সূর্যশিশির
২.
বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সুমনার রাগান্বিত কণ্ঠ ভেসে এলো, ”আজকে তুই ঘরে ঢুকবি না কু’ত্তার বাচ্চা। এতক্ষণ কোন লাংয়ের কাছে ছিলি?”
রূপা সুমনাকে এক নজর দেখে দুই তলায় উঠে গেল। সুমনার রাগ এবার অন্তরীক্ষ ছুঁয়ে ফেলল। কত বড় বুকের পাটা, অবজ্ঞা করে চলে গেল! তিনি পিছু পিছু রূপার রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ইতিমধ্যে সে দরজা বন্ধ করে ফেলেছে৷ সুমনা জানালার কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ”গতরে এতো তেজ কীসের তোর? বাপটা যে একা একা এই গরমে কাজ করতেছে সেই খেয়াল আছে?”
রূপা প্রতুত্তরে বলল, ”এই বাড়িতে তো শুধু একা আমি থাকি না৷ তোমার আরো দুটো মেয়ে আছে, দুটো ছেলে আছে। প্রতিদিন আমাকেই কেন হোটেলে গিয়ে আব্বাকে সাহায্য করতে হবে? অন্যরাও যাক।”
”তো এখন কি আমার মেয়েরা ব্যাঠাদের মাঝে গিয়ে হোটেলে কাজ করবে? হাহ?” সুমনার কণ্ঠে তেজ।
রূপা অভিমানী চোখে তাকাল। বলল, ”আমিও তো মেয়ে আম্মা।”
”তোরে কোনদিক দিয়ে মেয়ে মনে হয়? এতো কথা বাড়াস না তো মা। যা, হোটেলে যা। এখন কাস্টমার আসার সময়, ভীড় হবে। তোর বাপ একা সামলাতে পারবে না।”
“কিছু খেতে দাও। এরপর যাচ্ছি।”
”হোটেলে যা আছে খেয়ে নিস। ঘরে থেকে আর সময় নষ্ট করিস না।”
”হোটেলের খাবারে অনেক তেলমশলা থাকে। গ্যাসের সমস্যা হয়।”
”আজ খেয়ে নে। কাল থেকে কোথাও গিয়ে সময় নষ্ট করিস না। ঘর থেকে খেয়ে এরপর হোটেলে যাবি। আশিক, আরমান কোচিংয়ে যাবে। আমি নিয়ে যাচ্ছি। এসে যেন দেখি তুই চলে গেছিস। আমি কিন্তু তোর বাপরে কল দিয়ে জানবো তুই গেছিস নাকি।”
সুমনা চলে গেলেন। রূপা জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। পড়ন্ত বিকেলের নরম বাতাস কায়া স্পর্শ করতেই বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। এতোগুলো বছর অতিক্রান্ত হলো তবুও কেন বক্ষে এতো পীড়া লাগে? তার শ্রান্ত চোখদুটো বুজে আসছে বার বার। সে চোখমুখে পানি ছিটিয়ে জামাকাপড় পালটে নিলো। ক্ষুধায় পেটের ভেতর গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে৷ এতো ক্ষুধা নিয়ে হোটেলের খাবার খেতে হবে! রূপা একবার ভাবল, “আম্মাতো এখন ভাইদের নিয়ে কোচিংয়ে চলে যাবে৷ আমি বরং খেয়ে নেই।”
পরক্ষণে বাড়ির দুটো সিসি ক্যামেরার কথা মনে পড়তেই সেই ইচ্ছে দমিয়ে ফেলল।
রসন ভিলা থেকে বের হয়ে কল করল অরুনিকাকে। ফোনের ওপাশে শোনা গেল কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠটি, ”মেরেছে দোস্ত?”
”তাড়া ছিল আম্মার। তাই ভালো করে বকতেও পারেনি।” ফিক করে হেসে দিলো রূপা। অরুনিকা ফোনটি আরো শক্ত করে কানের সাথে চেপে ধরল। বলল, ”খেয়েছিস?”
”বাজারে যাচ্ছি। হোটেলে গিয়ে খাবো।”
”তোর না গ্যাসের সমস্যা। সারাক্ষণ বুক ব্যথা করে।”
”খেতে তো হবে ভাই। তোর কী খবর? আংকেল বকেছে?”
”কথা ঘুরাবি না। তুই বাসায় খেয়ে এরপর হোটেলে যা।”
রূপা বলতে ইতস্তত বোধ করছে৷ তবুও বলল, ”আম্মা মানা করছে।”
”এরা আসলে তোর বাপ-মা? নাকি কুড়িয়ে আনছে তোকে?”
”আগে তাই মনে হতো। কিন্তু আমি দেখতে তো অবিকল আব্বার মতো।”
”কোনো রহস্য তো নিশ্চয়ই আছে। তোর বাকি ভাইবোনদের চোখে হারায় আর তুই যেন চক্ষুশূল। এই বৈষম্য কেন? আমি বড় হয়ে এই রহস্য উদঘাটন করব দেখিস।”
”করিস। এখন রাখছি, ফ্রি হয়ে মেসেজ দেব।”
”শোন, হোটেলের খাবার খাবি না৷ দশ মিনিট অপেক্ষা করিস।”
”কিছু পাঠাস না, অরু, শোন… ”
অরুনিকা কল কেটে দিলো। সূর্যাস্তের সময় তখন। আকাশের অবস্থা ভালো নয়, রাতে কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে। রূপা ফোন প্যান্টের পকেটে রেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। হঠাৎ গলির মুখে আবিরের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। রূপার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়৷ বুকজুড়ে একটা উতলা ঢেউ অনুভব করে। আবির সময় না নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন করল, ”কোন দোষে আমার সাথে এমন করছো?”
”আমি তোমার সাথে স্বস্তিবোধ করি না এটাই কারণ।”
”কেন? আমি কী করেছি? তোমার গায়ে হাত দিয়েছি? নাকি কোনো অশ্লীল আচরণ করেছি?”
”তুমি বুঝবে না। আমার পথ ছাড়ো।”
”আমি অবুঝ না রূপা। ব্রেকাপের কারণ তোমার হিংসুটে বান্ধবী। এতো হিংসে তার মনে!”
রূপা রেগে গেল, ”অরুকে নিয়ে এভাবে কথা বলবে না।”
”আমি মিথ্যে কী বলছি? অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। তোমাদের সম্পর্ক অস্বাভাবিক। বন্ধুত্বকে বন্ধুত্বের জায়গায় রাখো। নয়তো জীবনেও সুখী হবে না।”
আবিরের কণ্ঠ থেকে রাগ ঝরে ঝরে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে, সে রাগ ঝাড়ার পরিকল্পনা করেই এসেছে। রূপা আবিরকে এড়ানোর চেষ্টা করে, ”তুমি আমাকে সুখ শেখাতে এসো না। পথ থেকে সরো।”
রূপা চলে যেতে উদ্যত হতেই আবির বলল, “বান্ধবীর মন রাখতে ভালোবাসা ছেড়ে দিবে? তুমি কি আমায় ভালোবাসো না রূপা?”
”বাসি না।”
রূপার নিষ্ঠুর জবাবে সে রাগে ধৈর্যহারা হয়ে গেল। বলল, ”অরুনিকাকে বাসো? ও’কে বিয়ে করবে? তোমরা কী সমকামী? লোকে সত্যি বলে?”
রূপা ঘুরে আবিরের সোজাসুজি এসে দাঁড়াল। বলল, ”তোমার বাবা আর তুমি একজন আরেকজনকে নিজেদের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসো তাই না?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে অবাক হলো আবির। বলল, ”হ্যাঁ।”
”তাহলে তোমরা কি সমকামী?”
”কথার প্যাঁচে ফেলতে চাইছো? তাহলে মাথায় ঢুকিয়ে রাখো, আমার বাবা ছেলের জন্য বউ খুঁজছে। বউকে তৃতীয় ব্যক্তি ভেবে হিংসে করছে না।”
রূপা থতমত খেয়ে গেল। বলার মতো কিছু পেল না। আবির বলল, ”সম্পর্ক যত বাড়ে সময় তত কমে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তার মানে এই না ভালোবাসা কমে যাবে। আমি কখনোই তোমাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি ছিলাম না। তোমাদের একে-অপরের বন্ধুত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো আমি জানি। বরং একদিন অন্য কেউ সত্যিকার অর্থেই তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে তোমাদের জীবনে আসবে।”
”অভিশাপ দিচ্ছো?”
”যদি তাই ভাবো তবে তাই। আমি তোমাকে আর কখনো আমার মুখ দেখাবো না।”
আবির রাগে গজগজ করতে করতে স্থান ত্যাগ করল। রূপা ঠায় সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। দৈবাৎ আকাশ ফুঁড়ে বজ্রপাত হতেই চমকে ওঠল সে।
চলবে…