#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০৯
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
১৯.
চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি। কারা প্রকোষ্ঠের এক স্যাঁতসেঁতে নোংরা কক্ষে বন্দী অফিসার রূপক আহসান ও কনস্টেবল সাগ্রত। তাদের সাথে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের আচরণ এতো জঘন্য হতে পারে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না কারো। কি থেকে কি ঘটে গেল! তা বলাই বাহুল্য। কিছুতেই যেন দুইয়ে দুইয়ে চার এই হিসেবটা মিলছে না। প্রচণ্ড ক্ষুধায় আর তেষ্টায় দু’জনের অবস্থাই শোচনীয়। আর শীতের মাঝে এমন স্যাঁতসেঁতে স্থানে থাকার অভিজ্ঞতাই পরিস্থিতিকে আরো করুণ করে তুলেছে। সাগ্রত গলা ঝেড়ে নিল তারপর বলল,
“স্যার আপনার ড্রয়ারে ইয়াবা এলো কী করে?”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা মারমা কিশোরীদের হত্যার এলিগেন্স কেন আমাদের উপরে আসলো? আর হঠাৎ করে সেনা কর্মকর্তারা কেনই বা রিসোর্টে আমাদের রুমে অভিযান চালালো? সবটাই রহস্যময়, ধোঁয়াশায় আবৃত।” বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রূপকের কথার সাথে সাথে।
“আমার মাথাও কাজ করছে না স্যার। আমাদের শেষ পরিণতিটাই বা কি হতে চলেছে?” আতঙ্ক প্রকাশ পেল সাগ্রতের কণ্ঠে।
“ধৈর্য্য ধরা ছাড়া কোনো উপায়ন্তর নেই। দেখা যাক কী আছে কপালে!”
দু’জনে পুনরায় নিজেদের ভাবনার বেড়াকলে নিমজ্জিত হলো। তখনই একজন সেনা কর্মকর্তার আগমন ঘটল কারাকক্ষে। তিনি বললেন,
“অফিসার রূপক আমরা অত্যন্ত দুঃখিত এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের দরুন। আপনাদেরকে মিথ্যে মাদক মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল, পাশাপাশি মারমা কিশোরীদের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদেরকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। আপনারা নিরপরাধ বলে প্রমাণিত হয়েছেন। অপরাধী স্বয়ং তার অপরাধের সমস্ত প্রমাণ আমাদের পাঠিয়েছে। আপনারা এখনি নীলাচলের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এস আই শামীমের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হবে। আমি তাদেরকে অলরেডি কনফার্ম করে দিয়েছি আপনারা অতি শীঘ্রই যোগদান করছেন।”
পরপর এতগুলো খবর শুনে রূপক আর সাগ্রত নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলে গেল। কেবল একে অপরের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় করল। স্তব্ধতায় গ্রাস হতে থাকল তারা। যেন স্বপ্নের ঘোরে তারা মোহিত হয়ে রয়েছে। তারপর সম্বিৎ হয়ত ফিরেও পেল। এসব দেখে উক্ত সেনা কর্মকর্তা পুনরায় বললেন,
“তালা খুলে দিয়েছি, বিলম্ব করবেন না। বাইরে আসুন, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে রওনা করুন। আপনাদের অপেক্ষায় তারা অপেক্ষমাণ।”
তারপর রূপক আর সাগ্রত সময় বিলম্ব না করে দ্রুতই খেয়ে নিল। তারপর নীলাচলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আপাতত সেনাবাহিনী অভিযানে যুক্ত হচ্ছে না, যদি পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যায় সেই ক্ষেত্রে তারা ফোর্স পাঠাবেন এমনটাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এস আই শামীমের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে সাগ্রত। শামীম বলে দিলেন মেইন লোকেশন যেখানে তারা মিলিত হবে। রূপকের হৃদপিন্ডের গতিবেগ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কখনো এমন অদ্ভুত অনুভূতির সম্মুখে তাকে পড়তে হয়নি।
২০.
“বর এসেছে, বর এসেছে” এই কথায় মুখরিত নুরা মারমার বাড়ি। আশপাশের বাড়ি থেকেও কিছু উৎসুক মানুষের আগমন ঘটেছে বর্তমানে ছোট্ট ঘরটিকে। অস্বস্তিতে ঘরজুড়ে পায়চারি করছে রুথিলা। মন থেকে চাইছে সে কোনো একটা মিরাকল তথা আশ্চর্যজনক ঘটনা যেন ঘটে যায়। কিন্তু ঘটবে কী কোনো মিরাকল? বাস্তবায়িত হবে কী মূল পরিকল্পনা? নাকি তীরে এসে ডুবে যাবে তরী? জটিল ভাবনার বেড়াকলে আবদ্ধ রুথিলা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, শীতের তীব্রতাও যেন রুথিলার ঘাম আটকাতে ব্যর্থ। নুরা মারমা হন্তদন্ত হয়ে রুথিলার কক্ষে ছুটে এল। তা দেখে রুথিলা চোখের ইশারায় বলল, “এখানে এসেছ কেন!”
“রাফিদ, হিরনসহ মোট ছয়জন এসেছে। আর বাইরে বাইশ থেকে পঁচিশ জনের মতো পুরো বাড়ি ঘিরে রেখেছে। পাহারায় রয়েছে ওরা। এখন কাজটা করব কী? খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে! কী করব বুঝতেছি না তো!”
“আস্তে কথা বলো দেয়ালেরও কান আছে। আর আশেপাশের বাড়ির লোকজনকে তাড়িয়েছো! পরিকল্পনা অনুসারেই কাজ কোরো, প্ল্যান – এ ফেইল হলে প্ল্যান – বি এপ্লাই করবে। হয় বাঁচবো নয়ত মরব। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। জানি না কাজটা ঠিক হবে কী না? তুমি ব্লুটুথ কানেক্ট করেছো? না করলে করে ফেল আর প্রবলেমে পরলে এস আই শামীমের সাথে কন্টাক্ট করবে। কিন্তু সাবধান ওরা যেন কোনো ক্রমেই টের না পায়। মিশনে সাকসেস হতেই হবে। এখন চলে যাও। আমার কাছে ঘেঁষবে না।” রুথিলা সবটা নুরা মারমাকে বুঝিয়ে দিল।
“জি খেয়াল থাকবে। আর ব্লুটুথ কানেক্ট করিনি। করে নিচ্ছি তুমি থাক। ওরা চলে এল বোধহয়।”
“প্লিজ নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা কোরো। হেরে গেলে কিন্তু সব শেষ।”
“হুম।” বলে নুরা মারমা প্রস্থান করল।
রুথিলা প্রাণপণে দোয়া করছে যেন তাদের সব পরিকল্পনা সফল হয়। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম একটা রুমালের সাহায্যে মুছে নিল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার অনর্থক প্রয়াস চালালো খানিক।
২১.
“আপনেরা দাঁড়িয়ে আছেন কেনে? বইসে যান।” নুরা মারমা মুখে লম্বা হাসি ঝুলিয়ে বলল।
“কিরে তুই তো আজ বড্ড বেশিই খুশি?” হিরন নুরার উদ্দেশ্যে বলল।
“আরে বসের বিয়ে বইলে কথা। খুশি তো হতেই হইবে।”
“কাজি আসবে একটু পরে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা শেষ হলে বাঁচি।” হিরন অন্যমনস্ক হয়ে বলল।
“শা’লা, হা’রা’ম’জা’দা বাঁচাচ্ছি তোকে?” কথাগুলো মনে মনেই রাখল নুরা মারমা। বাইরে প্রকাশ করল না। প্রকাশ করলে যে তার রক্ষে নেই। নুরা মারমা হিরনের উদ্দেশ্যে বলল,
“বস আপনি থাকেন। আমি সবার জন্যে পায়েস আর শরবত নিয়ে আসি কেনে।”
“যা দেরি করিস না এক্ষুণি নিয়ে আয়। এই শীতের দিনে গুড় দিয়ে তৈরি পায়েস যা অমৃত লাগে। তাড়াতাড়ি যা।” রাফিদ নুরাকে তাড়া দিয়ে বলল।
“আইচ্ছা যাচ্ছি কেনে।”
তারপর নুরা মারমা দ্রুত পদে রান্নাঘরে গেল। গিয়ে দেখল তার স্বামী সবটা গুছিয়ে রেখেছে। নুরা মারমা আশেপাশে তাকালো, কাউকেই নজরে পরল না তার। তবুও “সাবধানের মার নেই” বলে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে। সেই প্রবাদকে লালন করল নিজ মনে। ফিসফিসিয়ে ডাকল নিজের স্বামীকে,
“এই উমাই’র বাপ শুনছো?”
“হুম বলো কী করব?” ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল নুরা মারমার স্বামী।
“পায়েসের বাটিগুলো সব কোথায়? প্রথমে পাহারায় থাকা লোকগুলোকে একসাথে জড়ো হতে বল। ওদেরকে আগে পায়েস দেই। তারপর ছয়টা বাটি দাও নিয়ে যাই রাফিদ আর হিরন বসের জন্য। আমার ছেলে, আমার উমাই কোথায়?”
“ওকে সুচাদের বাড়িতে থুইয়া আসছি। পায়েস নিয়ে দিয়ে এসেছি পাহারাদার গুলোকে। বাকিগুলো আলাদা করেও রেখেছি। এই যে ধর ছয় বাটি না নিয়ে সাত বাটি যাও। রাফিদ বস পায়েস বেশ পছন্দ করেন।”
“ওহ! বেশ বুদ্ধি হয়েছে তোমার, কাজও এগিয়ে রাখছ দেখি। ওরা খেয়েছে কী?”
“খাচ্ছে দেখে এলাম।” নুরা মারমার স্বামী বলল।
“আচ্ছা, দাও বাটিগুলো।” বলে নুরা মারমা তার স্বামীর হাত থেকে পায়েসের বাটিগুলো নিয়ে রওনা হলো ঘরে।
নুরা মারমা সাত বাটি পায়েস নিয়ে হাজির হতেই রাফিদ একপ্রকার হামলে পড়ল সেই পায়েসের ওপর। নুরা মারমাকে কিছু বলবার বা করবার সুযোগ না দিয়ে নিজেই সবাইকে পরিবেশন করল রাফিদ। সবার খাওয়া শেষ হতেই দেখা গেল এক বাটি রয়ে গিয়েছে। দেরি না করে সেটাও খেয়ে নিল রাফিদ। বাকিরা অবাক দৃষ্টিতেই দু’বাটি পায়েস খাওয়ার দৃশ্য দেখল, তবে স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টিকে দেখল। সেই খাওয়ার দৃশ্য দেখে নুরা মারমার খানিকটা খটকা লাগল। তার মনে হল রাফিদ যেন অভুক্ত। তাই এভাবে খাচ্ছে। কিন্তু সে তো মোটেও অভুক্ত নয়, তাহলে এমন আচরণের কারণ? রাফিদের সাথে থাকা বাকি পাঁচজনের অবশ্য রাফিদের দিকে সেরকম কোনো মনোযোগ ছিল না। তাই তারা রাফিদের খাওয়ার দৃশ্যটিকে অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। পায়েস খেয়ে প্রত্যেকেই রাধুনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তা শুনে নুরা মারমা অদ্ভুতভাবে হাসল কেবল।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~