সে ডাকল, “আছেন কেউ?”
একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা কুঁজো অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “কেলা আইছে?”
রূপা বলল, “নয়ন কি এখানে আছে?”
বৃদ্ধা চোখ পিটপিট করে রূপাকে দেখে বললেন, “হেয় তো বাজারে ক্যারাম খেলে।”
“গতকাল কি বাড়িতে ছিল?”
“আছিল তো। হারাদিন হুক্কা টানে আর ঘুমায়। তুমি কেলা? হেরে খুঁজো কোন কামে?”
রূপা ভাবল, “তাহলে কি নয়নের সঙ্গে রুমি যায়নি! তাহলে কার সাথে গেল?”
মুখে বলল, “ওর কাছে টাকা পাই সেটা নিতে আসছিলাম। আমি তাহলে যাই।”
রূপা ঘুরে দাঁড়াবার উদ্যোগ নিতেই বৃদ্ধা বললেন, “বইতা না?”
রূপা স্নিগ্ধ হাস্যে বলল, “না। আসছি।”
বাজার অবধি যাবার প্রয়োজন পড়ে না রূপার। পথেই নয়নের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে গেল। রূপাকে দেখে নয়ন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে এগিয়ে আসল। রূপা এবার নিশ্চিত হলো নয়নের সঙ্গে রুমি যায়নি অন্য কারো সঙ্গে গেছে! তবে কে সে?
নয়ন রূপাকে দেখে বলল, “এখানে কী করিস?”
রূপা বলল, “তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।”
নয়ন চোখ ছোট ছোট করে রেখেছে। সে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল।
রূপা আন্দাজে বলল, “রুমির সঙ্গে যে তোর প্রেম ছিল সেটা আমি জানি। ব্রেকাপ হয়ে গেল কেন?”
নয়ন মাটিতে থুথু ফেলে বিকৃত স্বরে বলল, “তোর বোন একটা বারো’ভা’তারি! আমার সাথে চিট করছে। বড়লোকের খোকা পেয়ে, ছোট থেকে দেখে রাখা এই নয়নরে ভুলে গেছে৷”
রূপা খামচে ধরে নয়নের শার্টের কলার। বলল, “মুখ সামলে রাখ। ভদ্রভাবে কথা বল।”
নয়ন তাচ্ছিল্য করে হাসল।
রূপার হাত সরিয়ে স্বগতোক্তি করল, “শালি!”
রূপা কোনোমতে রাগ সংবরণ করে শুকনো গলায় বলল, “রুমির বয়ফ্রেন্ডকে চিনিস?”
নয়ন সিগারেট ধরিয়ে সরু চোখে তাকাল। বিশ বছরের তরুণ সে, রূপার সমবয়সী। এসএসসি দেয়ার পর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে; আর পড়াশোনা করেনি।
বলল, “হঠাৎ রুমির বয়ফ্রেন্ডের খোঁজ করিস কেন?”
“দরকার আছে। চিনলে বল।”
“না, চিনি না। তুই সাকিব ভাইয়ের জিম সেন্টারে খোঁজ নিতে পারিস। ওখানে যেতে দেখেছি অনেকবার।”
রূপা নিরাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷ সাইকেলের সিটে উঠে বসতেই নয়ন বলল, “ব্যাপারটা কী?”
রূপা প্রতিত্ত্যুরে কিছু বলল না৷ প্যাডেলের ঘূর্ণি তোলে নয়নের থেকে অনেক দূরে চলে গেল।
হিরণ-অরুনিকার ছাদে সাক্ষাৎ-এর চতুর্থ অপরাহ্ন আজ। হিরণ সহসা আবদার করে বসল, “তুমি কি আমাকে তুমি করে সম্বোধন করবে?”
চোখেমুখে উড়াউড়ি করা অবাধ্য চুলগুলো কানে গুঁজে অরুনিকা বলল, “চেষ্টা করব।”
“তুমি কি সারাদিন পড়ো?”
“না। সারাদিন কে পড়ে?”
“বিল্ডিংয়ের সবাই বলাবলি করে তাই বললাম।”
“ভুল শুনেছেন৷ পড়ি তবে অতিরিক্ত না৷ আপনি প্রতিদিন ভার্সিটিতে যান?”
“যেতে হয়। পড়াশোনার অনেক চাপ।”
“ভার্সিটিতে বন্ধুবান্ধব কেমন?”
“মোটামুটি।”
“মেয়ে বন্ধু আছে?” কথাটি বলে আড়চোখে তাকাল অরুনিকা।
হিরণ আড়মোড়া ভাঙার ভান ধরে বলল, “না। মেয়ে মানুষে আমার এলার্জি৷ কথা বলতে পারি না৷”
অরুনিকা দুই হাতে বুকের কাছে ভাঁজ করে বলল, “আমার সাথে তো ঠিকই বলেন।”
“তুমি করে বলার কথা ছিল কিন্তু।”
অরুনিকা হেসে বলল, “সময় দিন।”
“চেষ্টা তো করো। তুমি তো তুমি বলছোই না।”
“আচ্ছা, এখন বলছি, মেয়ে মানুষে এলার্জি অথচ আমার সাথে তো প্রতিদিন কথা বলছো।”
হিরণ বুকের বাম পাশে এক হাত রেখে বলল, “তোমার মুখে তুমি শব্দটা এত শ্রুতিমধুর! আবার বলবে?”
অরুনিকা হাসল। হিরণ বলল, “তুমি বিশেষ তাই পারি।”
“বিশেষ” শব্দটি অরুনিকার মনে আনন্দের ঢেউ নিয়ে আসে। হিরণের সঙ্গ, হিরণের প্রতি মায়া তার শরীরজুড়ে, মনজুড়ে ক্রমে শিকড় গেঁড়ে বসছে।
হঠাৎ অরুনিকার মনে পড়ল, রূপা দুইদিন যাবৎ কল করে তাকে পাচ্ছে না। পরে সে অনুরোধ করা সত্ত্বেও সেলিনা ফোন করার অনুমতি দেন না। আজিজুর চৌধুরী সবসময় বাসায় থাকায় অরুনিকা মায়ের সঙ্গে তর্ক করার সাহসও পায় না৷
অরুনিকা বলল, “আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবে?”
হিরণ উৎসাহ নিয়ে বলল, “কেন করব না? অবশ্যই করব৷ একবার শুধু বলো।”
অরুনিকা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে গেল। সে নিজের খুশি লুকিয়ে রাখতে পারছে না। বলল, ” আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান মানুষটা হচ্ছে আমার বন্ধু। জীবনের প্রতিটি গোপন কথা ও জানে৷ আমরা দুজন দুজনকে যেভাবে বুঝি, অন্য কেউ তেমন করে বুঝে না৷ আমার প্রাণ ও, ওর প্রাণ আমি।”
অরুনিকার চোখেমুখে একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে।
হিরণ বলল, “ছেলে নাকি মেয়ে বন্ধু?”
অরুনিকা সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল, “অবশ্যই মেয়ে বন্ধু।”
“আমাকে কী সাহায্য করতে হবে?”
“আমার ফোনটা ভেঙে গেছে। দুইদিন কথা হয়নি ওর সাথে। তোমার ফোন দিয়ে কল করতে পারি?”
হিরণ তাৎক্ষণিক ফোন বের করে দিয়ে বলল, “শিওর।”
হিরণের হাত থেকে ফোন নিয়ে রূপার নাম্বার ডায়াল করে অরুনিকা। কল যাচ্ছে…
অরুনিকা হিরণকে বলল, “আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি।”
সে ভাবল, “আজ রূপাকে হিরণের সম্পর্কে সব বলব। ওদের দুজনের সাক্ষাৎ করিয়ে দেব। রূপার নিশ্চয়ই হিরণকে পছন্দ হবে! হতেই হবে।”
উত্তেজনায় অরুনিকার কণ্ঠনালি কাঁপছে।
চলবে…