#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০৪
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
১০.
“আপনি মিসিং ডায়েরি করাতে চাইছেন?” শামীম সামনের চেয়ারে বসে থাকা নারীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
“হ্যাঁ সাহেব, আমার ছুটো বুইনটা আজ তিন দিন ধরে নিখোঁজ। আমার খুউব চিন্তা হইচ্ছে কেনে।” নুরা মারমা আতঙ্কিত হয়ে বলল।
“তা ঠিক আছে তবে আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন তো! সে তো কোনো দরকারে কোথাও যেতেও পারে।”
“আহা বুইঝতেছেন না কেনে, উ আমাকে না বলে কুথাও যেতে পারে না। এখুন বলেন জিডি কুরবেন কী না?” বেশ রাগান্বিত হয়ে বলল নুরা। এক কথা বারবার জিজ্ঞাসা করলে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে তার। অথচ এই পুলিশ সেই কাজটাই করছে। মনে মনে শামীমকে কয়েক দফা গালমন্দ করল সে। এমনিতেই চিন্তায় চিন্তায় বুকের ভেতরে তোলপাড় চলছে। আর সাহায্য চাইতে এসে আরো বিপত্তিতে নিজেকে জড়িয়েছে নুরা। এসব ভাবতে ভাবতেই সে লক্ষ্য করল শামীম একটা খাতায় কিছু লিখছে। আর তা দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নুরা।
“আপনার বোনের কি নাম?
“রুথিলা তাবাস্সুম উর নাম।”
“তিনি কী মারমা উপজাতীয় নন!” আশ্চর্যের সাথে প্রশ্ন করল শামীম।
“না” সংক্ষেপে জবাব দিল নুরা।
“তাহলে সে আপনার বোন হয় কী করে?”
“আপনি বেশি কতা বলেন। জানেন না আপনি রক্তের সম্পর্ক কারো সাথে থাকলে কেনে সে হয় রক্তিয় আর আত্মার সম্পর্ক থাকলে সে হয় আত্মীয়। তেমনই রুথিলা আমার আত্মীয়। তাই উ আমার বোন।” বেশ খানিকটা ব্যাখ্যা দিয়েই থামল নুরা।
“আপনি বেশ ভালো বাংলা বলেন। তা কিছু মনে না করলে আপনার সম্পর্কে ও আপনার বোনের সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন। এতে আমরা দ্রুততম সময়ে আপনার বোনকে খুঁজতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারব।” শামীম কৌতূহল বশত নুরার উদ্দেশ্যে বাক্যগুলো ছুড়ে দিল। পাশাপাশি তার থেকে দ্রুত তথ্য আদায়ের উদ্দেশ্যে তার প্রশংসা করতেও ভুলল না।
“আইচ্ছা তবে সুনুন। আমি যখন ষোলো বছরের কিশোরী মেইয়ে ঠিক সেই সময় রুথিলার সাথে হঠাৎ এক বিকেলে আমার দেখা হইয়ে ছিল। সাথে ওর সোয়ামিও ছিল। সেইদিন আমারে জুর কইরে আমার বাজান বি’য়ে দিতে চাইছিল তাই পালিয়ে ছিলাম কেনে। দু’বছর ধইরে আমার লেহাপড়া বন্ধ কইরে দিছিল তিনি। এরপর থেকে প্রায়ই বি’য়ে ঠিক করতো আর আমি পালিয়ে যেতাম। পরে ধরে নিয়ে অনেক মা’রতো। সেদিন রুথিলা আমাকে বাঁচাইয়ে দিছিল বাজানের হাত থেইকে। আর ইস্কুলের মাস্টারের সাথে কথা বলে, আমার বাজানরে বুঝিয়ে আমার এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থাও কইরে দিছিল। দু’বছর ধইরে লেহাপড়ার বাইরে থাইকলেও বান্ধবীদের কাইছ থেইকে ঠিকই পড়াগুলো শিখেচিলাম। লেহাপড়ায় খুউব ভালো না হলেও খারাপ ছিলাম না। ইস্কুল থেকেই বাংলা শিখেছি, আর নিজেদের ভাষার পাশাপাশি বাংলা শিখেচি যেন জীবনে কিচু করে খেতে পারি। আমার বেশিরভাগ বাংলা শিখা হইচে রুথিলার কাচ থেইকে। তবে মাঝে অনেকদিন চর্চা না কইরে সব ভুলতে বসেচিলাম। তারপর অনেক বছর হঠাৎ একদিন রুথিলা আইলো আমার কাচে। সেই থেকেই উ আমার সাথে থাকে কেনে। তিনটা বছর ধরে আমার সাথেই থাকে উ। আমার বিয়ের পরেও আমি উকে সাথেই রেখে দিচি। মেইয়েটা আমার চেয়ে বড়ো হলেও আমাকে কত ভালোবাসে, মনে হয় যেন আমি উর বড়ো বোন। উকে দিদি বললে খুউব রাগ কইরতো। অথচ উ আমাকে দিদি’ই বলে।” এগুলো বলে নুরা মারমা শ্বাস নিল খানিক।
“আপনি তো আপনার সব কথাই বললেন, আপনার বোনের ব্যাপারে কিছুই বললেন না। আর তিনি তো আপনার ছোট নন তবুও তাকে ছোট বলছেন। এগুলো একটু অদ্ভুত নয় কী!” হঠাৎ থেমে যাওয়াতে নুরাকে উদ্দেশ্য করে বলল শামীম। ঘটনা শুনতে গিয়ে হঠাৎ বিরতি খুবই বিরক্তিকর ঠেকে তার কাছে। তাছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের বাংলা ভাষার ধরন বেশ কঠিন ঠেকে শামীমের নিকট। চাকরির সুবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষার উপর দক্ষতা রয়েছে তার। নুরা মারমার কথা শুনতে গিয়ে একটা মারাত্মক অভিজ্ঞতা অর্জন করল সে। দিনদিন তার ধৈর্য্য শক্তি যে হ্রাস পেয়েছে তা বেশ উপলব্ধি করছে শামীম। আর নুরা মারমা ভালো বাংলা বললেও কথা গুছিয়ে বলতে মোটেও পারেন না। তাই আলাপচারিতা সংক্ষেপ করতে নিজ প্রয়োজন অনুসারে প্রশ্ন করতে শুরু করল শামীম। তবে মনে মনে তাকে বাহবা দিতেও ভুলল না সে কেননা “নুরা সে যে একজন বাংলাদেশী হিসেবে নিজ ভাষা চর্চার পাশাপাশি বাংলাকেও পরম ভালোবাসায় চর্চা করছেন।”
প্রায় আধ ঘণ্টা নুরা মারমার সাথে কথা বলে তাকে আশ্বাস দিয়ে বিদায় দিলেন এসআই শামীম। আর নুরার বলা কথাগুলো একনাগাড়ে ভাবতে লাগলেন। ঘটনার সারসংক্ষেপ এই যে,
“রুথিলা তাবাস্সুম একজন মানবাধিকার কর্মী। সেদিন রাতে তার বের হবার কারণটাও অজানা। সে ব্যাপারটা নুরা মারমা বেমালুম চেপে গেল। কিন্তু কী এমন হতে পারে! আর রুথিলার স্বামীর ব্যাপারটাও বেশ ধোঁয়াটে, তার কথা একবার উঠেছিল। সে জীবিত না মৃত কিংবা রুথিলা ডিভোর্সী কিনা তাও জানা গেল না। আর সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হলো রুথিলা কেন মারমা উপজাতির সাথে বাস করছে? এর কারণ কী সে একজন মানবাধিকার কর্মী!”
আবারো গোলকধাঁধার সৃষ্টি হলো। এমনিতেই সিরিজ হত্যাকান্ডের নেই কোনো কূলকিনারা তার উপর আবার একজন মানবাধিকার কর্মীর হুট করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। এই ঘটনা যদি মিডিয়াতে প্রকাশিত হয় তবে তো তা দেশের ভাবমূর্তির জন্য হুমকি স্বরূপ। ইশ কী যে শুরু হলো!
১১.
ঘোর অন্ধকার ফুঁড়ে হঠাৎ আলোকরশ্মি এসে রুথিলার চোখে তীব্রতর আকারে প্রভাব ফেলল। সে বুঝতে পারলো কেউ প্রবেশ করেছে এই আবদ্ধ কুঠিরে। তাই একটু নড়েচড়ে উঠল সে। হঠাৎ নিজের চুলে টান পড়তেই কুঁকিয়ে উঠল রুথিলা। আর অনুভব করল তার মুখে বাঁধা কাপড়টি আলগা হয়েছে খানিকটা।
“এই মা* বল পাসওয়ার্ড বল তাড়াতাড়ি। মুখ খুলে দিচ্ছি, যদি জানে বাঁচতে চাস বলে ফেল।” এক নারীর কণ্ঠে উক্ত কথাগুলো শুনল রুথিলা।
“আমি মরে গেলেও বলব না। আমার গো-প্রো কোথায় আর পেনড্রাইভটার কিছু করিস না কিন্তু। কসম জানে মে’রে ফেলব।” তেজস্বী রুথিলার অগ্নিমূর্তি রূপ ধারণ দেখল উক্ত নারী।
“তুই আমার বা* ফালাবি, আমাগো বস আইলে কিন্তু ভালো হইবো না। তোর মেইলের পাসওয়ার্ড বলে দে।” পুনরায় রুথিলার চুলের মুঠি টেনে ধরল সেই নারীটি।
“আমার পেনড্রাইভ ফিরিয়ে দে।” এতটুকু বলেই জ্ঞান হারালো রুথিলা।
বিগত তিনদিনের নির্যা’তনে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে রুথিলা। আর তার উপর নির্যা’তনের দায়িত্ব পেয়েছে রিমি নামক নারী। রুথিলার শুকিয়ে যাওয়া মুখখানা দেখে তার বড্ড মায়া হলো। এই তিন দিনে মাত্র তিনবার খাবার দেয়া হয়েছে রুথিলাকে। এই রিমিই এতক্ষণ রুথিলার সাথে কথোপকথনে লিপ্ত ছিল। সে তার দায়িত্ব পালনে অপরাগ হলে তার উপরেও যে নেমে আসবে অত্যাচারের স্টিম রোলার। সেই চিন্তা করেই ভয়ে রিমির গলা শুকিয়ে আসে। তার এসব আর ভালো লাগে না। এবার তারও মুক্তি চাই! তবেই হয়ত মিলবে শান্তি।
রুথিলাকে বাঁধন থেকে মুক্ত করল রিমি। অতঃপর তার হাত মুখ মুছিয়ে দিল। শরীরের আঘাতগুলোতে মলম লাগিয়ে দিল। যতই হোক সে তো একজন নারী। আর একজন নারী হয়ে অন্য নারীর কষ্ট যদি সে বুঝতে নাই পারে তবে তার নারীত্ব কোথায়! ভাগ্য যে রিমিকে এনে কোথায় ফেলল? কত সুন্দর দিনগুলো জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আর নতুন দিনগুলো এসেছে অভিশপ্ত হয়ে। না জানি কোন পাপের দরুন এতো কঠিন শাস্তি সে ভোগ করছে। সবটাই ভাগ্য নামক সম্ভাবনার নিষ্ঠুর পরিহাস! রুথিলাকে পুনরায় বেঁধে রাখল রিমি। আর বুক ফুঁড়ে তার বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~