সূর্যশিশির পর্ব ১

0
1888

সূর্যশিশির
১.
গগনবিদারী চিৎকারে কেঁপে উঠে রসন ভিলা। সুমনা চিৎকার শুনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে পা মচকে পড়ে গেলেন। পুনরায় উঠে দাঁড়ালেন। তার কনিষ্ঠ কন্যা রিনি তখনো চিৎকার করছে। তিনি হুড়মুড়িয়ে রিনির কাছে পৌঁছালেন।

“আম্মা, আপা…” রিনির গলা বুজে এলো। সুমনা জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন, রূপা ব্লে’ড দিয়ে ক্রমাগত হাত-পায়ে আ`ঘাত করছে। তিনি শিউরে উঠে বললেন, ”ও রূপা…রূপারে। এমন করিস না। ও রূপা? মা গো। ও রূপা…”

রূপার কোনো ভাবান্তর নেই। তার শুকনো ওষ্ঠদ্বয় বিরতিহীনভাবে বলছে, “আমি অরুনিকা, আমি অরুনিকা, আমি অরুনিকা…”

সুমনার চোখেমুখে মেয়েকে হারানোর তীব্র ভয়। তিনি উৎকন্ঠিত হয়ে রিনিকে বললেন, “তোর বাপরে কল দিয়ে বল তাড়াতাড়ি এসে তালা খুলতে।”
রিনি ছুটে নিচ তলায় গেল।

সুমনা কয়েকবার দরজায় লাথি দিয়ে আবার জানালার কাছে এলেন। মেয়েকে অনুনয় করে বললেন, ” ও রূপা? তুই যা চাস তাই হবে। মা আমার, একটু শোন। ও মা…আমি তোকে আর বকব না, মারব না। তুই যা বলবি তাই করব…”

রূপা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চুলে ঢাকা তার মুখের অর্ধাংশ। চোখ দুটি থেকে যেন র/ক্ত ঝরছে। সে গাঢ় গলায় বলল, ”আমায় ঘর থেকে বেরোতে দিবেন তো আন্টি?”

সুমনা বললেন, ”দেব, দেব মা…দেব। তুমি ব্লে’ডটা রেখে দাও।”

”আমি রূপা? না অরুনিকা?’

”তুমি অরুনিকা।” সুমনার কণ্ঠে আতঙ্ক।

রূপা হাসল। ব্লে`ডটি পাশে রেখে বলল, “আপনি কাঁদবেন না আন্টি। এই যে দেখুন, আমিতো শুধু চামড়ায় ব্লে/ড চালিয়েছি।”

রূপা দুই হাত – পা সামনে মেলে ধরল। টুপটুপ করে র`ক্ত পড়ছে মেঝেতে। রূপার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে না, সে কোনোরকম যন্ত্রণা অনুভব করছে! দৃশ্যটি দেখে সুমনার মাথা ভনভন করে ওঠল। তিনি দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন।

বছরখানেক আগে।
ভ্যাপসা গরমে অরুনিকার হাঁসফাঁস লাগছে। সে উপরদিকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে বলল, ”তুই নামবি রূপা? আর কতক্ষণ এই কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকবো?”

রূপা দুটো আম ছুঁড়ে দিলো। অরুনিকা ওড়নার আঁচল পেতে আম দুটো সংগ্রহ করে দ্বিগুণ জোর গলায় বলল, ”এভাবে চুরি করা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। ধরা পড়লে বেঁধে রেখে দেবে।”

রূপা বলল, “তোর মুখটা বন্ধ রাখ মা। নয়তো সত্যিই ধরা পড়বো।”

অরুনিকা কপালের ঘাম মুছল। গরমের তেজে কোনো পক্ষীও নেই চারপাশে। আছে শুধু সে আর তার উড়নচণ্ডী বান্ধবী। রূপার কথায় এখানে আসাই উচিত হয়নি। কোচিং থেকে বের হয়েছে সেই কোন প্রহরে! এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাসার সবাই টের পেয়ে গেছে। অরুনিকা মুখ গুমোট করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যে রূপা গাছ থেকে নেমে এলো।

শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে বলল, ”এমন পেঁচামুখী হয়ে আছিস কেন? হাসলে কী তোর টাকাপয়সা ফুরিয়ে যাবে?”

”কয়টা বাজে খেয়াল আছে? বাসায় গিয়ে এখন কী বলব?”

”একটু না হয় বকবে। আমার মা-বাবার মতো তো বুকে পাড়া দিয়ে রাখবে না।”

অরুনিকা সজল নয়নে তাকাল। রূপার মুখটা দেখে মুহূর্তে তার সকল চিন্তা উবে গেল। সে আদুরে গলায় বলল, “আম খেতে কই যাবি চল।”

_
দুজন কলেজের মাঠে শুয়ে আকাশ দেখছে। তারা সদ্য এইচএসসি পাস করেছে। পড়াশোনায় অরুনিকা মেধাবী হলেও রূপা তার উল্টো। রূপা বলল, ”কয়দিন পর এডমিশন। কিছুই তো পরা হয়নি।”

”পড়াশোনাটা একটু কর। আমাদের কিন্তু একসাথে ভার্সিটিতে পড়ার কথা।”

”তুই কোনো নামকরা পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়েই চান্স পাবি। যেটা আমার জন্য রূপকথা।”

”তুই পড় না রূপা। আমার জন্য হলেও পড়।”

”ওই বাসায় পড়াশোনা সম্ভব না। জানিসই তো।”

অরুনিকা চুপসে গেল। রূপা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “আম চুরি নিয়ে তো অনেক জ্ঞান দিলি। এখন তো সব আম তোর পেটেই গেল রাক্ষুসী।”

অরুনিকা হাসল। রূপা কাৎ হয়ে শুয়ে বলল, “অরু?”

”বল না।”

”আবিরের সাথে ব্রেকাপ করেছি।”

অরুনিকা চট করে উঠে বসল। অবাক হয়ে বলল, “কী? এক সপ্তাহও তো হলো না রিলেশনশিপে গেলি!”

”প্রেমিকগুলো ভীষণ কতৃত্ব ফলায়। ভালো লাগে না এসব।”

”এটাই কারণ? নাকি আমার জন্য?”

”তোর জন্য কেন হবে?”

”তুই জানিস।”

রূপা দমভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ”গত চারদিন তোর সাথে এক দন্ডও কথা হয়নি। আমি আমার অবসরটুকু তোর সাথে কাটাতে চাই। অন্য কারো সাথে না। আমি আর কখনো প্রেম করবো না রে অরু।”

”তুইতো আবিরকে ভালোবাসতি।”

”তোর থেকে কম।”

“তবুও…”

কথার মাঝে আটকে দিয়ে রূপা বলল, “তোকে সময় দেইনি বলে কি তুই কাঁদিসনি?”

অরুনিকা আরক্ত হয়ে উঠল। ছয় বছরের বন্ধুত্বে কখনো কথা না বলে দুজন একদিনও কাটায়নি। হুট করে যখন দুইদিনের ছেলের জন্য রূপা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, সত্যিই সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। পড়াশোনায় মন বসেনি, সারাক্ষণ কেঁদেছে। কিন্তু রূপা কী করে এই খবর জানলো? সে বলল, ‘ তুই কী করে জানলি?”

‘আমার মনে হলো, অনুভব করলাম।’

গভীর এক ভালোবাসার চাদরে অরুনিকা ডুবে গেল। সে রূপাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমরা কখনো প্রেম করব না, বিয়েও করব না।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here