সূচনায় সমাপ্তি শেষ পর্ব

0
302

#সূচনায়_সমাপ্তি
#অন্তিম_পর্ব
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

২৪.

“কী বলছো তুমি? তার মানে এই চক্রের প্রধান ছিল সাগ্রত ভাই? তুমি এতদিন তার সাথে থেকেও বুঝলে না!” চমকিত প্রেমার কথায় বিস্ময় প্রকাশ পেল।

“বুঝলে প্রেমা মানুষ চেনা বড্ড কঠিন। আমি সেই কঠিন কাজে বরাবরের মতো ব্যর্থ। সেদিন আমরা যখন ফোর্স নিয়ে নুরা মারমার বাড়িতে পৌঁছলাম গিয়ে দেখি রাফিদ, হিরন মরে পড়ে রয়েছে। ওদের মারার প্ল্যান কিন্তু আমার ছিল না। ওটা রুথিলা ম্যাম আর নুরা মারমার ছিল। আর পথে আরও চারজনের লাশ বিভিন্ন জায়গায় পেয়েছি। ওদের প্রত্যেককে পটাশিয়াম সায়ানাইড দিয়ে মারা হয়েছিল। পায়েসের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল বিধায় কেউ সন্দেহ করেনি। আর মজার বিষয় শুনবে! পাহারাদারগুলোকে বিষ না দিয়ে ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছিল। মানবাধিকার কর্মীরা আসলেই মানবিক। সে যাই হোক, তারপর রূপক স্যার যখন ম্যামকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেছিলেন তার হাতে থাকা পেনড্রাইভ আর গো প্রো ওখানেই রয়ে যায়। হঠাৎ দেখি সাগ্রত কাউকে ফোন করল। কথাগুলো শুনেই নিশ্চিত হয়ে যাই ও হচ্ছে চক্রের প্রধান। তারপর গোপনে নজর রাখতে আরম্ভ করলাম। দেখলাম গো প্রো আর পেনড্রাইভ নিরবে তুলে নিয়ে সাগ্রত গায়েব হয়ে গেল। সবটা ওইদিনই রূপক স্যারকে বললাম।” শামীম একটু থামল।

“এই থামলে কেন এরপর কী হলো বলবে না!” প্রেমা অস্থির হয়ে বলল।

“আরে আমাকে শ্বাস নিতে দেবে তো নাকি?”

“শ্বাস নিয়েছ তো এবার বল।”

“স্যার তারপর আমাকে বললেন রাফিদের লেখা চিঠি উনি পড়েছেন, সেখানে সাগ্রত যে তাদের চক্রের মূল এই সম্পর্কে বলা আছে। একে বাঁচিয়ে রেখে বিচার করলে পুলিশ বাহিনীর দুর্নাম হবে। এর চেয়ে গোপনে আবর্জনা দূর করাই হবে শ্রেয়। তার পরেরদিন অর্থাৎ আজ বিকেলটাই ছিল এর জন্য মোক্ষম সময়। স্যারের কথানুযায়ী সবটা করেছি।” বলে থামল শামীম।

“আচ্ছা তাহলে রূপক স্যার আর সাগ্রতকে যে মাদক মামলায় প্রায় দু’দিনের মতো গ্রেফতার রাখা হলো? সেটা কি করে সম্ভব হলো?”

“ওটা সাগ্রত নিজেই করেছিল। যেন অপারেশনে রূপক স্যার এটেন্ড করতে না পারে। কিন্তু রাফিদ খেলা পাল্টে দেয়। সেনাবাহিনীকে নিজের করা অপরাধ শিকারের পাশাপাশি মিথ্যে অভিযোগ নিজের কাঁধে তুলে নেয়। যে ওর লোককে দিয়ে রূপককে ফাঁসিয়েছে।”

অবাক হয়ে সবটা শুনছিল প্রেমা। তার মনে আবার প্রশ্নের উদয় হলো বিধায় জিজ্ঞাসা করল,

“কিন্তু রাফিদ হঠাৎ এত ভালো হয়ে গেল কেন? আর নুরা মারমা কী আদতে উপজাতি?”

“রাফিদ হয়ত নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত ছিল। সঠিক ঘটনা আমিও জানি না। নুরা মারমা উপজাতি নয় ঠিক। সে একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তার স্বামী ইসাই মারমার সাথে প্রেমের পর পরিণয়। তাই নিজেকে উপজাতি বলেই পরিচয় দেয়।”

“ওহ্। আমার না আরও অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করার ছিল মনে আসছে না।”

“আর জানতে হবে না এবার আমায় জানো। আমায় নিয়ে ভাব। আর কতকাল অন্যের জন্য চিন্তা করে শেষ হবে।”

“ধুর সরো। হিসেবগুলো মিলিয়ে দেখি। কী বুদ্ধিমান চক্র ছিল! মনে পড়েছে শামীম। নীলগিরিতে তো এরা অস্ত্র কারবারের সাথে যুক্ত ছিল তাই না! তাহলে কেন মারমা কিশোরীসহ আদিবাসী কিশোরীদের নৃশংসভাবে খু’ন করা হয়েছিল? তাছাড়া রুথিলাকে নিয়ে নীলগিরি ছেড়ে নীলাচলে নুরা মারমার বাড়িতেই বা কেন আনল?”

“উফ তুমি বড্ড জেদি। নীলগিরিতে ওদের অস্ত্রের ডেরা ছিল। এগুলো চোরাই পথে মিয়ানমার হয়ে নাফ নদীর মাধ্যমে বাংলাদেশের টেকনাফে ঢোকে, এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যায়। তারপর মালয়েশিয়ায় চলে যায়। আমরা অনেক অস্ত্র জব্দ করেছি নীলগিরি থেকে। আর রুথিলাকে ওখানে রাখাটা অনিরাপদ ছিল। সাগ্রত রূপক স্যারের সাথেই ছিল। তাই তার পদক্ষেপগুলো খুব সহজেই জেনে যাচ্ছিল। হিরনকে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করতে নির্দেশ দিয়ে ছিল ও। একটা বিশাল সিন্ডিকেট ছিল এই চক্রটার। আর খু’ন করার উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ি জনপদে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। যেন লোকজন ওই এলাকায় চলাচল বন্ধ করে দেয় আর ওরা নির্বিঘ্নে অপকর্ম চালিয়ে যেতে পারে। এছাড়া ওরা প্রচণ্ড নারী লোভী ছিল। এরপর নিশ্চয়ই জানতে চাইবে নুরা মারমা আসলে কার লোক!”

“হুম, তাইতো বুঝলে কী করে জান!” লাজুক হেসে নত মস্তকে বলল প্রেমা।

“আহা কী মধুর ডাক! কাজের সময় জান না আর কাজ ফুরলেই যান। আমি আর কিছুই বলব না। দেখি সর ঘুমোতে দাও। কাল আবার ডিউটি আছে।” কপট রাগ দেখিয়ে বলল শামীম।

প্রেমা আকস্মিক এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। নিজের বালিশ ছেড়ে উঠে এসে শামীমের গালে আলতো করে নিজের অধরজোড়া ছোঁয়াল। এহেন কান্ডে শামীমের চোখ বাইরে বেরিয়ে আসার উপক্রম! যেই মেয়ে লজ্জায় এখনো মুখ তুলে কথা বলে না, সে অভিযানের ঘটনা জানার জন্য সাক্ষাৎ চুমু খেয়ে ফেলল! শামীম উঠে বসল আর বলল,

“তুমি এটা কী করলে?”

“কেন? একটু চেক করলাম তুমি ঘুমিয়েছ নাকি?” এতটুকু বলেই দাঁতে জিভ কাটল প্রেমা। তারপর দ্রুত গতিতে শামীমের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,

“প্লিজ বল না! তাহলে আর বিরক্ত করব না।”

“নুরা মারমা রুথিলা ম্যামের পরিকল্পনা অনুসারেই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিরনের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল। আর রুথিলা ম্যামকে ব্ল্যাকমেইল করেছিল রাফিদ নুরা মারমার ক্ষতি করবে এই বলে, সে তো আর জানত না সে নিজেই জালে ধরা দিয়েছে। সেদিনের ওগুলো সব সাজানো নাটক ছিল। নুরা মারমা এক্ষেত্রে রুথিলা ম্যামের পক্ষেই কাজ করেছেন। অথচ রাফিদ জানত যে নুরা তাদের কথায় রুথিলার সাথে থাকে এবং ওর গোপন তথ্য জানিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত।”

“বাহ্ বেশ জটিল। তুমি ঘুমাও তবে। আমি একটু আসছি।” বলে প্রেমা উঠতে নিলেই শামীম এক ঝটকায় তাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে। প্রেমা লজ্জায় লাল হয়ে শামীমের বুকেই মুখ লুকায়।

২৫.

মাঝরাতে হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায় রুথিলার। চোখ মেলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে রূপকের পাশে শুয়ে আছে। নিজের অনাবৃত দেহের দিকে দৃষ্টিপাত হতেই রুথিলা সুখকর কিছু স্মৃতি স্মরণ করে আনমনে হেসে ওঠে। তারপর পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুম যেন আর ধরা দিতেই চাইছে না। অগত্যা বিছানায় উঠে বসল সে। তারপর আস্তে আস্তে রূপককে ডাকতে থাকে।

“এই রূপ, ওঠো না প্লিজ। আমার ঘুম আসছে না।”

“আবার নির্ঘাত ভুলভাল ভেবেছ। সুহানা আর নেই।”

মুহূর্তে রুথিলার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। রূপকের মুখে অন্য কোনো মেয়ের নাম শুনলে মনে হয় তা যেন ধারালো তীরের ন্যায় বুকের ঠিক মাঝ বরাবর আঘাত হানে। সমস্ত রাগ খানিকটা সময়ের মাঝেই রূপ নিল অশ্রুধারায়। নিঃশব্দে কাঁদতে চাইলেও শব্দ হয়েই যায়। ফলে রূপকের ঘুম অকস্মাৎ উবে যায়। সে হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে। আর তাতেই রুথিলার কান্নার বেগ বাড়তে থাকে। রূপক বলে,

“এই রুথি কাঁদছো কেন?”

“ভাইয়ার সাথে সাথে আমিও পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিলে ভালো হতো। আমরা দু’জনই জন্মের হতভাগা। কিংবা ওকে সহ আরও পাঁচটা খু’নের পরিকল্পনার সাথে জড়িত থাকার দায়ে আমার ফাঁসি হলেই ভালো হতো। অন্তত মাঝরাতে নিজের স্বামীর মুখে বাইরের একটা মেয়ের নাম শুনতে হতো না।” নাক টানতে টানতে কথাগুলো বলল রুথিলা।

“একটা থা’প্পড় দেওয়া উচিত তোমাকে। আর তুমি সেল্ফ ডিফেন্স করেছ। এর জন্য তোমার শাস্তি হবে কেন। আর কোন মেয়ের নাম নিয়েছি আমি।”

কান্নার বেগ বাড়িয়ে রুথিলা বলল,

“এই তো একটু আগেই বললে সুহানা আর নেই।”

“হ্যাঁ ঠিকই তো বলেছি ওই গ্যাংয়ের লিডার দু’টোকেই তো এনকাউন্টার করেছে এস আই শামীম।”

“কী?” হকচকিত হয়ে বলল রুথিলা।

“তোমাকে বলা হয়নি আর একটা জিনিসও দেয়া হয়নি।” বলে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে রূপক একটা কাগজ বের করে পুনরায় বলল, “ধর এই চিঠিটা। রাফিদ ভাইয়া তোমাকে দিতে বলেছিল। কিন্তু তুমি জ্ঞান হারালে তারপর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাই আর দেইনি।”

রুথিলার সেদিনের কথা পুনরায় স্মরণ হলো। বিভীষিকাপূর্ণ মুহূর্তেরা পুনরায় দগ্ধ হৃদয়ে আঘাত করল। কম্পনরত হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল রুথিলা। খুলে পড়তে আরম্ভ করার পূর্বে রূপক ওকে নিজের নিকটে টেনে নিয়ে বাহুডরে আবদ্ধ করল। তারপর বেডসাইড টেবিলের ল্যাম্পটি জ্বালিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় পড়তে বলল। রুথিলা পড়তে আরম্ভ করল,

আমার আদরের ছোট্ট রুথি,

ঝটপট করে মূল কথাগুলো লিখে যাচ্ছি। কারণ হাতে সময় খুবই কম। একটা ভাইয়ের কাছে সবচেয়ে জঘন্যতম বিষয় কী জানিস? নিজের বোনের চোখে নিজেকে নিয়ে ঘৃণা দেখা। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। তুই আমায় কতটা ঘৃণা করিস তা আমি পায়েসে বিষ মেশানো দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম। তাই আর নিজের বাঁচার ইচ্ছে হয়নি। দু’বাটি পায়েস খেয়ে নিজের মৃত্যু তরান্বিত করব তুই দেখে নিস। তবে যতক্ষণে তুই চিঠিটা পড়বি ততক্ষণে আমি দূর আকাশের তারা। আমার মতো পাপিষ্ঠের জন্য চোখের জল ঝরাবি না।

আমি যখন রাজনীতিতে জড়িয়েছি তখনই লোভে পড়েছি। আর সেই লোভেই আমার সর্বনাশ লেখা। কালকে অবধিও আমি লোভী ছিলাম। তবে তোর মুখে নিজের সম্পর্কে ঘৃণাযুক্ত বাক্য শুনে আত্ম উপলব্ধি হলো। নিজের জীবনের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হলো। আর আমি কিন্তু এই গ্রুপের লিডার না, কনস্টেবল সাগ্রত আর এস আই সুহানা হলো লিডার। রূপককে এতটুকু বলিস। ও নিজেই সবটা বের করবে। ভালো থাকিস। হিরন চলে এল বোধহয়।

ইতি

রুথির ভাইয়া

চিঠিটা ভাঁজ করে রূপকের কাঁধে মাথা রেখে বলল রুথিলা,

“যা হয় ভালো জন্যই হয়। যে যাওয়ার সে হয়ত গিয়েছে। আ’ম স্যরি তোমাকে রাগ দেখিয়েছি বলে। দু’টো প্রশ্নের উত্তর দাও তো!”

“হুম বল কী প্রশ্ন?”

“আমার গো প্রো আর পেনড্রাইভ কী তবে সাগ্রত নামক লোকটাই নষ্ট করেছে? তুমি তো বলে ছিলে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে হয়েছে তা বলোনি।”

“হ্যাঁ এটা সাগ্রতের কাজ।”

“ওহ্।”

“রুথি তুমি আমার মুখে ওই সুহানার নামটা শুনে এত রিয়্যাক্ট করলা অথচ আমায় যখন ছেড়ে গিয়েছিলা, ওকেই বিয়ে করতে বলে রেখে গিয়েছিলা চিঠিতে। তখন আমার কেমন লেগেছিল বল!

“আহারে স্যরি বেবি।” কিঞ্চিৎ হেসে বলল রুথিলা।

রূপক জানে রুথিলার মনের অবস্থা। সে যে রূপকের সামনে নিজেকে স্ট্রং প্রমাণ করতে চাইছে তাও জানে। তবে কিছু বলল না। থাক না মেয়েটা নিজের মত। সূচনায় সমাপ্তি ঘটিয়ে হারিয়েছিল সে দূর ঠিকানায়। সমাপ্তিতে ঘটিয়ে সূচনা সে ফিরেছে আবার নিজ ঠিকানায়। এটাই কী যথেষ্ট নয়! এই ভাবনার অন্তরালে হারিয়ে রূপকের মুখে ফুটল তৃপ্তির হাসি। রুথিলাকে পরম মমতায় আগলে নিয়ে চোখ বুজে রইল। রুথিলা পরম আবেশে ফোঁটা কয়েক জল বিসর্জন করে মনে মনে বলল, “তোর সূচনায় হোক আমার সমাপ্তি।”

____________

সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here