সুতোয় বাঁধা সংসার পর্ব-৩

0
915

#সুতোয় বাঁধা সংসার
writer::প্রিয়া

ভোরের আলো ফুটতেই চিল্লাপাল্লার আওয়াজ শুনে স্বপ্না তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে আসে।
সালমানের মা-বাবা এসেই চিল্লাতে থাকলেন।
-কুত্তার বাচ্চা বাইরে আয়।কোন নষ্টা বাড়িতে নিয়া আইছিস দেখমু আমি।

স্বপ্না এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিলো।
-মা ভিতরে আসুন।
-তুই মুখ পুড়ি এখনো এমন শান্ত কেমনে আছিস?
-মা ভিতরে এসে কথা বলুন লোকজন জড়ো হয়ে যাবে।

ভেজা চুল মুছতে মুছতে বাইরে আসে রুমা,পিছন পিছন সালমান।
স্বপ্না ওদের দেখে মুখ আড়াল করে ভেতরে চলে গেলো।

-হতচ্ছাড়া তুই এমন কালনাগিনী ঘরে নিয়া আসলি।

রুমা ছুটে গিয়ে সালমানের মাকে সালাম করলো।বাবাকে সালাম করতে গেলে উনি সড়ে যান।
-মা-বাবা প্লিজ ভিতরে আসুন রাগারাগি করবেন না।

সালমানের মা-বাবা রুমার দিকে না তাকিয়ে ভিতরে যেতে যেতে সালমানকে স্বপ্নার ঘরে যাওয়ার জন্য ডাকলেন।

উনারা গিয়ে ড্রইংরুমে বসতেই স্বপ্না পানি এনে দিলো।তরী,রিদ্ধ এসে সালাম করে পাশে বসলো।
রান্নাঘরে চা বসাতে যেতেই আবার সালমানের মা স্বপ্নাকে ডাকলেন।
-আমারে ঠিক কইরা কও বউমা তোমাগে মধ্যে কি বনাবনি হচ্ছিলো না।
-মা এসব কথা বাদ দিন আমার ভালো লাগছেনা। নিজেকে ছোট,অপদার্থ মনে হচ্ছে।
-আমি তো ছাড় দিমুনা তুমি আমার এই পোলার জন্য কত কি ত্যাগ করছো সেইটা আমার পোলা ভুইলা যাইতে পারে আমি পারিনা।

তরী আর রিদ্ধ দাদুর দিকে তাকায়।ওরা অনেককিছুই জানে না আজ হয়তো জানবে।
সালমানের বাবা বলে উঠলেন।
-বউমা এই বাড়ির এই সংসারের জন্য এতোকিছু করলে শেষে কিনা সতীনের ঘর করার জন্য এটা আমরা মানতে পারবো না।
-বাবা আমি তো সতীনের ঘর করবো না।আমি থাকবো বিধবা হয়ে।
বিধবা কথা শোনামাত্র সবাই চুপ হয়ে গেলো। সালমান তখন বেশ রাগী গলায় বলে উঠলো।
-আমি জীবিত মানুষকে তুমি মৃত বানিয়ে দিলে।তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমিই একমাত্র পুরুষ যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছি মহাপাপ করে ফেলছি।

স্বপ্না মুখটা ঘুরিয়ে নিলো সালমানের মুখ দেখবে না।

-বউমা ঠিক কথা বলছে তোর মতো স্বামীর চাইতে বিধবা হয়ে থাকা ভালো।
-বাবা আপনি কি আমাকে সুখি দেখতে চান না?
-আরে বাহ তুই যখন ১৬বছরের একটা মেয়েকে পালিয়ে নিয়ে এসেছিলি সেদিন তোর সুখের জন্য মেয়েটাকে মেনে নিয়েছিলাম।এখন তুই ৪২বছর বয়সে আরেকটা মহিলাকে পালিয়ে নিয়ে আসলি সেটা ও আমাদের মানতে হবে তোর সুখের জন্য।তুই যে ৫২বছরে আরেকটা মেয়েকে পালিয়ে নিয়ে আসবি না তার কি গ্যারান্টি আছে।

-বাবা ছেলেমেয়ের সামনে এভাবে কথা বলো না।
আমি তখন ছোট ছিলাম আবেগের বয়সে স্বপ্নাকে ভালো লেগে যায়।ওর পরিবার মানেনি তাই পালিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
-তো এখন আর স্বপ্নাকে ভালো লাগছেনা।
-বাবা বিষয়টা এতো জটিল না করে সহজ করে ভাবলে হয়।একটা পুরুষ চারটা বিয়ে করতে পারে।আমার তো টাকা পয়সার অভাব নেই, আমি দুইটা ফ্যামিলি ভালোভাবে ম্যানেজ করতে পারবো।

সালমানের মা উঠে এসেই দুইটা থাপ্পড় মেরে বসেন ছেলের গালে।
-তুই বুঝোস এইকথা দিয়া তুই মাইয়াদের অপমান করলি।একটা মাইয়া বিয়া কইরা আনলি তার কথা ভাবনি না। তোর টাকাপয়সা আছে তাই যখন ইচ্ছা বিয়া করবি।এহন তোর বিয়ার সময় মাইয়াডার দিকে তাকা দুই দিন পর মাইয়া বিয়া দিতি।কে করবো বিয়া যার বাপ বুইড়া বয়সে অন্য বেডি বিয়া করে।

**তরী, রিদ্ধ আর রিহানকে নিয়ে রুমে চলে গেলো।

-মা তুমি আমাকে মারলে। মা স্বপ্নার দিকে তাকাও আর আমার দিকে তাকাও ওকে আমার চাইতে বুড়া মনে হয় না।
১৮বছরের সংসারে ও ঝিমিয়ে গিয়েছে কেমন বয়স্ক হয়ে গেছে।আমি এখন বড় বিজনেস করি পার্টিতে যেতে হয়।কত বন্ধু বান্ধব আছে বিদেশি ওদের সামনে ওকে বউ বলে পরিচয় দেয়া যায় না।কেমন মোটা ভুড়িওয়ালি হয়ে গেছে।আমি একজন হ্যান্ডসাম, স্টাইলিশ বিজনেসম্যান। আমার পাশে রুমার মতো মেয়েকে মানায়।

স্বপ্নার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো।কিন্তু সালমানকে ছেড়ে দিলে চলবে না।
-মিঃ সালমান আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে।চিকন গড়নে, লম্বা, স্টাইলিশমেয়ে ছিলাম আমি। রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যেতাম কত ছেলে প্রপোজ করতো।তাদের মধ্যে একমাত্র আপনাকেই ভালো লেগেছিলো।
কলেজে উঠা মাত্রই বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করলো।সেই সাথে আপনার ভয় বাড়তে লাগলো আমাকে হারানোর ভয়।কারণ আপনি আমায় পাগলের মতোই ভালোবাসতেন।
বরপক্ষ বিয়ে ঠিক করতেই আপনি আমার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠালেন।বাবা বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দিবে না।
আপনি তখন পাগলপারা আমিও সাড়া দিলাম।এক কাপড়ে বেড়িয়ে এসেছিলাম।আমার বাবা সেদিন আমাকে মৃত ঘোষণা করলেন।এই ১৮বছরে বাবা আমার মুখ দেখেননি,মাকে মা বলে ডাকতে পারিনি।
সংসার সামলাতে পারতাম না,আপনার মা হাতে কলমে সংসার শিখালেন।আপনার বাবা জায়গা বিক্রি করে টাকা দিয়েছিলেন বিজনেস করার জন্য।আমি দিয়েছিলাম শক্তি। আল্লাহর দরবারে সারাক্ষণ দোয়া করেছি আপনার ব্যবসা সফলের জন্য। তরীর জন্ম হলো সিজারে।ধীরেধীরে আপনি পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় দিয়ে উন্নতি করতে লাগলেন। আমার কি কোনো অবদান ছিলো না।ভুলে গেছেন আমি তখন ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াতাম।বাড়ির খরচাপাতির জন্য আমার শখ আহ্লাদের জন্য এক পয়সা নষ্ট করিনি।বাচ্চাদের পড়িয়ে আর সেলাই কাজ করে যা পেতাম তাই দিয়ে আমরা চারজনের চলে যেতো।আপনি বিজনেস করছিলেন মন দিয়ে।
এক এক করে তিনটি সন্তান জন্ম হয় তিনজনই সিজারিয়ান বাচ্চা। রিহানের সময় তো মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছি।এতোকিছুর পর ও আমি আগের সেই টগবগে ১৬বছরের কিশোরী কি করে থাকি বলুন তো।
সেদিন আপনার বুঝা উচিত ছিলো একটা মেয়ে সারাজীবন যৌবন ধরে রাখতে পারে না।আপনি আপনার রাস্তা খুঁজে নিয়েছেন আশা করি আমাকে আর প্রয়োজন হবে না।

-তুমি একটু বেশি বুঝো স্বপ্না তুমি আমার জন্য অনেক করেছো মানছি।প্লিজ এবার আমার সুখের জন্য আমাকে আর রুমাকে ভালো থাকতে দাও।

সালমানের মা-বাবা স্তব্ধ, ছেলের এমন বেহায়াপনা দেখে ওরা কি বলবে ভাষা জানা নেই।
স্বপ্না রুমে গিয়ে দরজা আটকে বসে আছে। এতো অপমান, একজন মানুষের কাছে দৈহিক গঠন সব।ছিঃ এমন লোকের জন্য মা-বাবা ত্যাগ করেছিলো।আজ মা-বাবার অভিশাপে এতো বড় শাস্তি পেতে হচ্ছে।

অনেক ডাকাডাকি করার পর স্বপ্না দরজা খুললো।সালমানের মা-বাবা ভিতরে খাটে বসলেন।
স্বপ্নাকে জড়িয়ে ধরে সালমানের মা বলছেন,
ছোট্ট মেয়েটারে বুকে আগলে রাইখা বড় করেছিলাম,সংসার শিখায়ছিলাম এই দিনে আইসা মেয়ের এমন যন্ত্রণা দেখার আগে মইরা গেলেই ভালা হতো।

স্বপ্না কাঁদছে শব্দ করেই কাঁদছে।
-মা তুই গ্রামে চল, আমার সাথে থাকবি।
-বাবা এখানে আমার ছেলের স্কুল,মেয়ের কলেজ।
-ওদের কথা ভাববি তোর মানুষিক শান্তির দরকার আছে।
-বাবা জীবন আমার থেকে শান্তি কেড়ে নিয়েছে।কিন্তু আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে আমি পারবো না।
-তুই যে মারা যাবি রে মা। এতো কষ্ট কি সহ্য করা যায়।
-মা-বাবা ছাড়া যখন এতোদিন বুকে পাথর চেপে বেঁচেছিলাম এখন স্বামী ছাড়া পারবো বাবা।

-দেহো বউমা সালমানের সামনাসামনি থাকলে তোমার কষ্ট হইবো।
-আমি ওকে জীবনে আমার মুখ দেখাবো না মা।আমি যদি মারা যাই তখন ও কেউ ওকে আমার মুখ দেখতে দিবে না।

স্বপ্নার কঠিন প্রতিজ্ঞায় কেউ কিছুই বললো না।দুপুরের পর উনারা গ্রামে ফিরে গেলেন।
স্বপ্না গোসল সেড়ে রান্নাঘরে দুপুরের রান্না করে নিলো।রিদ্ধকে খেতে দিয়ে তরীকে খুঁজতে গেলো।ওয়াসরুমে পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে হয়তো তরী গোসল করছে।
প্রায় ১০মিনিট পর তিনি আবার আসলেন।তরী বের হয়নি দরজা একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়।
শাওয়ার ছেড়ে তরী চুল ধরে টানছে পাগলের মতো।টাওয়াল পেছিয়ে তরীকে বাইরে নিয়ে আসলেন।
-আবার সেই মাথাব্যথা মা আমি আর পারছিনা।
-শান্ত হো মা আমি এক্ষুনি ডাক্তারকে ফোন দিচ্ছি।রিদ্ধ তাড়াতাড়ি আয় বাবা।

রিদ্ধ ভাতের প্লেট রেখেই উঠে আসলো।
-আপু কি হয়েছে।
-তাড়াতাড়ি তোর ডাক্তার আংকেল কে ফোন দে।তরীর আবার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে।
-মা আমি ফোন দিচ্ছি।

তরীর জামা পাল্টে দিতেই তরী বেডে অজ্ঞান হয়ে পরে গেলো।স্বপ্না বেগম চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।রিদ্ধ এসে তরীকে এভাবে দেখেই চিল্লাতে শুরু করলো।
মাত্র ১মাস আগে তরীর ব্রেন টিউমারের অপারেশন হয়েছে।ডাক্তার বারবার বলে দিয়েছিলো ওকে স্বাভাবিক রাখতে সব চিন্তাভাবনার উর্ধ্বে রাখার জন্য।অন্য সবার মতো তরী কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারে না।সবকিছু নরমালি মেনে নেয়, কঠিন করে কিছু ভাবতে গেলেই ওর মাথাব্যথা শুরু হয়।তখন পাগলের মতো বিহেভ করে নিজের চুল নিজে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায়।অপারেশনের পর সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু এখন এতো বড় আঘাত মেনে নিতে পারেনি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here