সুতোয় বাঁধা সংসার পর্ব-১৪

0
675

#সুতোয় বাঁধা সংসার
writer::প্রিয়া
১৪
তিনদিনের জন্য বেড়াতে এসে ওরা পুরো এক সপ্তাহ থাকলো।
রিদ্ধ,তরী,রিহান নানা-নানীর আদর,ভালোবাসা পেয়ে খুব খুশি।বিদায়ের মূহুর্ত বরাবরই কষ্টের।সবার মন খারাপ কি আর করার এতোদিন ধরে স্কুল, কলেজ কামাই করা যায় না।
স্বপ্না ভিতরের যন্ত্রণাগুলো থেকে অনেকটা বেড়িয়ে এসেছে।মন খুলে হেসেছে সবার সাথে।মেয়েকে এমন হাসতে দেখে স্বপ্নার শাশুড়ী বেশ খুশি।

ফেরার পথে রিহান বায়না ধরছে আইসক্রিম খাবে।রাস্তার পাশে আইসক্রিমবার দেখে।
তরী সবাইকে গাড়িতে রেখে আইসক্রিম কিনতে গেলো।৩টা আইসক্রিম কিনে ওদের হাতে দিয়ে টাকা দিতে আবার গেলো।টাকা দেয়ার পর গাড়িতে উঠার আগেই মোটরসাইকেল থেকে একটা ছেলে টান দিয়ে তরীর ব্যাগ ছিনিয়ে নিলো।

ওরা গাড়ি নিয়ে পিছু করলে ছেলেটাকে ধরতে পারেনি।ব্যাগে তেমন কিছুই ছিলো না অল্প কিছু টাকা আর ফোন।
তরীর ফোনের জন্য দুঃখ হচ্ছে বেশি।

বাসায় ফিরে আসলো সবাই। স্বপ্নাকে ধরে তরী বাচ্চাদের মতো করছে।
-মা আমার ফোন।
-মন খারাপ করিস না। বিপদ কেটে গেছে অন্যদিক থেকে হয়তো আরো বড় বিপদ আসতো।
-আমার অনেক মায়ার ফোন।
-নতুন একটা কিনে নিস।
-এই ফোন তো পাবো না।
-পাগলি মেয়ে মন খারাপ করিস না।
-মা
-বল
-এই ফোনে আমার অনেক স্মৃতি তোমার সাথে বাবার সুন্দর মুহূর্ত গুলোর ছবি।
-তোর বাবাই চলে গেছে ফোনে আর স্মৃতি রেখে কি হবে।
-আমি প্রতিদিন দেখতাম।তোমার হাসিমাখা মুখ আমাদের সুন্দর সংসার।
-যা হাত মুখে ধুইতে যা।

তরী মন খারাপ করে চলে গেলো।সালমান প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় খেয়াল করে ওদের দরজা বাইরে থেকে তালা দেয়া
আজ দরজা খোলা দেখে মন শান্ত হলো ওরা ফিরে আসছে তাহলে।

-রুমা ওই বাসার সবাই বোধহয় ফিরে আসছে।
-তাতে কি হয়ছে?
-নাহ এমনি।
-প্রেম উথলে উঠছি নাকি?
-তোমার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি।
-যাদের সাথে সম্পর্ক নেই তাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কি আছে?
-আমি কি বললাম শুধু বলেছি ওরা হয়তো ফিরে আসছে।
-আপদ মরলে শান্তি।
-ঠাসস থাপ্পড়টা জোরে দিলো।
এতো বাজে তুমি।আমার সন্তান, আমার মা আপদ মনে হচ্ছে তোমার।
-সালমান কথায় কথায় গাঁয়ে হাত তুলো না।
-তুমি কথায় কথায় নেগেটিভ চিন্তা করো না।
-ওই পরিবারকে নিয়ে কিছু বললে আমার মাথায় আগুন ধরে।
-উফফ!অসহ্য।

সালমান ফ্রেশ হতে চলে গেলো।বাচ্চাটা কান্না করেই যাচ্ছে রুমা ওকে কোলে নিচ্ছে না।
সালমান ফ্রেশ হয়ে এসে ওকে কোলে নিলো।
-বাচ্চা কাঁদছে আর তুমি বসে আছো।
-এই বাচ্চা হওয়ার পর থেকেই তুমি আমাকে অবহেলা করছো।
-উফফ রুমা আজেবাজে কথা বন্ধ করো।
-তা নয়তো কি, আগে কত ভালোবাসতে এখন বাসো।
-ভালোবাসি তো।
-নাহ।
-বকা দেই তুমি বাজে কথা বলো তাই।
-আমি এখন মোটা হয়ে গেছি,বুড়ি লাগছে আমায় তাই অন্যমেয়েদের চিন্তা করছো।
-আবার কিন্তু আমার হাত চলবে।
-তাইলে বলো আগের মতোই ভালোবাসবে।
-বাসি রে বাবা আর ও বেশি ভালোবাসবো।
-একটা কথা রাখতে হবে।
-কি?
-আমি তো মোটা হয়ে যাচ্ছি।ঘরে বসে থেকে তাই ভাবছি নিয়মিত জিমে যাবো।
-বাচ্চা কার কাছে থাকবে?
-কাজের মেয়ের কাছে।মাত্র তো দু ঘন্টা।
-বাচ্চা আরেকটু বড় হোক।
-অনেক বড় হয়ছে আর না।এখন আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে।তোমার সাথে আমাকে মানাচ্ছে না।
-যা খুশি করো।
– থ্যাঙ্কিউ।

দু দিন পর রুমা একটা জিম সেন্টারে ভর্তি হলো।বাড়ির কাছে ভর্তি না হয়ে দূরে ভর্তি হওয়ায় সালমান ঝগড়া করলো।কিন্তু রুমার চল-চাতুরীর কাছে ব্যর্থ হয়।

**তরী নতুন একটা ফোন কিনেছে পুরোনো সিম তোলা হয়নি বাবার নামে রেজিস্ট্রেশন তাই।
কিছুদিন পরেই ইন্টার পরিক্ষা।দিনরাত এক করে পড়ে যাচ্ছে তরী।যে করেই হোক এ+পেতে হবে।
স্বপ্নার কাজ বেড়ে গেলো।রিহানকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা।এখন আর সালমানের কথা মনে হয় না।ভুলে যেতে চায় অভিশপ্ত অতীত।

**রুমা কয়েকদিন থেকে রাসেলকে ফোন দেয়ার কথা ভাবছে।কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না।
আজ সালমান চার দিনের জন্য অফিস ট্যুরে গেছে।রুমা ফোন হাতে নিয়ে ভাবছে রাসেল যদি ট্যুরে যায় ফোন দিবে কি না।
ভাবতে ভাবতে কল দিয়ে বসলো প্রথম রিং বাজতেই ফোন রিসিভ।
-আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
-আমি রুমা।
-ওহ ম্যাডাম কেমন আছেন?
-এমনভাবে ম্যাডাম বলো যেনো মনে হয় আমি তোমার অফিসের বস।
-বসের স্ত্রী তো।
-তা ঠিক তবে ম্যাডাম বলা আমার পছন্দ না।
-তাহলে কি বলবো?
-রুমা বলতে পারো।
-সেটা কি করে হয়?
-চাইলেই হয়।বাই দ্যা ওয়ে তুমি ট্যুরে যাওনি।?
-নাহ যেতে পারিনি বাবা অসুস্থ।
-ভালো হয়ছে।
-কি ভালো হয়ছে?
-এই যে তুমি যাওনি।আমার সাথে গল্প করে সময় কাটাতে পারবে।
-স্যার ছাড়া একা লাগছে নাকি?
-তা তো একটু লাগছে।
-হা হা বুঝতে পারছি।
-বিকেলে ফ্রি আছো?
-কেনো?
-বাইরে একটু ঘুরতে যেতাম।
-আমি তো হাসপাতালে।
-ওহ তোমার আব্বু কি হাসপাতালে ভর্তি?
-জ্বি।
-কোন হাসপাতাল আমি আসবো।
-নাহ কষ্ট হবে আপনার।
-সমস্যা নেই বলো।

রাসেল ঠিকানা পাঠিয়ে দিলো।রুমা দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে জিমে যাচ্ছে বলে বেড়িয়ে গেলো।যাতে সালমান ফোন দিলে কাজের মেয়ে বলে দেয় রুমা জিমে।

রাসেল রুমার জন্য অপেক্ষা করছে।রুমা আসতেই হা করে তাকিয়ে থাকে।
-কি হলো?
-আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে।
-তাই বুঝি?
-হুম সত্যি।

রুমা আর রাসেল কেবিনে গেলো।রাসেল, রুমাকে বসের বউ বলে পরিচয় দিলো।
রাসেলের বাবা, মায়ের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে দুজন বেড়িয়ে আসে।
-টাকা পয়সার কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে।
-আমার বেতন তেমন বেশি না।পরিবার চালিয়ে নিজের শখ পূরণ হয় না।তারউপর বাবা অসুস্থ অনেক টাকার দ্বায়।

রুমা হ্যান্ডব্যাগ থেকে ১০হাজার টাকা বের করে দিলো।
-এই টাকা রাখো আর যদি প্রয়োজন হয় বলতে দ্বিধা করো না।
-ছিঃ ছিঃ আমি নিতে পারবো না।
-মনে করো আমি তোমার বন্ধু।
-বন্ধু বলে বিপদে ফেলে দিলেন।
-গুড বয়।আসি তাহলে।

রুমা চলে যেতেই রাসেল শয়তানি হাসি দিলো।রাতভর চললো দুজনের ফোনালাপ।
এখন রোজ দুজনের দেখা হয়। এই চারদিন দুজন মিলে কত ঘুরেছে হিসেব নেই।
আজ সালমান ফিরে আসলো।রুমার মন খারাপ আরো কিছুদিন থাকলে পারতো।

তরী প্রায় উল্লাসের কথা ভুলতে বসেছে।।যদি নিয়মিত কথা হতো তবে নিশ্চয়ই উল্লাস ওর মনে জায়গা করে নিতো।তবুও মাঝেমধ্যে মনে হয়।এদিকে পরিক্ষা খুব ভালো হচ্ছে তরীর।

একদিন হুট করেই রুমা রাগিরাগি চেহারা নিয়ে বাসায় আসলো।অপ্রত্যাশিত রুমাকে দেখে সবাই একটু চমকে উঠলো।
-মেয়েকে ঠিকমতো শিক্ষা দাওনি?
-কি বলছো আমার মেয়ে কি করেছে।?

স্বপ্না বুঝতে পারছেনা তরী কি করবে।তখনি ওর শাশুড়ী বাইরে আসলেন।
-কি করেছে আমার নাতনি?
-দেখে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।
-রুমা বাজে কথা বাদ দিয়ে বলো তরী কি করেছে?
-আমার বোনের ছেলেটার মাথা খেয়ে দিছে।
-কিসব বলছো?
-দু দিনের জন্য এসেছিলো।তাতেই উল্লাসের মাথা নষ্ট করে দিয়েছে প্রেমের ফাঁদে পেলে।

রুমার কথা কিছুই বুঝতে পারছেনা স্বপ্না ওর শাশুড়ী। রিদ্ধ, তরী কেউ বাসায় নেই।
-বুঝিয়ে বল কি হয়েছে?
-তোমার গুণধর মেয়ে আমার বোনের ছেলে উল্লাস আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলো আমেরিকা থেকে।
তোমার মেয়ে, উল্লাসকে ফুসলিয়ে প্রেম করছে।এবার আমার বোনের ছেলেটা তোমার মেয়ের জন্য পাগলপারা। বাসায় পাগলামি করছে তোমার মেয়েকে নাকি বিয়ে করবে।
-আমার মেয়ে এমন কিছু করবে বলে মনে হয় না।
-আমি কি মিথ্যা বলছি।তোমার মেয়ের জন্য উল্লাস দেশে ফিরে আসতে চাইছে।আজ আমার বোন ফোন করলো।
আমি সাবধান করে দিচ্ছি টাকাওয়ালা ছেলে দেখে মেয়েকে লেলিয়ে দিবে না।
-চুপ কর।আমার মেয়েকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিবো।তবুও তোর বোনের ছেলের কাছে যেতে দিবো না।
-চরিত্রহীনা মেয়ে।সাধু সেজে থাকে তলে তলে নোংরামি করে।
-রুমা আমার মেয়ের নামে বাজে বলবি না।
-মা ও যেমন। মেয়ে আর কেমন হবে।
-অন্তত আমি তোর মতো না।অন্যের স্বামী নিয়ে টানাটানি করবো।ফুসলিয়ে বিয়ে পর্যন্ত।
-দেখা আছে। বড়লোক ছেলে দেখে মেয়েকে দিয়ে বশ করিয়ে নিয়েছো।
সালমানের কানে এখনো কথাটা দিইনি। সাবধান করবেন মেয়েকে।

রুমা আরো অনেক বাজে কথা বলে বেড়িয়ে গেলো।তরী পরিক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরে।
দরজা খুলে ভিতরে আসতেই ওর মায়ের প্রশ্ন।
-উল্লাসকে চিনিস?

পিছন থেকে তরী দাদি বলছেন।
মেয়েটাকে ফ্রেশ হতে দে।খাওয়াদাওয়া পর নাহয় এসব নিয়ে কথা হবে।
-আমি জানতে চাইছি উল্লাসকে চিনিস তুই?
-হ হ হ্যাঁ মা।

গুনে গুনে চারটা থাপ্পড় পরলো তরীর গালে।
টাল সামলাতে না পেরে সোফায় গিয়ে পরে তরী।মেয়ের চুলের গোছা ধরে টেনে তুলে স্বপ্না।
-এতো অপমান করানোর জন্য তোকে জন্ম দিয়েছিলাম।তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে যাচ্ছি।শেষ প্রতিদান এটাই দিলি তুই।

তরী কাঁদতে কাঁদতে কথা বলতে পারছেনা।তরীর দাদি তরীকে ছাড়িয়ে রুমে নিয়ে আসে।
স্বপ্না সোফায় বসেই কান্না করছে।তরীর গাঁয়ে কোনোদিন হাত তুলেনি ওরা।জন্মের পর থেকেই তরীর অসুখ লেগে থাকে।বছরে বেশির ভাগ সময়ই তরী অসুস্থ।পুতুলের মতো বড় করেছে ওরা তরীকে।আজ সেই মেয়ের গাঁয়ে হাত তুলে নিজেই বেশি কষ্ট পাচ্ছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here